ফুসফুস ক্যান্সার সচেতনতা মাস

প্রয়োজন জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি

অধ্যাপক ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালের ক্যান্সার রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান। দীর্ঘদিন ধরে ক্যান্সার চিকিৎসা, অধ্যাপনা গবেষণা করছেন। বাংলাদেশে ফুসফুস ক্যান্সারের প্রাদুর্ভাব চিকিৎসা সীমবদ্ধতা এবং গবেষণা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

সম্প্রতি দেশে ক্যান্সারের রোগী কি আগের থেকে বৃদ্ধি পেয়েছে?

আমাদের নিজস্ব কোনো জনগোষ্ঠীভিত্তিক ক্যান্সার নিবন্ধন বা রেজিস্ট্রি ব্যবস্থা নেই। কারণে নিজস্ব সঠিক কোনো তথ্য আমাদের কাছে নেই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সহযোগী দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অব ক্যান্সারের (আইএআরসি) হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আগের চেয়ে ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। সর্বশেষ আইএআরসির ২০২০ সালের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় লাখ ৫৭ হাজার মানুষ নতুন করে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয় এবং প্রায় লাখ হাজার মারা যায়। গ্লোবোক্যানের ২০১৮ সালের তথ্য বলছে, প্রতি বছর আক্রান্ত হয় লাখ ২১ হাজার এবং মারা যায় লাখ। এছাড়া জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইনস্টিটিউট হাসপাতালের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ সাল থেকে ক্যান্সার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।

দেশে ক্যান্সারের মধ্যে ফুসফুস ক্যান্সার কততম অবস্থানে রয়েছে?

পুরুষদের মধ্যে ফুসফুসের ক্যান্সার এক নম্বর কিন্তু নারীদের মধ্যে স্তন ক্যান্সার আক্রান্তের হার শীর্ষে। তবে ২০১৮ সালের গ্লোবোক্যানের প্রকাশনা অনুযায়ী নারী পুরুষ মিলিয়ে এক নম্বর অবস্থানে ছিল ফুসফুসের ক্যান্সার। আবার ২০২০ সালের প্রতিবেদনে খাদ্যনালির ক্যান্সারটাই এক নম্বর।

এসব পরিসংখ্যান কখনোই হাসপাতালভিত্তিক হয় না; হয় জনগোষ্ঠীভিত্তিক, আমাদের রিপোর্টটা হাসপাতালভিত্তিক। এজন্য অফিশিয়ালি বলতে হলে ওদেরটাই বলতে হয়। তবে আমরা মনে করি এখনো বাংলাদেশে ফুসফুসের ক্যান্সারই এক নম্বরে।

ফুসফুস ক্যান্সারের মূল কারণ হিসেবে আপনারা কী কী বিষয় দেখতে পাচ্ছেন?

এক নম্বর কারণ হলো ধূমপান। অন্তত ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে দায়ী ধূমপান। এর পাশাপাশি তামাকের অন্যান্য যেসব ধরন মানুষ গ্রহণ করে যেগুলোকে চুইং টোব্যাকো বলি বা নাকে নস্যি নেয়া এগুলোও ভূমিকা রাখে। গ্রামের অনেক মানুষ গরুর গোবর থেকে ঘুটা বানিয়ে রান্নার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করে, তাছাড়া লাকড়ি ব্যবহার করে রান্না করায় সেখানকার ধোঁয়া অর্থাৎ গৃহস্থালির যে ধোঁয়া সেটাও ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ায় ভূমিকা রাখে। বাতাসের মধ্যেকার দূষণ, ফিটনেস আইন না মানার কারণে প্রচুর গাড়ি রাস্তায় বায়ুদূষণ করে। এর বাইরে বৈশ্বিক অনেক ধরনের প্রভাব আছে যেগুলোতে বায়ুদূষণ হচ্ছে; এটাও একটা কারণ। অতিরিক্ত কার্বনও আমাদের ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার কারণ। র্যাডন নামে একপ্রকার গ্যাস আছে এটাকে আমরা বলি পারমাণবিক ধরনের একটা গ্যাস। গ্যাসটা অনেক বড় বড় পাহাড়ের পাথর বা মাটিতেও থাকে। আমরা বিল্ডিং বানানোয় যে ইট ব্যবহার করি সেগুলো থেকেও কিছু পরিমাণ র্যাডন গ্যাস আমাদের ভেতরে চলে আসে। সেটাও ফুসফুস ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার একটা কারণ। কিছু ফ্যাক্টরি আছে যেমন অ্যাসবেস্টস ফ্যাক্টরিতে যারা কাজ করে বা অ্যাসবেস্টসে তৈরি ঘরের চাল ব্যবহার করে সেখানেও কিছুটা থাকে। আবার যদি এমন হয় যে কোনো কারণে শরীরে রেডিয়েশন দেয়ার সময় ভুল করে সেটা ফুসফুসে পড়ে গেছে। যেমন স্তন ক্যান্সারের জন্য একজন নারীকে যদি রে দেয়া হয় এবং সেটার মার্ক যদি ভুল হয় তবে ১০ বছর পরে সেটা ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।

ফুসফুস ক্যান্সারের রোগীরা সাধারণত কোন পর্যায়ে চিকিৎসার জন্য আসছেন?

আমরা যদি চারটি পর্যায়ে ভাগ করি, তবে আমাদের দেশে তৃতীয় বা চতুর্থ পর্যায়ে থাকা অবস্থায়ই রোগীরা সাধারণত চিকিৎসা নিতে আসে। যেমন আমরা প্রাথমিক অবস্থায় নির্ণয়ের জন্য স্তন ক্যান্সার নিয়ে প্রচারণা চালাচ্ছি সারা দেশে। জরায়ুমুখের ক্যান্সার নিয়ে যদিও এখনো তেমন প্রচারণা হয়নি। ফুসফুসের ক্যান্সারের ধরনটাই এমন যে বোঝা খুব মুশকিল হয়ে যায়। অন্যান্য অনেক রোগের লক্ষণের সঙ্গে ফুসফুসের ক্যান্সারের লক্ষণগুলো মিলে যায়। গ্রামগঞ্জের মানুষ প্রথম প্রথম তেমন একটা গুরুত্ব দেয় না। অনেক সময় আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থায় আসার পরেও সঠিকভাবে ইনভেস্টিগেশন না হওয়ার কারণে ডায়াগনোসিসটা অন্যদিকে চলে যায়। সে কারণে আমি মনে করি, ফুসফুসের ক্যান্সারের ডায়াগনোসিসটা এখন পর্যন্ত দেরিতে আসছে। তৃতীয়-চতুর্থ পর্যায়েই বেশি আসছে। শরীরের অঙ্গভেদে ক্যান্সারের কোনোটা শতভাগ নিরাময়যোগ্য, প্রতিরোধযোগ্য কিন্তু ফুসফুসের ক্যান্সার সে রকম না। ফুসফুসের ক্যান্সারের একটি খারাপ দিক হলো, উন্নত বিশ্বেও খুব বেশি পরিমাণে নিরাময়যোগ্য না, কেননা এটি ধরা পড়ে দেরিতে। চিকিৎসা ব্যবস্থাটাও একটু জটিল। যক্ষ্মা লিভারকোলেসিস, সিওপিডি বলে একটা রোগ আছে এসব একই রকম। ব্রঙ্কাইটিস বা নিউমোনিয়া ধরেও অনেকে আগাতে থাকেন, টিবির ওষুধ খেতে থাকে আট মাস বা নয় মাস। আসলে তার টিবি ছিল না, ছিল ফুসফুস ক্যান্সার। রকমের ঘটনাও বাংলাদেশে আছে। লক্ষণগুলো যেহেতু মিলে যায় তাই আমাদের ক্যান্সারের ডায়াগনোসিসের সিস্টেমে তারা আসতে দেরি করে ফেলে। এগুলোও একটা কারণ আর কি।

ক্যান্সার কি শতভাগ নিরাময় প্রতিরোধযোগ্য?

অন্যান্য ক্যান্সারের অনেকগুলোর ব্যাপারে আমরা যে রকম বলি শতভাগ নিরাময় বা প্রতিরোধযোগ্য এই বিষয়ে তেমনটা বলা যাবে না। ধূমপান যদি পুরোপুরি বন্ধ করতে পারি তাহলে শতকরা ৮০ ভাগ ক্ষেত্রে এটা প্রতিরোধ হয়েই যেত। মানুষের মাঝে স্বাস্থ্যসচেতনতা সার্বিক অর্থে আরো বাড়ানো দরকার। সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন আছে কিন্তু সেটা ঠিকভাবে কার্যকর হচ্ছে না। বর্তমানে যেসব কর্মসূচি সরকারের আছে সেখানে জনসচেতনতাকে খুব সামান্যই গুরুত্ব দেয়া হয়। সরকারের তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল বা অন্য সংস্থাগুলোর কাজ মূলত টেবিল টকের মধ্যেই সীমিত। ব্যাপক আকারে মানুষের কাছে যাওয়া এবং এটা নিয়ে বলা সেটার জন্য আলাদা প্রোগ্রাম খুব একটা দেখি না।

ক্যান্সারের বিষয়ে আগের চেয়ে মানুষের মধ্যে কিছুটা সচেতনতা বাড়লেও রোগী কেন কমছে না?

রোগী বাড়ার অনেক কারণ। ধূমপান থেকে শুরু করে কোনো কিছুই আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারিনি। অপরিকল্পিত নগরায়ণ হচ্ছে। কিন্তু হূদরোগ, ডায়াবেটিস বা ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণের জন্য যেসব ব্যবস্থা আধুনিক নগর পরিকল্পনায় থাকার কথা সেগুলো নেই। নানান কারণে মানুষের জীবনযাত্রায় অনেক পরিবর্তন হচ্ছে। খাবার-দাবারে পরিবর্তন হচ্ছে। পুষ্টিকর খাবার ছেড়ে জাঙ্কফুড বেশি খাওয়া হচ্ছে, সেগুলোও ক্যান্সারের হার বাড়িয়ে দিচ্ছে। সচেতনতার কথা অনেকে জানেন কিন্তু মানেন না। তাদের উদ্বুদ্ধ করতে ব্যর্থ হয়েছি আমরা। বিরাট অংশই সচেতনতার বাইরে রয়ে গেছে। জাতীয় ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি লাগবে, জাতীয় ক্যান্সার নিবন্ধন লাগবে। জাতীয় স্ক্রিনিং প্রোগ্রাম নেই, সেটাও করতে হবে। ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণ কাউন্সিলকে কার্যকর করতে হবে। ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সুযোগ-সুবিধা নিয়মের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে।  

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন