উদযাপনে ভার্চুয়ালি অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী

বঙ্গবন্ধু টানেলের পূর্তকাজ শেষ হচ্ছে আজ

সুজিত সাহা, চট্টগ্রাম ব্যুরো

চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেল ছবি: আজীম অনন

দাতা সংস্থার সঙ্গে ঋণ চুক্তির মেয়াদ শেষের আগেই বঙ্গবন্ধু টানেলের উদ্বোধনের পরিকল্পনা ছিল বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষের (বিবিএ) সেটি সম্ভব না হলেও নির্দিষ্ট সময়সীমার মধ্যেই টানেলের মূল চ্যালেঞ্জিং কাজ শেষ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না কমিউনিকেশন কনস্ট্রাকশন কোম্পানি (সিসিসিসি) লিমিটেড। জটিল টানেল টিউব দুটি টিউবের সংযোগ পথ স্থাপনসহ দেশের ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মেগা প্রকল্পটির পূর্তকাজ শতভাগ শেষ হচ্ছে আজ। তাই কাজ শেষের মুহূর্তটি উদযাপনের মাধ্যমে স্মরণীয় করে রাখতে চায় সরকার। সেই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভার্চুয়ালি অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত বিবিএ কর্মকর্তারা জানান, বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটি ২০১৫ সালে অনুমোদন পেলেও মূল কাজ শুরু হয় ২০১৯ সালে। তবে ওই বছরের শেষার্ধে চীনে কভিডের প্রকোপ শুরু হয়। এরপর ২০২০ সালের মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে লকডাউন শুরু হয় বাংলাদেশেও। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নানা বিধিনিষেধ শুরু হলে আমদানি উপকরণের ওপর নির্ভরশীল চলমান মেগা প্রকল্পের কাজের গতি কমে আসে। অপরদিকে চীনের অর্থায়ন চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে শুরু হওয়া টানেলের নির্মাণকাজ চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ে। বিশেষত চীনা প্রকৌশলীরা তাদের দেশ থেকে বাংলাদেশে আসা ছুটিতে যাওয়ার পর চীন সরকারের কঠোর কোয়ারেন্টিন আইসোলেশন কাজের গতিকে প্রভাবিত করে। তবে বিবিএ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মাসভিত্তিক নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার বেশি কাজ আদায় করতে সক্ষম হওয়ায় ঋণচুক্তির নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যেই টানেলের মূল পূর্তকাজ শতভাগ শেষ করা সম্ভব হয়েছে। 

বিবিএ সূত্রে জানা গিয়েছে, চট্টগ্রামের পতেঙ্গা এলাকার টানেলের দক্ষিণ টিউবের পূর্তকাজ সমাপ্তি উদযাপন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে আজ সকাল ১০টায়। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করবেন সড়ক পরিবহন সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের সচিব মো. মনজুর হোসেন। উপস্থিত থাকবেন চীনা রাষ্ট্রদূত, চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের (চসিক) মেয়র, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (সিডিএ) চেয়ারম্যান, স্থানীয় সংসদ সদস্য, সেনা, নৌ বিমান বাহিনীর প্রতিনিধি, চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক, সরকারি সব কার্যালয়ের প্রতিনিধি, আমন্ত্রিত ব্যবসায়ী নেতারা। পূর্তকাজ উদ্বোধনের পর আগামী বছরের ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে কিংবা মার্চের প্রথমার্ধে টানেলের পূর্ণাঙ্গ উদ্বোধনের মাধ্যমে যানবাহন চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে।

সেতু কর্তৃপক্ষ অবশ্য বলছে, পূর্তকাজ প্রায় শতভাগ শেষ হলেও আনুষঙ্গিক অনেক কাজই বাকি। টানেলকে ঘিরে সড়ক জনপথ (সওজ) বিভাগ, চসিক, সিডিএ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল দপ্তর (এলজিইডি), পুলিশ, নৌ-বাহিনী, বিদ্যুৎ বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস সিভিল ডিফেন্স বিভাগের একাধিক কাজ চলমান রয়েছে। উভয় প্রান্তে স্ক্যানার বসানো, সার্ভিস এরিয়া নির্মাণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজও এখনো শেষ হয়নি। শুরুতে অবশ্য স্ক্যানারসহ বেশকিছু কাজ ছিল না প্রকল্প উন্নয়ন প্রস্তাবনা বা ডিপিপিতে। দেশীয় বাস্তবতায় পরবর্তী সময়ে এগুলো সংযুক্ত করা হয়েছে। এরই মধ্যে প্রকল্পের তৃতীয় সংশোধনীসহ মেয়াদ ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হয়েছে। চলতি বছরের শেষ দিকে এটি জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) উঠতে পারে বলে জানা গিয়েছে। আর প্রকল্পের মেয়াদ বাড়িয়ে ২০২৩ সালের ডিসেম্বর এবং ব্যয় বাড়তে পারে প্রায় ১৬৮ কোটি টাকা।

সর্বশেষ অক্টোবর পর্যন্ত অগ্রগতি প্রতিবেদন অনুযায়ী, প্রকল্পটির ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৩ শতাংশ। তবে আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। এর মধ্যে প্রথম টানেল টিউবের (নর্থ) হাজার ৪৪৬ মিটার দ্বিতীয় টানেল টিউবের হাজার ৪৫৮ মিটার বোরিং কাজ, প্রথম দ্বিতীয় টিউবের লেন স্লেভ, তিনটি ক্রস প্যাসেজের (সংযোগ পথ) কাজ, ভায়াডাক্ট, উভয় টিউবের পেভমেন্ট স্লেভ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। পূর্ব অংশ পশ্চিম অংশের রেইন শেল্টারের আর্ক মেশ শেল ইনস্টলমেন্ট পেইন্টিং কাজ শেষ হলেও পিসি এনডোরেন্স শিট ইনস্টলমেন্ট কাজ এখনো চলমান। পশ্চিম অর্থাৎ পতেঙ্গা প্রান্ত পূর্ব (আনোয়ারা) প্রান্তে মেগাওয়াটের সাময়িক বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। উভয় প্রান্তে স্থাপন করা হয়েছে ১৫ মেগাওয়াটের সাব-স্টেশন। টানেল নির্মাণ এলাকার উভয় প্রান্তে সারফেসে মিঠা পানির প্রবাহের লক্ষ্যে দুটি করে মোট চারটি গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে।

পূর্তকাজ শেষ হলেও উত্তর দক্ষিণ টিউবের ফায়ার প্রুপ বোর্ড ডেকোরেটিভ বোর্ড স্থাপনের কাজ শেষ হয়নি এখনো। টানেলের ইলেকট্রোমেকানিক্যাল ওয়ার্সের মধ্যে কেবল কানেকশন, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, লাইটিং কাজ চলমান থাকলেও জেট ফ্যান ইনস্টলমেন্ট সম্পন্ন হয়েছে। টানেলের অ্যাপ্রোচ সড়ক, সার্ভিস এরিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো নির্মাণের দায়িত্বে রয়েছে বাংলাদেশী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেসার্স আব্দুল মোনেম কনস্ট্রাকশন লিমিটেড। এরই মধ্যে তারা টানেলের উভয় প্রান্তের হাজার ৩৫০ মিটার অ্যাপ্রোচ সড়কের ৯৮ শতাংশ (৩১ অক্টোবর পর্যন্ত) শেষ করেছে। বাকি শতাংশও দ্রুত শেষ করতে কাজ করে যাচ্ছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি। সার্ভিস এরিয়ার আনোয়ারা প্রান্তের ৩০টি কটেজ ভবন, একটি প্রশাসনিক ভবন, একটি সুইমিং পুলসহ বিভিন্ন অবকাঠামো নির্মাণ করছে তারা। তাছাড়া প্রকল্পের ভূমি অধিগ্রহণ ৩৭৯ দশমিক ৪২৬১ একরের মধ্যে ৩৬৫ দশমিক ৩৯১১ একর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে। আনোয়ারা প্রান্তের নতুন প্রস্তাবিত ১৪ দশমিক শূন্য ৩৫ একর ভূমির যৌথ তদন্তের ফিল্ডবুক চূড়ান্তের কাজ চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে চলমান। ভূমি অধিগ্রহণে ক্ষতিগ্রস্ত হাজার ৮৭১ ব্যক্তির মধ্যে হাজার ৩১৫ জনকে এরই মধ্যে ক্ষতিপূরণের চেক দেয়া হয়েছে। সার্ভিস এরিয়ার বাংলো, দুটি সেতু, ড্রেনেজ অভ্যন্তরীণ রোডসহ অন্যান্য কাজও চলমান। তবে সার্ভিস এরিয়া নির্মাণের কাজ শেষ হয়েছে কেবল ৫৮ শতাংশ।

আব্দুল মোনেম লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এএসএম মাইনউদ্দিন মোনেম বণিক বার্তাকে বলেন, নদীর তলদেশ দিয়ে টানেল নির্মাণ বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন অভিজ্ঞতা। সে হিসেবে কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ আমাদের জন্য একটি মাইলফলক। দেশীয় কোম্পানি হিসেবে এর নির্মাণকাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে কাজ সম্পন্ন করতে পারায় সবার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। এর মাধ্যমে উন্নয়নের অভিযাত্রায় আরেকটি পালক যুক্ত হলো। বাংলাদেশ যে এসব অবকাঠামো নির্মাণে সক্ষম, তা এর মাধ্যমে প্রমাণিত হলো।

চীনা অর্থায়নে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিতব্য বঙ্গবন্ধু টানেল প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছে ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি ৪২ লাখ ৪০ হাজার টাকা। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চীনের রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানি সিসিসিসি লিমিটেডের সঙ্গে ২০১৫ সালের ৩০ জুন চুক্তি হয়। পরে ২০১৭ সালের ডিসেম্বর কাজ শুরু করে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কাজ শেষ করার পর দুই বছর ডিফেক্ট লায়াবিলিটি পিরিয়ড রয়েছে চুক্তিতে। মূল টানেলের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ৭০৫ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার। এছাড়া প্রভিশনাল সামের জন্য ৬৪৬ মিলিয়ন ডলার, সার্ভিস এরিয়ায় ৫৯ দশমিক ৮০ মিলিয়ন ডলার, ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যারে দশমিক ৪৫ মিলিয়ন ডলার টাগবোটের জন্য দশমিক ২০ মিলিয়ন ডলার চুক্তি করা হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। সাম্প্রতিক সময়ে দেশে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি বেশ কয়েকটি কাজ ডিপিপিতে না থাকায় প্রকল্পের মূল ব্যয় কয়েকশ কোটি টাকা বাড়তে পারে। যদিও প্রকল্প সেতু কর্তৃপক্ষ বলছে, একটি মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সেটি খুবই নগণ্য।

জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু টানেলের প্রকল্প পরিচালক হারুনুর রশীদ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পটির পূর্তকাজ শেষ হয়েছে। তবে এখনই টানেল চালু করা সম্ভব নয়। বিশেষায়িত প্রকল্প হওয়ায় নিরাপত্তাসহ আনুষঙ্গিক কাজ শেষ হলেই যানবাহন চলাচলের জন্য সেটি উন্মুক্ত হবে। তবে জটিল প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টানেলের দুটি টিউবের বোরিং কাজ শেষ করতে পারায় সরকার সেটি জাঁকজমকপূর্ণভাবে উদযাপন করবে। টানেল নির্মাণকাজটি কোনো ধরনের জটিলতা ছাড়াই শেষ করা দেশের অবকাঠামো নির্মাণের ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক হয়ে থাকবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের পতেঙ্গা প্রান্তের প্রথম টানেল টিউবের বোরিং কাজ উদ্বোধন করে। পরবর্তী সময়ে ২০২০ সালের ১২ ডিসেম্বর দ্বিতীয় টানেল টিউবের বোরিং কাজের উদ্বোধন করেন সড়ক পরিবহন সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে চট্টগ্রাম শহর আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে ভূমির মাধ্যমে সংযুক্ত হয়ে যাবে। এটি চট্টগ্রামসহ সারা দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন