সময়ের ভাবনা

আইএমএফের ঋণ: শর্ত নাকি লক্ষ্য

শাইয়ান সাদিক ইশতি

করোনা-পরবর্তী বিশ্বে যখন পূর্ণোদ্যমে অর্থনীতির চাকা সচল করার জন্য রাষ্ট্রগুলো দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করছে, তখনই রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এক অস্থিতিশীল ডলার সংকটের সূচনা করে। প্রভাব পড়ে বিভিন্ন দেশের সামগ্রিক অর্থনীতিতে। বাংলাদেশের পাশের দেশ শ্রীলংকার টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকটাই বাংলাদেশকে এক অশনি সংকেত দেয়। ফলস্বরূপ অতীতের মতো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দ্বারস্থ হয় সরকার। সম্প্রতি তারই জের ধরে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে বাংলাদেশ ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে, যা শর্তসাপেক্ষে প্রাথমিকভাবে অনুমোদিত হয়েছে, কিন্তু শর্তগুলো জন্ম দিয়েছে নানা মতের। যদিও বাংলাদেশকে এর আগেও অনেকবার ঋণসহায়তা দিয়েছে আইএমএফ। ১৯৭৪ সালে প্রথমবার ঋণসহায়তা পায় বাংলাদেশ। আইএমএফের ওয়েবসাইটে দেয়া তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ঋণের জন্য সংস্থাটির কাছে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি গিয়েছে ১৯৮০ থেকে ১৯৯০ সালে, যে সময় আইএমএফের কাছ থেকে পাঁচবার অর্থ ধার করা হয়েছে। প্রতিবারই নানা রকম সংস্কারের কথা উল্লেখ থাকলেও সব সংস্কার বাস্তবায়ন হয়নি। যদিও অনেক অর্থনীতিবিদের মতামত, সংস্কারগুলো একটি তৃতীয় বিশ্বের দেশের জন্য ইতিবাচক কিন্তু বাস্তবতার নিরিখে সব সময়মতো বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। প্রাথমিকভাবে আরোপিত শর্তগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, রাজস্ব খাতে অটোমেশন চালু, আর্থিক খাতে ঋণ আমানতের সুদের হারের ওপর আরোপিত ক্যাপ তুলে নেয়া, জ্বালানি তেলের দাম সমন্বয়ে একটি ফর্মুলায় এনে তা ঘোষণা করা, সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিকে বাজেট থেকে আলাদা করা, কৃষিতে ভর্তুকির পরিমাণ কমানো, জলবায়ু পরিবর্তনে পদক্ষেপ তহবিল বরাদ্দে সংস্কার কার্যক্রম এবং খেলাপি ঋণ আদায়ে পরিকল্পিত মনিটরিং ব্যবস্থা আইনের প্রয়োগ ঘটানো ইত্যাদি। মোট সাত কিস্তিতে বাংলাদেশকে ঋণ দেয়া হবে। ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সুদ হার নির্ধারিত হবে বাজারদর অনুযায়ী, যা গড়ে দশমিক শতাংশ হবে। আগামী তিন মাসের মধ্যে আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত হবে।

রাজস্ব খাতে বাংলাদেশের অটোমেশন পদ্ধতি চালুর নানা রকম পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) পক্ষ থেকে। তবু দেখা যায়, দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে সর্বনিম্ন কর জিডিপি বাংলাদেশের। কর জিডিপি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আয়করের ক্যাপাসিটি বিল্ডিংয়ের বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যার সঙ্গে যুক্ত হবে -রিটার্ন থেকে শুরু করে -পেমেন্ট, অ্যাসেসমেন্ট সিস্টেমসহ বিভিন্ন বিষয়। ডিজিটাল ব্যবস্থার মানোন্নয়নের পাশাপাশি ব্যাপক ভিত্তিতে অটোমেশন রাজস্ব আহরণের উদ্দেশ্যে অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ডাটা ইন্টিগ্রেশনসহ নানা উপায়ে ভ্যাট, কাস্টমস আয়কর থেকে সর্বোচ্চ রাজস্ব আদায়ের বিষয়গুলো নতুন আঙ্গিকেই ভাবা উচিত। আইএমএফের ঋণের প্রয়োজন হলেও দেশের রাজস্ব খাতের সংস্কার এবং বাস্তবায়ন শুধু কাগজে-কলমে না থাকে সে বিষয়ে উদ্যোগ গ্রহণ এখন সময়ের দাবি। শর্তকে বরং ইতিবাচক হিসেবেই নেয়া শ্রেয়। এক্ষেত্রে এনবিআরের নেয়া পাঁচ কৌশল দেশের শপিং মলগুলো থেকে শুরু করে রেস্তোরাঁ পর্যন্ত সব ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে ইএফডি বাধ্যতামূলক ব্যবহার অন্তর্ভুক্ত করা, আয়করের আওতা সম্প্রসারণ, মূল্যসংযোজন কর (মূসক) বা ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন, বন্ডেড ওয়্যার হাউজগুলোর অটোমেশন এবং করবহির্ভূত রাজস্ব বাড়ানোর পুঙ্খানুপুঙ্খ যাচাই প্রায়োগিক ব্যবহার নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

বিভিন্ন খাতে ভর্তুকি কমানোর বিষয়টি যদিও আপাতদৃষ্টিতে জ্বালানি খাতে একটি নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে কিন্তু আসন্ন জলবায়ু সংকট মোকাবেলায় জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সরে এসে নবায়নযোগ্য শক্তিকে বেশি প্রাধান্য দেয়ার ক্ষেত্রে পরোক্ষ প্রণোদনা হিসেবে কাজ করছে। তবে তিন দফায় জ্বালানি তেলের দাম নির্ধারণ হওয়ায় বেশ দুর্ভোগের শিকার হচ্ছে জনগণ। এক্ষেত্রে ভর্তুকি পুরোপুরি উঠিয়ে না দিয়ে কমিয়ে দেয়ার পক্ষে একদল বিশেষজ্ঞ। এছাড়া গ্যাস এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। জ্বালানি তেলের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে পিরিয়ডিক্যাল এডজাস্টমেন্ট (মেয়াদি বা অস্থায়ী সমন্বয়) করার শর্তও বাস্তবায়ন করতে চায় সরকার। আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেলের দাম ওঠানামার সঙ্গে মিল রেখে নির্দিষ্ট সময় পরপর সমন্বয় করতে হয়, যা অনেকদিন ধরেই ভারত করে আসছে। তবে জনগণের দুর্ভোগ এবং আইএমএফের শর্তের দোলাচলে সরকার একটু মধ্যপন্থী উপায়ে এগিয়ে যেতে পারে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় ক্যাপাসিটি পেমেন্টের পরিমাণ প্রতি বছরই বাড়ছে। বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র এফএসআরইউর মালিকদের সঙ্গে স্বাক্ষরিত চুক্তির গুণমান নিয়ে প্রশ্ন তোলা স্বাভাবিক। বিপুল পরিমাণ অর্থ এখানে না দিয়ে ভর্তুকি কমিয়েও জ্বালানির দাম নির্ধারণ করা যেতে পারে। এছাড়া জলবায়ু তহবিলকে ক্লিন এনার্জির সঠিক বাস্তবানের ক্ষেত্রে নানা কর্মসূচি প্রকল্পের মাধ্যমে কাজে লাগানো যেতে পারে। এক্ষেত্রে লাভ দুই পক্ষেরই। তবে সম্ভাব্য খাদ্য সংকট মোকাবেলায় সার বা কৃষি ক্ষেত্রে ভর্তুকি হ্রাস অনেকটাই ভুল সিদ্ধান্ত হবে।

ঋণের কিস্তি সময়মতো পরিশোধ না করা হলে নব্বই দিনের মধ্যে খেলাপি হওয়ার জন্য আইএমএফের প্রস্তাব বাস্তবায়নযোগ্য না বলে ব্যাংকাররা মনে করছেন। তদুপরি তারা অন্যান্য ঋণের মতো কৃষি এসএমই খাতে স্বল্প সময়ের মধ্যে খেলাপি হওয়ার বিষয়ে আপত্তি জানিয়েছে। কারণ সংকট মোকাবেলায় কৃষি খাতে বাড়তি সুবিধা দেয়া দরকার, যা প্রান্তিক কৃষকের করোনা-পরবর্তী অবস্থা মোকাবেলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। আইএমএফের শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশের নন-পারফর্মিং লোন কমানোর জন্য বাসেল- সেটের দিকে যাওয়াটা জরুরি, যা ব্যাংক সেক্টরে নিয়ন্ত্রণ, তত্ত্বাবধান এবং ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নতির উদ্দেশ্যে নির্ধারিত সংস্কার ব্যবস্থার একটি সেট। তবে ব্যাংক বিশেষজ্ঞদের মতে, খেলাপি ঋণ পুনরুদ্ধারের ক্ষেত্রে আইনের সংস্কার জরুরি। তার সঙ্গে পুরনো ঋণ ফেরত পাওয়ার জন্য স্পেশাল ইকোনমিক জোন তৈরি করে বিভিন্ন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানকে ক্ল্যাসিফায়েড প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে ঋণ ফেরত পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে, পাশাপাশি অর্থনীতির চাকাও সচল হবে।

আর্থিক খাতের সংস্কারের জন্য নতুন আইনের প্রণয়ন এবং পুরনো আইনের সংস্কার প্রয়োজন। এছাড়া মুদ্রানীতির ক্ষেত্রে বিনিময়ের বিষয়টি নমনীয় করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের কাজের ওপর ছয় মাস পরপর তদারকি করা হবে, যা সঠিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে বলে ধারণা।

বর্তমানে বিশ্বজুড়ে চলছে অর্থনৈতিক মন্দার আভাস। যার প্রভাব থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। আইএমএফের দেয়া ঋণ মুহূর্তে বাংলাদেশের গ্রহণ যুক্তিযুক্ত। কারণ তার ফলে আসন্ন সংকট মোকাবেলা অনেকটা সহজতর হবে। কিন্তু এটাও ভাবা উচিত এত বড় ঋণের ক্ষেত্রে আইএমএফের শর্তগুলো আসলেই কোনো ইতিবাচক পরিবর্তনের আভাস কিনা। মোটা দাগে আলোচনা করলে বলা যায় আইএমএফ এক ধরনের সংস্কার চায়, যা অনেক আগে থেকেই বাংলাদেশ সরকার কাগজে-কলমে করার চেষ্টা করছে। কিন্তু দূরদর্শিতার অভাব এবং নীতির প্রয়োগ না হওয়ায় বাস্তবায়নের চিত্র ছিল ভিন্ন। এক্ষেত্রে শর্তগুলোকে শর্ত না ভেবে সামনে এগিয়ে যাওয়ার লক্ষ্য হিসেবে নির্ধারণ করলে বরং তা বাস্তবায়নে রূপ নেবে। এটাও সত্য যে কিছু শর্ত বর্তমান পরিস্থিতে বাস্তবায়ন সমীচীন নয়। কিন্তু সেই বার্গেইন পাওয়ার অর্জন করতে হলে সরকারকে দেশের মুদ্রানীতি থেকে শুরু করে লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ককে পরিকল্পিতভাবে সংস্কার করতে হবে। প্রত্যেকটি ধাপকে ধরে নিতে হবে নির্ধারিত সময় এবং সে অনুযায়ী করতে হবে পরিকল্পনার বাস্তবায়ন।

 

শাইয়ান সাদিক ইশতি: রিসার্চ অ্যাসোসিয়েট

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন