নির্বাচনের আগে কোনো সংলাপে না বসার ইঙ্গিত প্রধানমন্ত্রীর

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল ভিডিও কনফারেন্সিংয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রামের পতেঙ্গায় বঙ্গবন্ধু টানেলের পূর্তকাজ সমাপ্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন ছবি: পিআইডি

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে কোনো সংলাপে না বসার ইঙ্গিত দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গতকাল মহিলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন উদ্বোধন করে তিনি বলেছেন, অনেকেই বলেন ডায়ালগ (সংলাপ) করতে হবে, আলোচনা করতে হবে। কিন্তু কাদের সঙ্গে; ওই বিএনপি, খালেদা জিয়া, তারেক জিয়াযারা গ্রেনেড হামলা করে আমাকে হত্যার চেষ্টা করেছে, তাদের সঙ্গে? যারা অর্থ পাচারকারী, খুনি, সন্ত্রাসী, জঙ্গিবাদের সঙ্গে জড়িত; এতিমদের অর্থ আত্মসাৎ করে দণ্ডিত আসামি, তাদের সঙ্গে সংলাপ করতে হবে, সেটা আবার কেমন কথা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র রয়েছে, নির্বাচন কমিশন আছে। যাদের ইচ্ছা নির্বাচন করবে। আর নির্বাচন করার মতো শক্তি যদি কারো না থাকে, তারা হয়তো করবে না। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন করবে, তারা ভোট দেবে। আর ভোট চুরি তারা মেনে নেয় না। খালেদা জিয়া ভোট চুরি করেছিল ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। বাংলাদেশের জনগণ আন্দোলন করে মাত্র দেড় মাসের মাথায়, ৩০ মার্চ তাকে টেনে ক্ষমতা থেকে নামায়। ভোট চুরির অপরাধে খালেদা জিয়া পদত্যাগে বাধ্য হয়। কাজেই ভোট চোররাই কেবল ভোট চুরি করতে জানে।

শেখ হাসিনা বলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশকে মধ্যম আয়ের দেশের মর্যাদা এনে দিয়েছে। সব সেক্টরে উন্নয়ন করেছে। কিন্তু বিএনপি দিয়েছে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ, অর্থ পাচার, মানি লন্ডারিং। এই খুনি সন্ত্রাসী এবং যুদ্ধাপরাধীরা আবার ক্ষমতায় এসে ত্রাসের রাজত্ব করবে, তা আর জনগণ চায় না। আওয়ামী লীগই একমাত্র দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেছে। পরপর আমরা তিনবার ক্ষমতায় এসেছি। আজকে গণতান্ত্রিক ধারা অব্যাহত আছে বলেই বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে।

নারীর অবদান তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, দেশের সব অঙ্গনে নারীর অবদান রয়েছে। দেশের অগ্রযাত্রায়ও তাদের ভূমিকা রাখতে হবে। গণতন্ত্র অব্যাহত রাখতে এবং দেশকে উন্নত করে গড়ে তুলতে তাদের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সাংস্কৃতিক অধিকার প্রয়োগ করতে হবে। আমাদের সরকার নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করে।

শেখ হাসিনা বলেন, খালেদা জিয়া বলেছিলশেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী তো দূরের কথা বিরোধী দলের নেতাও কোনোদিন হবে না। হতে পারবে না। আর আওয়ামী লীগ ১০০ বছরেও ক্ষমতায় যাবে না। খালেদা জিয়ার মুখের কথা তার বেলায় লেগে গিয়েছে।

একই দিন চট্টগ্রামে কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্তকাজের সমাপ্তি উদযাপন অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি অংশ নেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, জাতিসংঘ ঘোষিত সাসটেইনেবল ডেভেলপমেন্ট গোল মাথায় রেখে কাজ করছে সরকার। এছাড়া ২০১০ থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করা হয়েছে। ২০২১ থেকে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং অষ্টম পঞ্চবার্ষিকীর মাধ্যমে তা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। উন্নয়নের পথে এক যুগ ধরে বাংলাদেশের যে যাত্রা চলছে, তা কেউ থামাতে পারবে না।

অনুষ্ঠানে গণভবন প্রান্ত থেকে সড়ক পরিবহন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম এবং চট্টগ্রামের পতেঙ্গা প্রান্ত থেকে সেতু বিভাগের সচিব মনজুর হোসেন, বাংলাদেশে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত লি জিমিং বক্তব্য দেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের উন্নয়ন অনেকের চোখে পড়ে না, তাদের হয়তো চোখ নষ্ট। যদি চোখ নষ্ট হয়, চোখের ডাক্তার দেখাতে পারেন। আমরা খুব ভালো আই ইনস্টিটিউট করে দিয়েছি, সেখানে চোখ পরীক্ষা করালে আমার মনে হয় তারা হয়তো দেখতে পাবেন। আর কেউ যদি চোখ থাকতে অন্ধ হয়, তাহলে আমাদের কিছু করার নেই। আমি মনে করি, আমাদের কিছু লোক চোখ থাকতেও অন্ধ। তারা দেখেও না দেখার ভান করে। কারণ নিজেরা কিছু করতে পারেনি। ভবিষ্যতেও কিছু করতে পারবে না।

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ করোনা-পরবর্তী বিশ্ব অর্থনীতিতে মন্দার পরিপ্রেক্ষিতে দেশবাসীকে সঞ্চয়ী হতে পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, বিদ্যুৎ, পানি, জ্বালানি সব ক্ষেত্রেই নিজেদের সাশ্রয়ী হতে হবে। একদিকে করোনার জন্য মন্দা, অন্যদিকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আর নিষেধাজ্ঞা। প্রতিটি জিনিসের দাম আন্তর্জাতিক বাজারে অনেকাংশে বেড়ে গিয়েছে। মূল্যস্ফীতি এখন গোটা বিশ্বের জন্য বড় সমস্যা। এর ধাক্কা থেকে আমরাও দূরে থাকতে পারব না। তবে এত কিছুর পরও আমরা অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছি। নিজেদের সঞ্চয় বাড়ান, মিতব্যয়ী হোন। তাহলেই মন্দায় আমরা পড়ব না।

সরকারপ্রধান বলেন, নভেল করোনাভাইরাসের সময় সারা বিশ্বেই অর্থনৈতিক মন্দা। উন্নত দেশগুলোও হিমশিম খাচ্ছে। অনেকেই নিজেদের দেশেও অর্থনৈতিক মন্দার ঘোষণা দিয়েছে। আমরা এখনো সে অবস্থায় পড়িনি। আমরা নিজেদের সম্পদ ব্যবহারের সক্ষমতা রাখি এবং আমরা সেটা করছি। আমরা দেশবাসীকে আহ্বান করেছি, যার যেখানে যতটুকু জমি আছে, যে যা পারেন উৎপাদন বৃদ্ধি করেন। নিজেদের খাদ্য নিজেরা উৎপাদন করবেন, পরের কাছে হাত পেতে আমরা চলব না।

সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের উত্তর টিউবের নির্মাণকাজ শিগগিরই শেষ হবে বলে আশা প্রকাশ করেন প্রধানমন্ত্রী। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেল নিয়ে তৈরি একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শন করা হয়। ২০১১ সালে সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর ২০১৪ সালে সমঝোতা চুক্তি ২০১৫ সালের ৩০ জুন টানেল নির্মাণে ঋণচুক্তি স্বাক্ষর হয়। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগের পর ২০১৭ সালের ডিসেম্বর পূর্তকাজ আরম্ভ হয়। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি পতেঙ্গা থেকে আনোয়ারামুখী প্রথম বা উত্তর সুড়ঙ্গের খননকাজ (বোরিং) উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। হাজার ৪৪৬ মিটার দীর্ঘ সুড়ঙ্গের খননকাজ শেষ হয় ২০২০ সালের আগস্ট। দ্বিতীয় বা দক্ষিণ সুড়ঙ্গের (আনোয়ারা থেকে পতেঙ্গামুখী) খননকাজ শুরু হয়েছিল ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর। গত বছরের অক্টোবর কাজ শেষ হয়। আর দুটি সুড়ঙ্গের মধ্যে তিনটি ক্রস প্যাসেজ বা সংযোগপথের কাজ, অ্যাপ্রোচ সড়ক, ভায়াডাক্টসহ কার্পেটিং, পেইন্টিং, কেবল ওয়্যারিং, সার্ভিস এরিয়ার নির্মাণকাজ শেষ পর্যায়ে রয়েছে। উত্তর সুড়ঙ্গের বাকি কাজ শেষ করে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে টানেলটি যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করার পরিকল্পনা নিয়ে কাজ করছে সরকার।

দেশের প্রথম টানেলের নামকরণ হয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামে। সেতু কর্তৃপক্ষের অধীনে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ করছে চায়না কমিউনিকেশনস কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেড। টানেল নির্মাণের প্রধান যন্ত্র টিবিএম মেশিন, টিউবের সেগমেন্টসহ প্রায় ৯০ শতাংশ উপকরণই চীন থেকে আমদানি করা হয়েছে।

২৫ নভেম্বর পর্যন্ত প্রকল্পের সার্বিক অগ্রগতি হয়েছে ৯৫ শতাংশ। ব্যয় হয়েছে হাজার ৪৩১ কোটি টাকা। মূল টানেলের বাইরে দুই প্রান্তের সংযোগ সড়কের কাজ সম্পন্ন করেছে দেশীয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সার্ভিস এরিয়ার কাজও শেষ পর্যায়ে রয়েছে। উভয় টিউবসহ মোট দশমিক ৩৫০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের টানেলটি নির্মাণে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে বেশকিছু কাজ চলমান রয়েছে। উদ্বোধনের আগে এসব কাজ শেষ করার চেষ্টা করছে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর, সড়ক জনপথ (সওজ) বিভাগ।

প্রকল্প সূত্র জানায়, মূল টানেলের দৈর্ঘ্য দশমিক ৩২ কিলোমিটার। এর মধ্যে টানেলের প্রতিটি সুড়ঙ্গের দৈর্ঘ্য দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। দুই সুড়ঙ্গে দুটি করে মোট চারটি লেন রয়েছে। আনোয়ারা প্রান্তে রয়েছে ৭২৭ মিটার দীর্ঘ উড়ালসড়ক। কর্ণফুলী নদীর তলদেশ (রিভার বেড) থেকে সর্বোচ্চ ৩৬ মিটার পর্যন্ত গভীরতায় গিয়ে টানেল অন্য প্রান্তে পৌঁছেছে। প্রতিটি সুড়ঙ্গ ৩৫ ফুট প্রশস্ত ১৬ ফুট উচ্চতার। টানেল নির্মাণে ব্যয় হচ্ছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে দাতা সংস্থার ঋণ বাদ দিয়ে হাজার ৪৬১ কোটি ২৩ লাখ টাকা ব্যয় করবে বাংলাদেশ সরকার। টানেলটির নির্মাণকাজ শেষ হলে দেশের জিডিপিতে শূন্য দশমিক ১৬৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হবে বলে আশা করছে সরকার।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন