অব্যবহূত থাকছে বরাদ্দ জমি

বিনিয়োগ আকর্ষণ করতে পারছে না হাই-টেক পার্ক

শেখ তৌফিকুর রহমান

ছবি: বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্ক, রাজশাহী

তথ্যপ্রযুক্তি খাত বিকাশের উদ্দেশ্য থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে হাই-টেক পার্ক নির্মাণ করছে সরকার। এরই মধ্যে গাজীপুর, সিলেট রাজশাহীতে তিনটি হাই-টেক পার্কের নির্মাণকাজ শেষও হয়েছে। পার্কগুলোয় কার্যক্রম চালাচ্ছে খুবই স্বল্পসংখ্যক প্রতিষ্ঠান। বিনিয়োগকারীরা শুরুতে আগ্রহ দেখালেও দিনে দিনে তা কমে এসেছে। জমি বা ফ্লোর স্পেস বরাদ্দ নেয়ার পর উৎপাদন শুরুর জন্য নতুন করে বিনিয়োগ করছেন না তারা। এখন পর্যন্ত হাই-টেক পার্কগুলোয় বিপুল পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ হলেও তা অব্যবহূতই পড়ে থাকছে।

তথ্যপ্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে ২০১০ সালে গঠন করা হয় বাংলাদেশ হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ (বিএইচটিপিএ) বিএইচটিপিএর অধীনে এখন হাই-টেক পার্ক, আইটি পার্ক, সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্ক, আইটি ট্রেনিং অ্যান্ড ইনকিউবেশন সেন্টারসহ মোট ৯২টি প্রকল্পের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এর মধ্যে হাই-টেক পার্কের সংখ্যা চার। আইসিটি খাতের বৃহৎ পরিসরের উৎপাদন হাব হিসেবেই গড়ে তোলার লক্ষ্য থেকে হাই-টেক পার্কগুলো নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয় বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এর মধ্যে সবার আগে উৎপাদনে এসেছে গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি। এছাড়া সিলেট রাজশাহীতে নির্মিত হাই-টেক পার্কে কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিসরে উৎপাদন কার্যক্রম শুরু করেছে। রাজশাহীর হাই-টেক পার্কে দুই বছর আগেই উৎপাদন কার্যক্রম শুরু হলেও এখনো তা আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন হয়নি। এছাড়া সম্প্রতি ঢাকার দোহারে চতুর্থ সর্বশেষ হাই-টেক পার্কটি নির্মাণে গৃহীত প্রকল্পের বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে।

রাজশাহী শহর থেকে ছয় কিলোমিটার পশ্চিমে পদ্মাপারে প্রায় ৩১ একর জায়গা নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্ক। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন না হলেও প্রতিষ্ঠানটিতে প্রায় দুই বছর আগেই কার্যক্রম শুরু হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত এখানে কার্যক্রম শুরু করা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা হাতে গোনা কয়েকটি। নতুন করে বিনিয়োগেও তেমন কোনো আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না উদ্যোক্তাদের মধ্যে। বর্তমানে সেখানে প্রায় এক-তৃতীয়াংশ জায়গা ফাঁকা পড়ে রয়েছে।

রাজশাহী হাই-টেক পার্কে বরাদ্দযোগ্য জমি বা স্পেসের পরিমাণ ৮৩ হাজার ১১০ বর্গফুট। পর্যন্ত জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে ৫৮ হাজার ৪১৬ বর্গফুট। এখনো খালি পড়ে রয়েছে ২৪ হাজার ৬৯৪ বর্গফুট। বিএইচটিপিএর দেয়া তথ্য অনুযায়ী, এখন পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু হাই-টেক পার্ক রাজশাহীতে বিনিয়োগ করেছে মোটে আটটি প্রতিষ্ঠান। এর মধ্যে বিজনেস অটোমেশন হাজার ৫০০ বর্গফুট, উইমেন অ্যান্ড -কমার্স হাজার ৯৮৭, শপ আপ হাজার ৩৬৩, রিয়েল আইটি হাজার ৪৫৫, এমডি ইনফোটেক ১৪ হাজার ৩৮৭, ফ্লিট বাংলাদেশ ১৪ হাজার ৩৮৭, ডাটামাইন্ড লিমিটেড হাজার ৭২৫ চালডাল লিমিটেড ১২ হাজার ৬১২ বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ নিয়েছে।

ফ্লিট বাংলাদেশের সিইও মো. খায়রুল আলম বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা যারা দুই বছর আগে কার্যক্রম শুরু করেছি, তারা নিজ নিজ কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। আশা করছি, যেসব জায়গা এখনো খালি পড়ে আছে সেগুলো দ্রুতই পূরণ হয়ে যাবে।

বৃহৎ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বরাদ্দ পাওয়া জমি অব্যবহূত ফেলে রাখার প্রবণতা দেখা যাচ্ছে বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি কালিয়াকৈরেও। গাজীপুরের কালিয়াকৈর উপজেলায় ৩৫৫ একর জমির ওপর গড়ে তোলা দেশের প্রথম বৃহত্তম হাই-টেক পার্কটিতে ৮০-৮২টি প্রতিষ্ঠান বিনিয়োগ করেছে। এর মধ্যে ছোট পরিসরে বিনিয়োগকারীদের একাংশ কার্যক্রম শুরু করলেও বৃহৎ বিনিয়োগকারীরা তাদের বরাদ্দ পাওয়া জমি অব্যবহূত ফেলে রাখছেন। হাই-টেক পার্কটিতে এখন বৃহৎ পরিসরে সাতটি প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম শুরু করেছে। এর মধ্যে তিনটি প্রতিষ্ঠান আইওটি ডিভাইস, দুটি প্রতিষ্ঠান অপটিক্যাল ফাইবার দুটি প্রতিষ্ঠান সেলফোন তৈরি করছে। চীনভিত্তিক ওরিক্স বায়োটেক লিমিটেড পার্কটিতে ২০১৯-২০ অর্থবছরে প্রথম ৩০ কোটি ডলার বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করে জায়গা বরাদ্দ নেয়। বড় বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি থাকলেও এখনো এখানে কার্যক্রম শুরু করেনি ওরিক্স বায়োটেক।

যেসব প্রতিষ্ঠান কার্যক্রম চালাতে পারছে না তাদের বরাদ্দ বাতিলের প্রক্রিয়া চলছে বলে জানালেন বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি কালিয়াকৈর বঙ্গবন্ধু হাই-টেক সিটি রাজশাহীর ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা মাহফুজুল কবির। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, কাগজপত্রের জটিলতার কারণে অনেকেই এখনো কার্যক্রম শুরু করতে পারছেন না। হাই-টেক সিটির পক্ষ থেকে তাদের সহযোগিতা করা হচ্ছে। আবার যাদের কার্যক্রম চালানোর আগ্রহ দেখা যাচ্ছে না, তাদের বাদ দেয়া হচ্ছে।

সিলেটের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্কে পর্যন্ত ১৮টি প্রতিষ্ঠানকে জমি বরাদ্দ দেয়া হয়েছে, যার মধ্যে ১২টি প্রতিষ্ঠানকে ৭১ দশমিক ৯৮২ একর ছয়টি প্রতিষ্ঠানকে ১৮ হাজার ৭৬০ বর্গফুট স্পেস বরাদ্দ দেয়া হয়েছে।

পার্কের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা জানান, বিশ্বমানের বিনিয়োগ পরিবেশ তৈরির মাধ্যমে দেশী-বিদেশী তথ্যপ্রযুক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোকে পার্কে আকৃষ্ট করার লক্ষ্য নিয়ে হাই-টেক পার্ক প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হয়। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল আইসিটি পেশাজীবীদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ নিশ্চিত করা। কিন্তু এখনো সে সুযোগ তৈরি হয়নি। পার্কে বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক কর্মকাণ্ড পরিচালনা শুরুর পর সে সুযোগ তৈরি হবে।

জায়গা বরাদ্দ পাওয়া প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, জায়গা বরাদ্দ পাওয়া কোম্পানিগুলোর অধিকাংশই অবকাঠামো নির্মাণের প্রাথমিক কার্যক্রম শুরু করেনি। অনেকের অবকাঠামো নির্মাণ প্রক্রিয়া চলমান রয়েছে। সুতরাং এখনই জায়গা বরাদ্দ নেয়া কোম্পানিগুলো উৎপাদনে যেতে পারছে না। আবার যারা স্পেস বরাদ্দ নিয়েছিলেন তাদের অধিকাংশই হাই-টেক পার্ক থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছেন।

সিলেটের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব হাই-টেক পার্কে ছোটবড় মিলিয়ে মোট ১২টি প্রতিষ্ঠানকে জায়গা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পার্ক কর্তৃপক্ষের তথ্যমতে, পার্কটিতে সবচেয়ে বেশি ৩২ একর জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে র্যাংগস ইলেট্রনিকস। এছাড়া আরএফএল ইলেকট্রনিকস জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে ২০ একর এবং আরটিএম আল কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি পেয়েছে আট একর। ব্যাবিলন রিসোর্সেস, হেলথ ল্যান্ডমার্ক হোল্ডিং, টুগেদার আইটি, ইএলবি, অটোমেশন সার্ভিস লিমিডেট, ম্যাকডোনাল্ড স্টিল বিল্ডিং প্রডাক্টস, অগ্রণী ব্যাংকসহ আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান স্বল্প পরিমাণ জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে।

সিলেট হাই-টেক পার্কে এক একর জায়গার ওপর অবকাঠামো তৈরি শুরু করছে আইটি কোম্পানি টুগেদার আইটি ইন্ডাস্ট্রিয়াল। প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইমতিয়াজুল হক ভুঁইয়া বণিক বার্তাকে বলেন, হাই-টেক পার্কে আমাদের অবকাঠামো তৈরির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এখন শেড লাগানোর কাজ চলছে। এখনো আমরা উৎপাদনে যেতে পারিনি। অবকাঠামো নির্মাণ শেষে শিগগিরই উৎপাদনে যেতে পারব বলে আশা করছি।

জমির বাইরেও হাই-টেক পার্কের প্রশাসনকি ভবনের বিভিন্ন ফ্লোরে স্পেস বরাদ্দ পেয়েছে ছয় প্রতিষ্ঠান। তিনটি আইটি কোম্পানির পাশাপাশি অগ্রণী ব্যাংক, শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স বিভাগকেও স্পেস বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। সিলেটের হাই-টেক পার্কে দুই হাজার বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ পেয়েছে ইন টাচ আইটি। প্রতিষ্ঠানটি এখন সিলেটের হাই-টেক পার্ক থেকে তাদের কার্যক্রম গুটিয়ে নিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী চৌধুরী মহসিন সিদ্দিক বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা আইসিটি ডিভিশনের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে আমাদের অসুবিধাগুলো জানিয়েছিলাম। পরে এটা বাদ দিয়ে দিয়েছি। কারণ আমাদের যেসব চাহিদা ছিল সে অনুযায়ী তারা আমাদের সুবিধা দিতে পারেনি। কারণে আমরা বাদ দিয়ে দিয়েছি। হাই-টেক পার্ক কর্তৃপক্ষ আমাদের কাছে যে ভাড়া চেয়েছিল, তাতে আমাদের পোষাচ্ছিল না। এজন্য বাদ দিয়েছি।

সিলেট হাই-টেক পার্কে দেড় হাজার বর্গফুট জায়গা বরাদ্দ পাওয়া একটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা সিইও এম রাহবার জুমার আবেশ বণিক বার্তাকে বলেন, ওখানে জায়গা বরাদ্দ নিয়েছিলাম। কভিডের কারণে পরে পরিকল্পনা বদলাতে হয়। এজন্য আর এগোইনি। কারণ আমার সবকিছুই ঢাকাকেন্দ্রিক। সিলেটে আমার অফিসের কিছু কর্মী ছিলেন, যারা কাজগুলো করতেন।

হাই-টেক পার্কগুলোয় প্রত্যাশামাফিক উৎপাদন শুরু না হওয়ার পেছনে প্রধানত কভিডের প্রাদুর্ভাব চলমান বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দাকে দায়ী করছেন বিকর্ণ কুমার ঘোষ। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, আগ্রহের অভাব রয়েছে বিষয়টি তা নয়। কভিড শুরুর পর আমরা সবাই ঘরের ভেতর ঢুকে যেতে বাধ্য হয়েছিলাম। তেমন পরিস্থিতিতে কাউকে অবকাঠামো নির্মাণের জন্য বাধ্য করা যায় না। কভিড পরিস্থিতির কারণে আমাদের যে অবস্থানে থাকার কথা ছিল সেখান থেকে আমরা দু-তিন বছর পিছিয়ে গিয়েছি। যেসব বিদেশী কোম্পানি বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারা কারণেই তাদের কার্যক্রম শুরু করতে পারেনি।

তিনি আরো বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বৈশ্বিক মন্দা সব দেশেই দেখা দিয়েছে। আমরাও তার ব্যতিক্রম নই। ফলে বিনিয়োগকারীদের মধ্যেও সে প্রভাব কাজ করছে। অন্য সময় হলে যেখানে বিনিয়োগ হতো ১০০ টাকা, বর্তমানে সেখানে হচ্ছে ৫০ টাকা। এখন আমরা আরো ভালো দিনের অপেক্ষায় আছি। পরিস্থিতি পার করে আমরা যেটুকু পিছিয়ে গিয়েছি সেটুকু কাটিয়ে উঠতে পারব বলে আশা রাখি।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন