দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে দুর্বল কর ভিত্তি বাংলাদেশের

টেকসই অর্থনৈতিক উত্তরণের অন্তরায়

নব্বইয়ের দশক থেকে দ্রুত বড় হচ্ছে অর্থনীতি। কিন্তু তাল মিলিয়ে বাড়ছে না কর-জিডিপি অনুপাত, যা দুশ্চিন্তারও বিষয়। দেশের কর ভিত্তিও দুর্বল। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দক্ষিণ এশিয়ায় করযোগ্য ব্যক্তি সংখ্যার বিপরীতে রিটার্নদাতার হারে সবচেয়ে পিছিয়ে বাংলাদেশ। পরোক্ষ করই রয়ে গিয়েছে রাজস্ব কাঠামোর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে। অর্থনীতির সঙ্গে রাজস্ব আহরণের সামঞ্জস্য না থাকায় বাজেট বাস্তবায়নেও সরকারকে নির্ভর করতে হচ্ছে দেশী-বিদেশী ঋণের ওপর। এতে নানা ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে, যা প্রশমনে বিশেষজ্ঞরা কর-জিডিপি হার বাড়ানোর তাগিদ দিয়ে আসছেন। এক্ষেত্রে করজালের আওতা সম্প্রসারণ করতে হবে। বাংলাদেশের কর-জিডিপির অনুপাত -১০ শতাংশের মধ্যে ঘোরাফেরা করছে দীর্ঘদিন। এর মানে এখনো জিডিপির হিস্যা অনুযায়ী অর্জিতব্য কর অনাহরিত থেকে যাচ্ছে। বাংলাদেশে ২০২৬ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে যোগদান করবে, লক্ষ্য ২০৪১ সালের মধ্যে উচ্চ আয়ের দেশে পরিণত হওয়া। কিন্তু নিম্ন কর-জিডিপি অনুপাত রেখে এটি অর্জন সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে রাজস্ব আহরণ বাড়াতে কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন তা বাস্তবায়ন জরুরি। রাজস্বভিত্তি বাড়াতে হলে এতে প্রয়োজনীয় সংস্কারও আনতে হবে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকেই এক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতে হবে।  

উন্নত বিশ্বের দেশগুলোয় কর-জিডিপির গড় অনুপাত ৩৬ শতাংশের মতো। উদীয়মান এশীয় দেশগুলোর অনুপাতও গড়ে প্রায় ২৭ শতাংশ এবং আসিয়ানভুক্ত দেশগুলোর গড় অনুপাত সাড়ে ১৮ শতাংশ। এমনকি সাব-সাহারাখ্যাত আফ্রিকার দেশগুলোর কর-জিডিপির গড় অনুপাত প্রায় ১৮ শতাংশ। বিশ্বব্যাংকের তথ্য বলছে, দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি কর-জিডিপি অনুপাত নেপালের, প্রায় ১৯ শতাংশ। এরপর ভুটানের ১৬ শতাংশ। ভারতের ১২, শ্রীলংকার ১১ দশমিক , পাকিস্তানের ১১, আফগানিস্তানের দশমিক এবং মালদ্বীপের দশমিক শতাংশ। অথচ বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত মাত্র শতাংশের ঘরে। উল্লিখিত দেশগুলোয় রাজস্ব আহরণে অগ্রগতির মূলে কাজ করছে আধুনিক, সহজ নির্বিঘ্ন কর ব্যবস্থা, দক্ষ রাজস্ব ব্যবস্থাপনা, স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতা এবং সর্বোপরি একটি সহায়ক রাজস্ব সংস্কৃতি। সুতরাং তাদের নীতি, পদক্ষেপ, রাজস্ব সংস্কৃতি নিয়ে আরো গবেষণা প্রয়োজন। লেনদেনে অটোমেশন বাড়াতে নগদ লেনদেন কমাতে হবে। চেকের মাধ্যমে লেনদেন বাড়াতে হবে। নগদ লেনদেন হলেই ফাঁকি দেয়ার সুযোগ তৈরি হয়। নগদ লেনদেন অনেক দেশই কমিয়ে দিয়েছে, বাংলাদেশেরও কমাতে হবে।

ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ভিয়েতনাম কর আহরণ এবং রাজস্ব ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে যাচ্ছে। এটা সম্ভব হয়েছে সেসব দেশে প্রয়োজনীয় সংস্কার উদ্যোগের দ্রুত বাস্তবায়নের কারণে। যেমন ভারত ১৯৬১ সালে, মালয়েশিয়া ১৯৬৭ সালে ঔপনিবেশিক আমলের আয়কর আইন যুগোপযোগী করে। ভিয়েতনাম ইন্দোনেশিয়া কয়েক বছর পরপর তাদের আয়কর আইন রীতিমতো ঢেলে সাজায়। একই সমতলে অবস্থানরত কমনওয়েলথ সদস্য দেশ বাংলাদেশে আয়কর আইনের আধুনিকতম সংস্করণ ১৯৮৪ সালে, তাও অর্ডিন্যান্স আকারে। তা যুগোপযোগী করতে, আইন আকারে পাস প্রবর্তনের চেষ্টা চলছে দেড় যুগ ধরে। বাংলাদেশ ভারতের কর ব্যবস্থা, সুবিধা, ফরম্যাট মূলত একই। তবে একটা বড় প্রশাসনিক পার্থক্য হলো এনবিআর, পরোক্ষ প্রত্যক্ষ কর এক মন্ত্রণালয় এবং একজন প্রশাসনিক চেয়ারম্যানের অধীনে। ভারতে তা নয়, সেখানে পরোক্ষ প্রত্যক্ষ করের প্রশাসন আলাদা। ভারতে প্রত্যক্ষ কর (আয়কর) অর্থ মন্ত্রণালয়ের এবং পরোক্ষ কর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। আবার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থেকেও ভারতের কর বিভাগ বাস্তবায়নকারী হিসেবে স্বশাসিত। কেন্দ্রের অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে পলিসি প্রেসক্রিপশন থ্রেসহোল্ড দেয়ার ব্যাপারে তাদের নিয়ন্ত্রণ এবং একটা শক্তিশালী অবস্থান যেমন আছে, তেমনি রাজ্য পর্যায়ে আছে স্থানীয় কর আইন ব্যবস্থাপনার সমান্তরাল প্রণয়ন এবং প্রয়োগের সুযোগ।

হিসাব সংরক্ষণ রাজস্ব ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ভারতের একটা দীর্ঘ ঐতিহ্য আছে। বাংলাদেশেরও আছে, কিন্তু হিসাব পদ্ধতি, কোম্পানির আইন সব মিলিয়ে দেশগুলোয় একটা টেকসই সংস্কৃতি গড়ে উঠলেও সে সড়কে বাংলাদেশের ওঠার প্রয়াস প্রলম্বিত হচ্ছে। বাংলাদেশে নীতি প্রণয়ন বাস্তবায়ন এক হাতে হয়। তাই এখানে ডিসক্রিয়েশনারি পাওয়ার প্রয়োগের ক্ষেত্রে নীতিগত বিষয়গুলো অনেক জটিল, স্বেচ্ছা ব্যাখ্যা আচারি নিবর্তনমূলক হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে আইনের ব্যাখ্যা ধোঁয়াশা হয়ে যায়। ভারত, ভিয়েতনাম মালয়েশিয়ায় ওই সমস্যা তেমন একটা নেই। তারা অনেকটা স্বচ্ছ সংহত একটা আধুনিক ব্যবস্থার দিকে এগিয়েছে। ভারতে পরোক্ষ কর ব্যবস্থাপনা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে। কিন্তু বাংলাদেশে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এনবিআরের মধ্যে মতামতের রশি টানাটানিতে শুল্ক আহরণ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জটিলতা ভারতে নেই, নেই মালয়েশিয়া ইন্দোনেশিয়ায়, ভিয়েতনামের পরিস্থিতি আরো স্বচ্ছ সাবলীল। ভারতে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ই আমদানি-রফতানি বিধির আলোকে শুল্ক-করাদি আরোপ করে। ভারত, ভিয়েতনাম, মালয়েশিয়ায় শুল্কায়ন সিদ্ধান্তদানকারী টায়ার বা লেয়ার অনেক কম। অধিকাংশ দেশে ট্যারিফ কমিশন শুল্কারোপ থেকে শুরু করে সবকিছু দেখে। বাংলাদেশের ট্যারিফ কমিশনের সঙ্গে এনবিআরের যোগাযোগ নেই। গণশুনানি করে ট্যারিফ কমিশন, কিন্তু শুল্কারোপ করে এনবিআর। জটিলতা নিরসনে সংস্কারের কথা বলা হলেও তাতে খুব একটা অগ্রগতি নেই।

সরকার বলছে, উচ্চ মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে হলে কর-জিডিপি অনুপাত ১৫ শতাংশে উন্নীত করতে হবে। অথচ উল্টো প্রবণতা হচ্ছে, করোনার কারণে সেটি বরং আগের চেয়ে কমছে। এটা আশঙ্কাজনক। অবস্থায় কর ফাঁকি রোধ করতে হবে। এজন্য এনবিআরের অটোমেশনে গতি আনা খুব জরুরি। এটা কেবল কর ফাঁকি ধরতে সাহায্য করবে না, উপরন্তু নতুন ক্ষেত্র খুঁজে বের করা এবং এনবিআর ডাটাবেজের সঙ্গে কর প্রদানকারীর ব্যাংক হিসাবের যোগাযোগ তৈরিতে সহায়তা করবে। সংস্থাটি এরই মধ্যে অবশ্য কিছু সার্ভিস সেন্টার খুলেছে। ব্যাপারে করদাতাদের ওয়াকিবহাল করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজস্ব বিভাগে কর গোয়েন্দা সেলকেও আরো সক্ষম কার্যকর করা চাই। বিশ্বায়নের যুগে ট্রান্সফার প্রাইসিং সেলকে অনেক শক্তিশালী করতে হবে, প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে। কর-জিডিপি বাড়াতে এবারের বাজেটে কয়েকটি বিশেষ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে, সুযোগ যেমন দেয়া হয়েছে, তেমনি রিটার্ন জমা না দিলে সেবা বঞ্চিত করার বিষয়ও রয়েছে। উদ্যোগগুলোর সফল বাস্তবায়নই কাম্য। এনবিআর পেশাদারত্বের সঙ্গে কাজ করলে জনগণ ব্যবসায়ীদের সঠিকভাবে উদ্বুদ্ধকরণ এবং নৈতিক দায়িত্ব বৃদ্ধির মাধ্যমে লক্ষ্য অর্জন কিন্তু কঠিন নয়। করজাল বৃদ্ধি, কর সংগ্রহের গতি আনয়ন, সব জেলা উপজেলায় রাজস্ব অফিস স্থাপন এবং কর জরিপ পরিচালনায় প্রশাসনিক সংস্কারের বিকল্প নেই। দেশের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাপক বৃদ্ধি পেলেও ২০১১ সালের পর রাজস্ব প্রশাসনে আর কোনো সংস্কার হয়নি। জনবল অফিসসংখ্যা বৃদ্ধি তথা প্রশাসনিক সংস্কারে কয়েক বছর আগে প্রস্তাব প্রণীত হলেও প্রস্তাব সরকারের অনুমোদনের জন্য এখনো অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে পাঠানো সম্ভব হয়নি। ফলে কাঙ্ক্ষিত সংস্কার বিলম্বিত হচ্ছে।

রাজস্ব আহরণ বাড়াতে এনবিআরের চেয়ারম্যান আরো কঠোর হওয়ার জন্য মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। এছাড়া করদাতাদের হয়রানি না করে তাদের কাছ থেকে সহজে কর আহরণের নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। মাসভিত্তিক রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য নির্ধারণ কর্মকৌশল নির্ধারণের তাগিদ দেয়া হয়েছে। বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে অভ্যন্তরীণ খাত বিশেষ করে এনবিআরের শুল্ক-কর আয় বাড়ানোর প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এনবিআর করের আওতা বাড়ানোসহ নানা পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। তবে এসব পরিকল্পনা খুবই শ্লথগতির। বিনিয়োগ বাড়াতে পারলেই কেবল পরিকল্পনা বাস্তবায়ন সম্ভব। রাজস্ব আয় বাড়ানো এর শর্ত। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে দরকার করবান্ধব পরিবেশ সৃষ্টি। সেখানে রাজস্ব প্রদানে সেবা নিশ্চিত, অনুকূল রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং আইন-কানুন সময়োপযোগী করা গুরুত্ব পাবে। পরিকল্পনাজনিত সমস্যা তো রয়েছেই, সঙ্গে রয়েছে প্রাতিষ্ঠানিক নানা জটিলতা। আছে দুর্নীতির অভিযোগও। এসব বিষয়ে সরকারকে আরো জোরালো ভূমিকা নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন