লেখাটি
অবশেষে না
লিখে পারলাম
না। সেদিন
এক ছাত্র
আমার অফিসে
এসে বেশ
কয়েকটি প্রশ্ন
করল যা
শুনে মনে
হলো, এ
পত্রিকার অনেক
পাঠককেও এসব
বিষয়ে অবগত
হওয়া দরকার।
তার প্রধান
প্রশ্নটি ছিল,
এখন যে
কিছু মানুষ
ব্যাংক থেকে
আমানত উঠিয়ে
ফ্ল্যাট কিনছে
তার প্রভাব
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে
কী হতে
পারে। যদিও
এ ব্যাপারে
আমার কাছে
এখনো কোনো
প্রমাণ নেই।
তর্কের খাতিরে
ধরা যাক
তার অনুমান
সত্য। সাধারণত
শিল্প বা
সেবা খাতের
তুলনায় আবাসিক
খাতে বিনিয়োগ
অর্থনীতিতে অদক্ষ
হিসেবে বিবেচনা
করা হয়,
কারণ বিনিয়োগের
টাকাটা অনেকটাই
নিষ্ক্রিয় হিসেবে
পড়ে থাকে,
তেমন কোনো
কাজের সৃষ্টি
করে না
এবং এর
অর্থনৈতিক গুণকও
তুলনামূলকভাবে কম।
আগে অর্থনীতিতে
যেখানে আপনার
ব্যাংকের আমানতের
একটা সক্রিয়
ব্যবহার ছিল,
এখন সেই
টাকা অলসভাবে
একটা ফ্ল্যাটে
পড়ে আছে।
তবে আবাসিক
খাতের সব
বিনিয়োগই অপ্রয়োজনীয়
নয় যদি
বিনিয়োগটি আবাসন
খাতের স্বল্পতা
দূর করে
এবং এর
ফলে বাসস্থান
অনেকটা সামর্থ্যের
মধ্যে চলে
আসে।
এখন
যারা ব্যাংকের
আমানত তুলে
ফ্ল্যাটে বিনিয়োগ
করছে তার
পেছনে কমপক্ষে
দুটি ব্যাখ্যা
দাঁড় করা
যায়। বর্তমানে
দ্রব্যমূল্যের হার
ব্যাংকের দেয়া
সুদহারের চেয়ে
বেশি হওয়ায়
প্রকৃত সুদের
হার এখন
শূন্যের নিচে
(নেগেটিভ)।
এখন ব্যাংকে
সঞ্চয় করা
তাই অনেকটা
বোকামি। দ্বিতীয়
বিষয়টি হলো,
মানুষের আস্থা
যদি ব্যাংক
খাতের ওপর
কমতে থাকে,
তারা সন্দিহান
হয়ে পড়ে
আমানতের নিরাপত্তা
নিয়ে। যেহেতু
বাংলাদেশে ব্যাংকের
আমানত শতভাগ
সুরক্ষিত নয়,
এ সন্দেহ
একেবারেই উড়িয়ে
দেয়া যায়
না। চলতি
বছর অর্থনীতিতে
তিন নোবেল
পুরস্কার পাওয়া
দুজন অর্থনীতিবিদ
ডগলাস ডায়মন্ড
ও ফিলিপ
ডিবভিগ ঠিক
এ বিষয়
নিয়েই কাজ
করেছেন। তারা
তাদের মডেলে
দেখিয়েছেন যে
মানুষ যদি
বিশ্বাস করে
অন্য আমানতকারীরা
তাদের আমানত
ব্যাংক থেকে
তুলে ফেলবে
তাহলে তারাও
তাদের আমানত
তুলে ফেলতে
শুরু করবে।
পাশাপাশি আবার
অনেক আমানতকারী
ব্যাংকের ওপর
চিরাচরিত ভরসা
রাখবে এবং
আমানত তুলে
ফেলবে না।
এ দুই
পরিস্থিতি একই
সঙ্গে বিদ্যমান
হতে পারে
যাকে অর্থনীতির
ভাষায় বলা
হয় মাল্টিপল
ইকুইলিব্রিয়া বা
একাধিক ভারসাম্য।
এ একাধিক
ভারসাম্য আতঙ্ক
ও গুজবের
সংমিশ্রণে একটি
অথবা কিছু
ব্যাংকের দেউলিয়া
হওয়ার পেছনে
দায়ী হতে
পারে।
ডায়মন্ড
ও ডিবভিগের
মডেলটি যৌক্তিকভাবে
সামঞ্জস্যপূর্ণ এবং
বাংলাদেশের বর্তমান
ব্যাংক খাতের
অস্থিরতা কিছু
পরিমাণে ব্যাখ্যা
করলেও এ
পরিস্থিতি পুরোটা
বাস্তবসম্মত নয়।
কারণ কেন্দ্রীয়
ব্যাংক বা
বাংলাদেশ ব্যাংক
ইচ্ছা করলেই
যেকোনো ব্যাংকে
টাকা দিতে
পারে যাতে
ব্যাংকের আমানতকারীরা
ভরসা ফিরে
পান। কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের এ
একচেটিয়া টাকা
জোগান দেয়ার
কর্তৃত্বই ব্যাংকিং
খাতের স্থিতিশীলতার
একটি বড়
কারণ। কিন্তু
এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
হলো ব্যাংকের
মধ্যে এক
ধরনের নৈতিক
বিপত্তি বা
মোরাল হ্যাজার্ড
সৃষ্টি, যার
ফলে ব্যাংক
খাতের ঝুঁকি
বেড়ে যায়।
অবশ্য বাংলাদেশের
ব্যাংক খাতে
নৈতিক বিপত্তি
কোনো নতুন
বিষয় নয়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের
পক্ষপাতিত্বের জন্য
বাংলাদেশের অনেক
বড় ঋণগ্রহীতার
মধ্যে মোরাল
হ্যাজার্ড ব্যাপারটা
খুবই প্রকট।
তবে
ব্যাংক খাতে
যদি তারল্য
সংকটের মাত্রা
খুব বেড়ে
যায় তখন
টাকা মুদ্রণ
করা ছাড়া
আর অন্য
উপায় থাকবে
না এবং
এর ফলে
দ্রব্যমূল্যের হার
আরো বেড়ে
যাওয়ার আশঙ্কা
রয়েছে। অতীতে
এ রকম
অনেক ঘটনা
পাওয়া যায়
অন্য দেশে,
যার মধ্যে
আর্জেন্টিনা অন্যতম
উদাহরণ। আর্জেন্টিনা
বলতে আমরা
প্রধানত ম্যারাডোনা
ও মেসিকেই
বুঝি। কিন্তু
সরকারের অনেক
ভুল নীতির
জন্য আজকে
আর্জেন্টিনার মানুষ
তাদের মুদ্রা
পেসোকে বাদ
দিয়ে ডলার
ও ক্রিপ্টোকারেন্সিতে
আগ্রহী। মুদ্রা,
ব্যাংকিং এবং
রাজকোষের বিষয়গুলোকে
তাই হালকাভাবে
নেয়া উচিত
নয়। কারণ
একবার বিশ্বাস
ভঙ্গ হলে
তা পুনরুদ্ধার
করা কঠিন।
আমানতকারীদের
সাম্প্রতিক এ
নিরাপত্তাহীনতার ব্যাপারটাও
হালকাভাবে নেয়া
উচিত নয়।
এর মধ্যেই
কিছু বিদেশী
ব্যাংকের আমানতের
পরিমাণ এতই
বেড়ে গিয়েছে
যে এসব
ব্যাংকে এখন
অ্যাকাউন্ট খোলাটাই
দুষ্কর। আবার
এটাও লক্ষ
করা যেতে
পারে যে
কেউ কেউ
তুলনামূলক দুর্বল
ব্যাংক থেকে
টাকা উঠিয়ে
নিয়ে আর্থিকভাবে
সচ্ছল ব্যাংকগুলোয়
টাকা জমা
করছে।
ব্যাংক
থেকে আমানত
উঠিয়ে ফ্ল্যাট
কেনার পাশাপাশি
অনেকে হয়তো
আমানত দিয়ে
ডলারও কিনে
রাখছে। ডলার
ক্রয় ফ্ল্যাট
কেনার চেয়ে
অনেক সহজ
এবং অল্প
কিছু সময়ের
মধ্যেই ভালো
রিটার্ন আসতে
পারে, যেহেতু
বাজারে এখন
ডলার সংকট
খুব তীব্র।
এটা আঁচ
করতে পেরেই
বাংলাদেশ ব্যাংক
আগস্টে একটি
নোটিস জারি
করে, কেউ
১০ হাজার
ডলারের বেশি
মজুদ করতে
পারবে না।
একবার চিন্তা
করে দেখুন
গত কয়েক
দশকে বাংলাদেশের
কত অর্থনৈতিক
অগ্রগতি এবং
বৈষম্য হয়েছে
যে এখন
মানুষের কাছে
বিপুল পরিমাণে
ডলার মজুদ
আহামরি কিছু
নয়। যদি
এক লাখ
মানুষ ১০
হাজার ডলার
করে মজুদ
করে তাহলে
১ বিলিয়ন
ডলার বাজার
থেকে কমে
যাবে। সাম্প্রতিক
সময়ে টাকার
দ্রুত অবমূল্যায়নের
কারণে তাই
কয়েক বিলিয়ন
ডলার বাজার
থেকে উধাও
হয়ে যাওয়া
অস্বাভাবিক কিছু
নয়।
ভবিষ্যতে
ডলার সংকট
এড়াতে বাংলাদেশ
ব্যাংক আমাদের
লক্ষাধিক ফ্রিল্যান্সারের
বৈদেশিক মুদ্রা
দেশে আনার
ব্যাপারটা একেবারে
সহজ করে
ফেলতে পারে।
পাশাপাশি রাজস্ব
বোর্ড এ
আয়ের ওপর
কোনো কর
আরোপ না
করার প্রতিশ্রুতি
দিতে পারে
কমপক্ষে সাত-আট
বছরের জন্য,
যা একজন
ফ্রিল্যান্সারকে তার
জায়গায় একটি
শক্ত ভিত
তৈরিতে সাহায্য
করবে। বর্তমানে
বাংলাদেশে বসে
বিদেশের কনসাল্টিং
করে ডলার
আনা খুবই
দুষ্কর। সম্প্রতি
আমার এক
সহকর্মী নেপাল
থেকে তার
কনসাল্টিংয়ের সম্মানী
দেশে আনার
যন্ত্রণা এ
পত্রিকায় বর্ণনা
করেছেন। বিদ্যমান
ব্যাংকিং আমলাতান্ত্রিক
জটিলতার জন্য
তিনি কয়েকশত
ডলার দেশে
আনতেই পারলেন
না। এসব
বৈধ বৈদেশিক
লেনদেনগুলো বাংলাদেশ
ব্যাংক একেবারে
সহজ করে
ফেলতে পারে।
যেমনটা অ্যাপের
মাধ্যমে খাবার
অর্ডার দেয়ার
মতো। লেখাটি
জমা দেয়ার
তিনদিন পর
জানতে পারলাম,
বাংলাদেশ ব্যাংক
সেবা খাতে
ইনওয়ার্ড রেমিট্যান্সের
জন্য ফরম-সি
পূরণের আবশ্যকতা
শিথিল করে
দিয়েছে। এজন্য
বাংলাদেশ ব্যাংককে
সাধুবাদ জানাই।
আমদানি
এলসি এবং
টিটির কড়াকড়ি,
সরকারি কর্মচারীদের
বিদেশ ভ্রমণে
বিরতি এবং
অন্যান্য সম্পর্কিত
পদক্ষেপ ডলার
রিজার্ভ কমাতে
কিছুটা হলেও
সাহায্য করবে।
কিন্তু যে
ব্যাপারটায় সবচে
বেশি নজরদারি
করা উচিত
তা হলো—রফতানিকারকরা
যাতে ডলার
আয় দেশে
নিয়ে আসেন
এবং যারা
এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট
ফান্ড থেকে
ডলার ধার
নিয়েছেন তা
সময়মতো ফিরিয়ে
দেন। সরকার
ও সরকারি
সংস্থাগুলোর সদিচ্ছা
থাকলে কিনা
সম্ভব এ
দেশে!
একটা
উদহারণ দিলে
ব্যাপাটা খোলাসা
হবে। বর্তমান
সরকার তার
আশ্রয়ণ প্রকল্পের
জন্য যেভাবে
সরকারি খাসজমিগুলো
দেশের বিভিন্ন
প্রভাবশালী ব্যক্তির
কাছ থেকে
পুনরুদ্ধার করেছে
তা শুধু
বড় প্রশংসারই
যোগ্য নয়,
এটা সরকারের
দক্ষ ব্যবস্থাপনারও
পরিচয়। তবে
এটা ঠিক
যে এ
আশ্রয়ণ প্রকল্পে
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর
সরাসরি অন্তর্ভুক্তি
থাকার জন্য
কাজটা দ্রুত
এবং সঠিকভাবে
হয়েছে। তাহলে
কি প্রধানমন্ত্রীর
হস্তক্ষেপ না
থাকলে অন্য
কোনো কাজ
ফার্স্ট ক্লাসভাবে
হবে না?
তবে ব্যাংক
ও বিদ্যুৎ
খাতের অব্যবস্থাপনার
জন্য দুজন
ডেপুটি প্রধানমন্ত্রীর
ব্যাপারটা ভাবা
যেতে পারে।
বাংলাদেশের
ভবিষ্যতের সম্ভাবনা
তেমনই, যেমনটা
আমাদের কাজ
ও আচরণ
হবে। বাংলাদেশের
ট্রাকচালকরা যখন
আরব আমিরাতে
ট্রাফিক আইন
মেনে চালান
তার পেছনে
তাদের সাক্ষরতার
চেয়ে উচ্চ
জরিমানা দেয়ার
ভয়টা বেশি
কাজ করে।
আবার দেখা
গেছে, ঢাকার
ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে
বাস ও
গাড়িচালকরা ট্রাফিক
আইন ঠিকঠাক
মেনে চলেন,
কিন্তু একবার
ক্যান্টনমেন্ট থেকে
বের হলেই
আইন ভাঙার
প্রবণতা বেড়ে
যায়। যার
যেখানে শাস্তি
প্রাপ্য সেটা
নিরপেক্ষভাবে বাস্তবায়ন
না করলে
দেশে একটা
বিশৃঙ্খলা ও
অস্থিরতার পরিবেশ
রয়েই যাবে।
একটি বড়
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের
পরিচালনা পর্ষদের
বেশকিছু সদস্য
দুর্নীতিতে জড়িত
থাকার বিষয়টি
প্রমাণ হওয়ার
পর তাদের
শাস্তি একটা
প্রশংসামূলক দৃষ্টান্ত।
কিন্তু যখন
সরকারি আমলা,
আইন-শৃঙ্খলা
কর্মী বা
রাজনীতিবিদদের দুর্নীতিতে
জড়িত হওয়ার
প্রমাণ মেলে,
তাদের ক্ষেত্রে
কেন সামঞ্জস্যপূর্ণ
শাস্তির দৃষ্টান্ত
দেখা যায়
না?
দক্ষভাবে
অর্থনীতি পরিচালনার
জন্য ভিন্ন
ধরনের কর,
সুদের হার
বা ট্যারিফের
প্রয়োজন হয়।
কিন্তু দেশ
পরিচালনার জন্য
সবার জন্য
শুধু একটি
নিরপেক্ষ আইনের
প্রয়োগ দরকার।
এ দুরূহ
কাজটা পলিটিশিয়ানদের
সংকল্প এবং
জনগণের চাপ
ছাড়া অর্জন
সম্ভব নয়।
ড. সৈয়দ আবুল বাশার: অর্থনীতির অধ্যাপক, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি