ইউজিসির সিদ্ধান্ত গবেষণায় ন্যূনতম ২ শতাংশ ব্যয় করতে হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে

যথাযথভাবে অনুসরণে তদারকিও বাড়াতে হবে

উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাথমিক লক্ষ্য গবেষণা করা। গবেষণার মাধ্যমে নতুন জ্ঞানের সৃষ্টি শাখার উদ্ভাবন। উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা, তত্ত্ব উদ্ভাবন করেন এবং জাতিকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের উচ্চশিখরে আসীন করার কথা। অথচ অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ই লক্ষ্য পূরণ করতে পারছে না। বিশ্ববিদ্যালয় আইনে গবেষণা বাধ্যতামূলক করা হলেও তা মানছে না বেশির ভাগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এমন পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) সিদ্ধান্ত নিয়েছে গবেষণায় ন্যূনতম শতাংশ ব্যয় করতে হবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়কে। উচ্চশিক্ষায় এগিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় জ্ঞানচর্চার অনুকূল পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগ দিতে হবে। গবেষণা ছাড়া এমন পরিবেশ সম্ভব নয়। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কাঙ্ক্ষিত মানের গবেষণার জন্য সরকারকে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ দিতে হবে। আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাধ্য করতে হবে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ খরচ করতে, যাতে মেধাবীরা গবেষণার জন্য বিদেশে গিয়ে পড়াশোনা শেষে ফের দেশে এসে দেশীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে কাজ করতে আগ্রহী হন। এজন্য প্রয়োজন তাদের সুযোগ-সুবিধা দিয়ে দেশে রাখার উদ্যোগ নেয়া। ইউজিসিকেও গবেষণার বিষয়ে কঠোর নজরদারি করতে হবে, যাতে কেউ গবেষণা কার্যক্রমে উদাসীন থাকার অবকাশ না পায়।

বর্তমান বিশ্ব হচ্ছে জ্ঞানভিত্তিক। মানসম্পন্ন শিক্ষার মাধ্যমে প্রকৃত কার্যকর জ্ঞান অর্জন করতে হয়। যারা যত বেশি প্রায়োগিক জ্ঞান অর্জন করতে পারে; তারাই প্রতিযোগিতামূলক সমকালীন বিশ্বে টিকে থাকার যোগ্যতা অর্জন করে। ফলে দেশে দেশে উচ্চশিক্ষা অর্থাৎ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সক্ষমতা মানোন্নয়নে জোর দেয়া হচ্ছে। কিন্তু আমাদের দেশের বাস্তবতা হতাশাজনক। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় কাঙ্ক্ষিত মানের গবেষণা কার্যক্রম না থাকায় সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্বে বাংলাদেশ পিছিয়ে পড়ছে। দেশে দক্ষ জনশক্তি গড়ে উঠছে না। শিক্ষিতরা দেশের বাইরে গিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকতে পারছেন না। অথচ দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ গবেষণা এগিয়ে নিয়ে নিজেদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে কাঙ্ক্ষিত মানে নিয়ে যাচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল কাজ হলো গবেষণা। কিন্তু দেশের সরকারি-বেসরকারি উভয় ধরনের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীর গবেষণায় খুব একটা মন নেই। অথচ উচ্চশিক্ষার মান বাড়াতে গবেষণা অন্যতম পূর্বশর্ত। উন্নত দেশগুলোয় বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর গবেষণা খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে গবেষণার মতো অত্যাবশ্যকীয় খাতে এমন অর্থ ব্যয় করা হয়, যা উল্লেখ করার মতো নয়। হাতেগোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকাওয়াস্তে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। বিদ্যমান প্রেক্ষাপটে গবেষণায় ন্যূনতম শতাংশ ব্যয় করার বিধান তাত্পর্যপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এটি মানছে কিনা সেটি তদারকিও করতে হবে ইউজিসিকে। নিয়ম না মানলে কী শাস্তি প্রদান করা হবে, তাও স্পষ্ট করা প্রয়োজন। তহবিল ঘাটতিকে গবেষণার অন্যতম প্রতিবন্ধক হিসেবে দেখা হয়, কিন্তু এর চেয়েও বড় সংকট উদ্যম, উদ্যোগ আর ব্যবস্থাপনায়। প্রত্যেক বিশ্ববিদ্যালয়েই খাতে কমবেশি অর্থ বরাদ্দ থাকে। তার মধ্যে খুবই অল্প অংশ ব্যয় হয়। সিংহভাগ ব্যয় করা হয় বেতন-ভাতাসহ অন্য খাতে। বিদেশে গবেষণা না করলে পদোন্নতি দেয়া তো দূরের কথা, চাকরি চলে যাওয়ার ব্যবস্থা আছে; যেটা বাংলাদেশে নেই। তাই যতটুকু বরাদ্দ রাখা হয় তা সদ্ব্যবহারের মাধ্যমে গবেষণা করা জরুরি। পাশাপাশি যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ রাখা হয়, সেটা সিরিয়াস গবেষকের উপকারে আসছে না। এদিকে ইউজিসির নজর দেয়া প্রয়োজন।

উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা খাতে বিপুল অর্থ ব্যয় করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে গবেষণার মতো অত্যাবশ্যকীয় খাতে এমন অর্থ ব্যয় করা হয়, যা উল্লেখ করার মতো নয়। হাতে গোনা কয়েকটি ছাড়া বেশির ভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ে নামকাওয়াস্তে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এক-তৃতীয়াংশই নিজেদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হিসেবে মনে করে। এগুলোর দুই-তৃতীয়াংশই নামকাওয়াস্তে গবেষণা খাতে খরচ দেখায়। মাত্রাতিরিক্ত ব্যবসায়িক মনোভাবের কারণে এসব প্রতিষ্ঠান গবেষণা নিয়ে চিন্তা করে না। ফলে দেশের উচ্চশিক্ষার মান এখন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। এর প্রমাণ হলো, বিশ্বের এক হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের তালিকায় স্থান পায়নি দেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণায় বরাদ্দ একদম কম। গবেষণায় পর্যাপ্ত বরাদ্দ দেয়া না হলে ভালো উঁচু মানের গবেষণা করা সম্ভব নয়। এখান-ওখান থেকে নিয়ে গবেষণা করা যায়। কিন্তু সেটা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেঅ্যাপ্লাইড রিসার্চ’ (ব্যবহারিক গবেষণা) হয়। মৌলিক গবেষণার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যমে বরাদ্দ হওয়া দরকার। পাশাপাশি শিক্ষকরা যাতে গবেষণায় উৎসাহী নিয়োজিত হন সে ধরনের প্রয়োজনীয় সংস্কারও করতে হবে।

যে দেশে যত বেশি গবেষণার জন্য আর্থিক প্রণোদনাসহ অনুকূল পরিবেশ নিশ্চিত করা হয়, সে দেশ তত বেশি সমৃদ্ধ। যেমন যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, যুক্তরাজ্য, জার্মানি, দক্ষিণ কোরিয়া, ভারত প্রভৃতি দেশে পুনঃপুন গবেষণা ছাড়া অপেক্ষাকৃত ছোট বিষয়েও সিদ্ধান্ত নেয়া হয় না। গবেষণা উন্নয়ন খাতে যেসব দেশে বার্ষিক ৫০ মিলিয়ন ডলারের অধিক অর্থ ব্যয় করা হয়, সে রকম ৯০টি দেশের মধ্যে ভারত পাকিস্তান থাকলেও বাংলাদেশ বরাবরের মতোই অনুপস্থিত। বাংলাদেশে গবেষণার জন্য প্রয়োজনীয় পরিমাণ অর্থ ব্যয় করা হয় না। শিক্ষার বাজেট জিডিপির দশমিক শূন্য শতাংশ, যেখানে ইউনেস্কোর নির্দেশনা অনুযায়ী শিক্ষা খাতে অন্তত জিডিপির শতাংশ বরাদ্দ রাখা উচিত। সুতরাং গবেষণার প্রণোদনা সহজেই অনুমেয়। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও গবেষণা খাতে বরাদ্দ অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। গবেষণা তো দূরের কথা, শিক্ষা খাতেই দেশে ব্যয় বরাদ্দ কম। বরাদ্দ বাড়ানোর কথা বলা হলে কর্তাব্যক্তিরা বলেন, ‘টাকার পরিমাণ বাড়ানোর কথাটা বলা সহজ, করা তত সহজ নয়। আমাদের মতো গরিব দেশে এত বাড়তি অর্থ আসবে কোত্থেকে?’ কথা নিশ্চয়ই ঠিক যে আমাদের টাকা নেই। কিন্তু অগ্রাধিকার কি আছে? অগ্রাধিকার থাকলেই কেবল বরাদ্দ বাড়ানোর প্রশ্ন আসে। ভারতে শিক্ষার জন্য বরাদ্দ দশমিক শতাংশ, নরওয়েতে দশমিক যুক্তরাজ্যে দশমিক শতাংশ। ইউনেস্কো শিক্ষা খাতে বাজেটের ২৫ শতাংশ জিডিপির শতাংশ বরাদ্দের কথা বলে। কিন্তু আমরা সেসব পরামর্শকে পাত্তা দিই না। অনেক কম সামর্থ্যবান দেশেও কিন্তু শিক্ষা গবেষণায় প্রচুর টাকা ব্যয় হয়। কিউবা যদি তাদের মোট খরচের ১২ শতাংশের বেশি শিক্ষার জন্য বরাদ্দ করে, বতসোয়ানা যদি ভাগের বেশি করতে পারে, বুরুন্ডি যদি শতাংশ করতে পারে, তাহলে বাংলাদেশ শতাংশের বেশি বরাদ্দ করতে পারবে না কেন?

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে আর্থিক প্রণোদনা অবশ্যই যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন বা জাপানের মতো বরাদ্দ দেয়া সম্ভব না হলেও যে পরিমাণ অর্থ বরাদ্দ হয়, সেটিও যদি সঠিক পথে এবং উপযুক্ত গবেষকদের দিয়ে সম্পন্ন হতো তাহলে গবেষণায় বাংলাদেশ এতটা পিছিয়ে পড়ত না। তাই আর্থিক প্রণোদনা অপেক্ষা সঠিক ব্যক্তির কাছে গবেষণার ভার যাচ্ছে কিনা সেটাই বড় সমস্যা। দিকটির ওপর অধিক মনোযোগ অত্যাবশ্যক। বাংলাদেশে অনেক ভালো অধ্যাপক-গবেষক রয়েছেন, যারা আর্থিক প্রণোদনা, মূল্যায়ন নিরাপত্তা বা স্বাধীনতার অভাবে গবেষণায় আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। বর্তমানে সাড়ে লাখ কোটি টাকার বাজেট করছে বাংলাদেশ। দেশ যে সমৃদ্ধ হয়েছে এটা তার বড় প্রমাণ। এমন অর্থনীতির দেশে উচ্চশিক্ষার জন্য বাজেটের বাইরে কেবল গবেষণায় বড় ধরনের বরাদ্দ রাখা সম্ভব। টেকসই স্থায়ী (ভায়াবল) গবেষণার জন্য বাংলাদেশ অবশ্যই আলাদাভাবে বরাদ্দ রাখতে সক্ষম। অর্থনীতির পাশাপাশি মৌলিক জ্ঞান সৃষ্টিতেও বাংলাদেশকে সমৃদ্ধিশালী হতে হবে। গবেষণায় আলাদা বাজেট দেয়া হলে এররিটার্ন’ (ইতিবাচক ফল) দেশ অবশ্যই পাবে। তাছাড়া বৈশ্বিকভাবে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্য (এসডিজি) নিয়ে এগোচ্ছে দেশ। আর টেকসই উন্নয়ন উন্নত দেশের আসনে উন্নীত হতে গবেষণায় বরাদ্দের বিকল্প নেই।

কথা নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই যে যেখানে শিক্ষার অন্যান্য স্তরে জ্ঞান বিতরণই মুখ্য কাজ সেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ হলো জ্ঞান বিতরণের পাশাপাশি জ্ঞান সৃজন। আর গবেষণাই হলো জ্ঞান সৃজনের প্রধান উপায়। তাছাড়া যেকোনো দেশের সমাজ-অর্থনীতি-সংস্কৃতি তথা সামগ্রিক জনজীবনের চাকা সচল রাখতে হলে নতুন নতুন উদ্ভাবন গবেষণার বিকল্প নেই। কাজে নেতৃত্ব দেয়ার দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই নিতে হয়। কিন্তু সেই বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণার হাল যদি এমন হয়, তাহলে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা কতটা সঙ্গিন তা সহজেই অনুমেয়। এটাও মনে রাখা প্রয়োজন, বাংলাদেশ শুধু একটা উন্নয়নশীল দেশ নয়, এর অর্থনীতি বিশ্বের সবচেয়ে গতিশীল অর্থনীতিগুলোর একটি; স্বল্প সময়ের মধ্যে দারিদ্র্য বিমোচন করে ২০৪১ সালের মধ্যে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত হওয়া তার লক্ষ্য। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে লক্ষ্য অর্জন করতে হলে যে উন্নত জ্ঞান, প্রযুক্তি, সর্বোপরি জনবল প্রয়োজন তার জন্য জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখায় প্রচুর নিজস্ব গবেষণা দরকার। বলা বাহুল্য, বিশেষজ্ঞদের মতে, ওই জ্ঞান-প্রযুক্তি জনবল সৃষ্টি করতে না পারলে বাংলাদেশকে অন্য অনেক দেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের ফাঁদে আটকে থাকতে হবে। এখনই রাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের তত্পর হতে হবে। তাদের একদিকে গবেষণায় বরাদ্দ বাড়ানোর জনদাবির প্রতি দ্রুত সাড়া দিতে হবে, আরেকদিকে অর্থের সঠিক ব্যবহারের বিষয়টিও নিবিড়ভাবে তদারক করতে হবে। এক্ষেত্রে ইউজিসির পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ দেশের সব পাবলিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভালো-মন্দ দেখভাল করা তাদের দায়িত্ব।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন