পদ্মা সেতুর ওপর দিয়ে ট্রেন পরিচালনা করতে রেলওয়ের কাছে ট্যারিফ হিসেবে ৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা দাবি করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। সেতুর রেলওয়ে ডেক, ভায়াডাক্টসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ বাবদ এ অর্থ দাবি করেছে সংস্থাটি। এর বিপরীতে রেলওয়ে চাইছে, তারা দাবি করা ট্যারিফের টাকা পরিশোধ করবে, কিন্তু সেতু থেকে টোল বাবদ আদায় হওয়া মুনাফার ভাগ দিতে হবে তাদের। পদ্মা সেতুর ট্যারিফ নির্ধারণ বিষয়ে বৃহস্পতিবার রেল ভবনে অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।
৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা খরচ হয়েছে পদ্মা সেতু নির্মাণে। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, এর মধ্যে সেতুতে রেলওয়ে অবকাঠামো তৈরি করতে ব্যয় হয়েছে ৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা। নির্মাণ ব্যয়ের এ টাকা ট্যারিফ বাবদ আদায়ে চলতি বছরের ২৪ এপ্রিল রেলওয়েকে একটি প্রস্তাব দেয় সংস্থাটি। ট্যারিফ বাবদ দাবি করা এ টাকার পরিমাণ পদ্মা সেতুর নির্মাণ ব্যয়ের ১৭ দশমিক শূন্য ২৫ শতাংশ।
সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাব পর্যালোচনার জন্য একটি কমিটি গঠন করেছে বাংলাদেশ রেলওয়ে। এরই মধ্যে ট্যারিফ নিয়ে একটি পর্যালোচনা প্রতিবেদনও দাখিল করেছে কমিটি। বৃহস্পতিবারের সভায় প্রতিবেদনের বিভিন্ন সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এসব সুপারিশের একটি হলো সেতু কর্তৃপক্ষের দাবি করা ট্যারিফ পরিশোধ করে সেতুর ১৭ দশমিক শূন্য ২৫ শতাংশ মুনাফা আদায়। ট্যারিফ নিয়ে দেয়া হয়েছে আরো দুটি বিকল্প প্রস্তাব। এর একটি হলো বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো বার্ষিক এক-দেড় কোটি টাকা ট্যারিফ প্রদান। অন্যটি হলো পোন্টেজ চার্জ বা সেতু নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ ট্যাক্স প্রদান।
পদ্মা সেতুর টোল নির্ধারণের বিষয়ে আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার কার্যপত্রে বলা হয়েছে, প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, পদ্মা বহুমুখী সেতু একটি লাভজনক স্থাপনা হিসেবে পরিণত হবে। এ স্থাপনার মালিকানাস্বত্ব পাওয়া গেলে ভবিষ্যতে এ স্থাপনা থেকে মুনাফা অর্জনের সুযোগ রয়েছে। বাজেট বরাদ্দের নিশ্চয়তা প্রাপ্তি এবং সরকারি সিদ্ধান্ত গৃহীত হলে বাংলাদেশ রেলওয়ে বিনিয়োগ করে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের চাহিদা অনুযায়ী রেলওয়ের ডেক, ভায়াডাক্ট ইত্যাদি নির্মাণ বাবদ প্রস্তাবিত ৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকা পরিশোধ করতে পারে এবং পদ্মা সেতুর ১৭ দশমিক শূন্য ২৫ শতাংশ মালিকানা গ্রহণ করতে পারে। এক্ষেত্রে পদ্মা সেতুর রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় এবং অন্যান্য ব্যয়ের সঙ্গে পদ্মা সেতুর সংশ্লিষ্ট রেলওয়ে ভায়াডাক্ট ও লোয়ার ডেকে স্থাপিত রেলপথ অংশের রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় যোগ করতে হবে। এরপর পদ্মা সেতু থেকে প্রাপ্ত আয় থেকে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বাদ দিয়ে যে নিট মুনাফা হবে তার ১৭ দশমিক শূন্য ২৫ শতাংশ মুনাফা বাংলাদেশ রেলওয়েকে প্রদান করতে হবে।
বিকল্প হিসেবে কার্যপত্রে আরো বলা হয়েছে, বাংলাদেশ রেলওয়ে বঙ্গবন্ধু সেতু ব্যবহারের জন্য বর্তমানে বার্ষিক ট্যারিফ ১ কোটি টাকা নির্ধারিত হয়েছে। এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে পদ্মা সেতুর জন্যও একই হারে ট্যারিফ নির্ধারণ করা যেতে পারে। এজন্য সেতু কর্তৃপক্ষ ও রেলওয়ে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করতে পারে। এক্ষেত্রে বার্ষিক ট্যারিফ বঙ্গবন্ধু সেতুর মতো এক-দেড় কোটি টাকা নির্ধারণ করা যেতে পারে। নির্ধারিত টোলের সঙ্গে প্রচলিত প্রযোজ্য ভ্যাট যুক্ত হবে।
এর বাইরে পোন্টেজ চার্জ আদায়ের আরেকটি বিকল্প প্রস্তাবের কথা বলা হয়েছে। অন্যান্য বড় রেলওয়ে সেতুর মতো পদ্মা সেতুতে রেলপথ রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় নির্বাহের জন্য সেতুতে ট্রেন চালুর প্রথম দিন থেকে যেসব ট্রেন চলবে, সেগুলোর জন্য ১০০ কিলোমিটার পোন্টেজ চার্জ হিসেবে আদায় করা যেতে পারে বলে উল্লেখ করা হয়েছে কার্যপত্রে।
যদিও সেতু কর্তৃপক্ষের ট্যারিফ বাবদ দাবি করা ৬ হাজার ২৫২ কোটি টাকার প্রস্তাবটি যুক্তিসংগত ও বাস্তবধর্মী হয়নি বলে উল্লেখ করা হয়েছে সভার কার্যপত্রে। এতে আরো বলা হয়েছে, নির্মাণ ব্যয় হিসেবে এ পরিমাণ টাকা রেলওয়ের পরিশোধের কোনো সুযোগ নেই।
সভায় উপস্থিত থাকা বাংলাদেশ রেলওয়ের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বণিক বার্তাকে জানান, এই বিপুল পরিমাণ ট্যারিফ আদায়ের প্রস্তাব রেলওয়ে মেনে নেবে না। সভায় এ বিষয়ে রেলওয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিষয়টি বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষকে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে জানিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। পাশাপাশি বিষয়টি সুরাহার জন্য কার্যপত্রের অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অর্থ বিভাগে পাঠানোর সিদ্ধান্তও হয়েছে।
পদ্মা সেতুতে গত ২৬ জুন থেকে যানবাহন চলাচল শুরু হয়েছে। রেলপথ এখনো প্রস্তুত হয়নি। রেলওয়ের লক্ষ্যমাত্রা অনুযায়ী, ২০২৪ সালের ৩০ জুনের মধ্যে ঢাকা থেকে পদ্মা সেতু হয়ে যশোর পর্যন্ত ট্রেন চলাচল করবে। তবে ট্রেন চলাচল শুরুর আগেই ট্যারিফ নিয়ে দ্বন্দ্বে জড়িয়েছে সেতু কর্তৃপক্ষ ও রেলওয়ে।
পদ্মা সেতুর ট্যারিফ নিয়ে জটিলতার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে রেলপথমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বণিক বার্তাকে বলেন, সেতু কর্তৃপক্ষ ট্যারিফ বাবদ যে পরিমাণ অর্থ দাবি করেছে তা যুক্তিসংগত হয়নি। বঙ্গবন্ধু সেতুতে ট্রেন চলাচলের জন্য ট্যারিফের পরিমাণ ১ কোটি টাকা। ট্যারিফ নির্ধারণের ক্ষেত্রে এ সেতুই সবচেয়ে ভালো উদাহরণ। তবে রেলওয়ে ও সেতু কর্তৃপক্ষ দুটোই সরকারি সংস্থা। আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে দ্রুতই ট্যারিফ নির্ধারণের জটিলতা দূর করে ফেলা হবে এবং পদ্মা সেতুতে ট্রেন চলাচলের জন্য যৌক্তিক হারে ট্যারিফ নির্ধারণ করা সম্ভব হবে বলে মনে করেন তিনি।