পর্যালোচনা

চীনের সঙ্গে অর্থনৈতিক দ্বন্দ্ব নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রকে পুনরায় ভাবতে হবে

পিনেলোপি কুজিয়ানো গোল্ডবার্গ

গত অক্টোবরে যুক্তরাষ্ট্রের নতুন জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল প্রকাশ পেয়েছে। এর ঠিক কয়েক দিন আগেই প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন চীনা প্রযুক্তির উত্থান মোকাবেলায় চীনের বিরুদ্ধে ব্যাপক রফতানি নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা দিয়েছে। বিশ্ব প্রতিনিয়তই পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবর্তনশীল পৃথিবীর সঙ্গে তাল মেলাতে জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল গ্রহণে যুক্তরাষ্ট্র সম্ভাব্য সব উপায়ই বিবেচনায় রেখেছে। সম্প্রতি প্রকাশিত দেশটির জাতীয় নিরাপত্তা কৌশল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, বাণিজ্য খাতকে প্রাথমিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে চীনের বিরুদ্ধে স্পষ্টতই অর্থনৈতিক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে যুক্তরাষ্ট্র।

কিন্তু বিষয়টি মূলধারার গণমাধ্যমের খুব একটা নজর কেড়েছে বলে মনে হচ্ছে না। প্রসঙ্গে ফাইন্যান্সিয়াল টাইমসের সাংবাদিক এডওয়ার্ড লুইস বলেন, বিশ্বের এক অর্থনৈতিক পরাশক্তি আরেক বৃহৎ শক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে অথচ কেউ খেয়ালই করেনি! অবশ্য এতে অবাক হওয়ারও কিছু নেই, কেননা চাঞ্চল্যকর সংবাদ, টুইটারের নির্বিচারে কর্মী ছাঁটাই ক্রিপ্টোকারেন্সিতে ধসের মতো সংবাদের প্রতিযোগিতার মধ্যে বিষয়টি নিয়ে মাথা ঘামানোর সময় হয়তো কমই আছে। তবে চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের গৃহীত নতুন নীতির প্রসঙ্গটি এসব চাঞ্চল্যকর সংবাদের তুলনায় আরো অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সালিভানের গত সেপ্টেম্বরের বক্তব্যটি খেয়াল করুন। তিনি বলেছিলেন, বিশ্বের বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ কেবল প্রযুক্তিগত উন্নয়নের দ্বারাই তার অর্থনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বীদের ছাড়িয়ে যেতে পারবে না। মার্কিন উপদেষ্টার কথার অর্থ হলো, প্রতিদ্বন্দ্বীদের মোকাবেলা করতে যা কিছুই করা লাগুক না কেন, তার সব চেষ্টাই করবে যুক্তরাষ্ট্র, সেই সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর যতটা সম্ভব অর্থনৈতিক চাপ প্রয়োগও অব্যাহত রাখবে। তবে মার্কিনদের রকম দৃষ্টিভঙ্গি তাদের কিছুটা দুর্বলতাও প্রকাশ করে। কথা মানতে হবে, যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি চাঙা করার লক্ষ্যে গৃহীত নীতি সীমিত সময়ের জন্য দেশটিতে সাফল্য নিয়ে আসতে পারে।

জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিতের নামে নতুন রফতানি নিষেধাজ্ঞাগুলোকে ন্যায়সংগত করতে যুক্তরাষ্ট্রের যুক্তি হলো, চীনের উৎপাদিত প্রযুক্তিতে সামরিক বেসামরিক সংমিশ্রণ রয়েছে দ্বৈত ব্যবহারের পণ্য (যা বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে তৈরি করা হলেও এগুলো সামরিক খাতে ব্যবহার করা যায়) জাতীয় নিরাপত্তা সবসময়ই আকর্ষণীয় যুক্তি, সম্ভবত কারণেই চীনের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের নতুন অর্থনৈতিক নীতিগুলোয় দ্বিপক্ষীয় সমঝোতা সম্ভব হয়েছে। তবু পদক্ষেপ অত্যন্ত সংঘাতপূর্ণ।

প্রথমত, জাতীয় নিরাপত্তাসংক্রান্ত যুক্তি দেখানো সহজ হলেও সেটা যাচাই করা তো কঠিন। সুনির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে এর আগেও নিরাপত্তা ঝুঁকির অজুহাতে ইরাককে একটি দীর্ঘ অত্যন্ত ভয়াবহ যুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র। সে যুদ্ধ শুরুর যৌক্তিকতা ছিল ইরাকি গণবিধ্বংসী অস্ত্রের কথিত হুমকি, পরবর্তী সময়ে এসব যুক্তি ভিত্তিহীন প্রমাণিত হলেও যুদ্ধ অব্যাহত ছিল। যদিও গত ১০ বছরে চীনের বৈশ্বিক নীতিতে বহু পরিবর্তন এসেছে, তবু চীনকে তো আর রাশিয়ার সঙ্গে তুলনা করা যাবে না। তাইওয়ান ভূখণ্ডে চীনের কর্তৃত্বপূর্ণ মনোভাব বা দক্ষিণ চীন সাগর ইস্যুতে ফিলিপাইনের সঙ্গে চীন যুদ্ধে জড়াবে এমন আশঙ্কায় তাদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের কঠোর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ মাত্রাতিরিক্তই বটে। তাছাড়া চীনের ওপর এখনই নিষেধাজ্ঞা আরোপ হিতে বিপরীত হতে পারে, পরিস্থিতি ক্রমেই নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। নিষেধাজ্ঞার প্রত্যুত্তরে চীনা নেতারা আরো বেশি আক্রমণাত্মক হয়ে উঠতে পারেন।

দ্বিতীয়ত, দ্বৈত ব্যবহার পণ্যের ধারণাটিও বিভ্রান্তিকর। কেননা প্রতিটি জিনিসেরই বেসামরিক সামরিক ব্যবহারের সম্ভাবনা রয়েছে তাই ধারণাটি প্রশ্নবিদ্ধ। উদাহরণস্বরূপ, সামরিক সেনাদের খাবার বস্ত্রের প্রয়োজন হয়, এজন্য খাবার পোশাক কি দ্বৈত ব্যবহারের পণ্য হিসেবে সীমাবদ্ধ করা উচিত? বাণিজ্যিক ব্যবহারের জন্য উৎপাদিত প্রযুক্তি প্রায়ই সামরিক ক্ষেত্রেও ব্যবহূত হয় এবং সামরিক বাহিনী সবসময়ই আধুনিক প্রযুক্তির অন্যতম প্রধান গ্রাহক ছিল। এটা দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, এখনকার যুদ্ধগুলোয় ব্যাপকভাবে প্রযুক্তির ব্যবহার হচ্ছে। তবে জাতীয় নিরাপত্তা যদি সত্যিই উদ্বেগের বিষয় হয়, তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে শুধু উন্নত প্রযুক্তিপণ্যের বাণিজ্যে নিষেধাজ্ঞা না দিয়ে বরং বৈরী সম্পর্কের দেশের সঙ্গে সব ধরনের বাণিজ্য বন্ধ করা। যুক্তরাষ্ট্র এরই মধ্যেফ্রেন্ড-শোরিংঅর্থাৎ বন্ধুত্বপূর্ণ দেশের সঙ্গে বাণিজ্যের নীতি নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু ইতিহাস শেখায়, আমাদের আজকের বন্ধু ভবিষ্যতেও বন্ধু থাকবে এমন নিশ্চয়তা যে একদমই নেই।

সত্যিকার অর্থে, চীনের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের দেয়া নিষেধাজ্ঞাগুলো যতটা না জাতীয় নিরাপত্তা সম্পর্কিত তার চেয়ে বেশি অর্থনৈতিক আধিপত্যকে ঘিরে। চীন তিন দশক ধরে বিশ্ব অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করেছে। অবস্থা যদি (‘যদিশব্দটি এখন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ) অব্যাহত থাকে তবে তা চীনকে বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্থনীতির দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক হবে। যদিও এখনই এমনটা অনুমান করা যাবে না। আর রকমটা ঘটলেও বৈশ্বিক কল্যাণের হিসাবের খাতা শূন্যই থাকবে, কেননা চীনের উত্থান তো যুক্তরাষ্ট্রের পতনকেই বোঝায়।

এছাড়া বাইডেন প্রশাসনের নতুন পদক্ষেপ কতটা কার্যকর হবে তা এখন দেখার বিষয়। মিত্র দেশগুলোর সঙ্গে পরামর্শ না করেই যুক্তরাষ্ট্র একতরফাভাবে চীনের ওপর নিষেধাজ্ঞাগুলো আরোপ করেছে। বিশেষ করে রফতানি নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নীতির সঙ্গে বেশকিছু মিত্র দেশের সহমত থাকা নিয়ে এরই মধ্যে সন্দেহ জেগেছে। কেননা যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্র দেশ জার্মানি গত অক্টোবরে চীনা শিপিং কোম্পানি কসকোর কাছে হামবুর্গ বন্দরের ২৫ শতাংশ অংশীদারত্ব অধিগ্রহণসংক্রান্ত চুক্তি অনুমোদন করেছে। এরপর চলতি মাসের শুরুতে জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শুলজ উচ্চপর্যায়ের জার্মান ব্যবসায়ী প্রতিনিধি দল চীন সফর করে এসেছে।

একইভাবে সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যখন চীনের জেডটিই হুয়াওয়ে কোম্পানিকে লক্ষ্য করে রফতানি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছিল, তখন নিজ দেশের কোম্পানিগুলোর ওপর এর বিরূপ প্রভাব কমাতে হিমশিম খেতে হয়েছে মার্কিন কর্তৃপক্ষকে। এছাড়া বিশ্ববাজারের সাপ্লাই চেইন থেকে চীনের ওই কোম্পানিগুলোকে নির্মূল সম্ভব হয়নি। এর কারণ বৈশ্বিক বাজার যুক্তরাষ্ট্রের হাতের মুঠোয় বন্দি নয়, বরং বৈশ্বিক বাজার সবসময়ই এক ধাপ এগিয়ে থাকে।

সবচেয়ে বড় কথা, রফতানি নিষেধাজ্ঞাগুলো কার্যকর প্রমাণিত হলেও তা শেষ পর্যন্ত চীনের অভ্যন্তরীণ প্রযুক্তির উন্নয়ন কিংবা বিকাশকে বাধাগ্রস্ত করবে না। সর্বোচ্চ ক্ষেত্রে নতুন নিষেধাজ্ঞাগুলো হয়তো যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক আধিপত্যকে আরো কয়েক বছরের জন্য সুসংহত করবে। যেহেতু তিন দশক ধরে উভয় দেশ যেকোনো মূল্যে শান্তিপূর্ণ অর্থনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে।

তবে বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনে বিঘ্ন ঘটলে গ্রাহকের পণ্য ক্রয়ে খরচ বাড়বে এবং সেই সঙ্গে বৈশ্বিক প্রযুক্তির অগ্রগতি ব্যাহত হবে। জলবায়ু পরিবর্তনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সহযোগিতাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এছাড়া দীর্ঘকাল ধরে হারাতে বসা উৎপাদন শিল্প-কারখানার প্রত্যাবর্তনও দেখতে পাবেন না যুক্তরাষ্ট্রের শ্রমিকরা। তখন সবচেয়ে বড় সুবিধাভোগী হবেন পরামর্শদাতা আইনজীবীরা, যারা পারিশ্রমিকের বিনিময়ে কোম্পানিগুলো কীভাবে জটিল আইনের মারপ্যাঁচ নতুন লাইসেন্স প্রক্রিয়াগুলোর সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারবে সে বিষয়ে সহায়তা করবেন।

চীনের উন্মুক্ত বাজার নীতির ফলে তিন দশক ধরে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত অর্থনীতির দেশগুলো কতটা লাভবান হয়েছিল, তা হয়তো মার্কিন প্রশাসন ভুলে গিয়েছে। যদিও প্রক্রিয়াটি একেবারে নিখুঁত ছিল না; বিদেশী কোম্পানিগুলো চীনের বাজারে যতটা প্রভাব বিস্তার করার আশা করেছিল তা অর্জন করতে পারেনি। সে সময় চীন থেকে সরাসরি পণ্য আমদানি প্রতিযোগিতার প্রভাবে যুক্তরাষ্ট্রের শ্রম খাত এসব দেশগুলোকে অধিক মূল্য চুকাতে হয়েছে। এর আগে বিশ্ব বাণিজ্য ব্যবস্থাপনায় চীনের জোরালো উপস্থিতির প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রতিষ্ঠান বা গোষ্ঠীর ক্ষতি কমাতে দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষ কখনই যথাযথ পদক্ষেপ নেয়নি। তাই বলে চীনের প্রযুক্তিগত অর্থনৈতিক উন্নয়ন বাধাগ্রস্ত করতে দেশটির অর্থনীতির গলা টিপে ধরা, সমস্যার সঠিক সমাধান নয়।

অনেকেই আশা করছেন, সম্প্রতি ইন্দোনেশিয়ায় অনুষ্ঠিত জি ২০ শীর্ষ সম্মেলনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং সমঝোতা বিষয়ে যে আলোচনা করেছেন, তা ফলপ্রসূ হবে। সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক শাসনের দিক দিয়ে যুক্তরাষ্ট্র চীনের মধ্যে বিস্তর ফাঁরাক থাকলেও অতীতে বিশ্বের শীর্ষ অর্থনীতির দেশ দুটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান করতে এবং সমৃদ্ধি অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

সর্বোপরি নতুন অর্থনৈতিক যুদ্ধ হয়তো যুক্তরাষ্ট্রকে চড়া মূল্যের এক বিজয় এনে দেবে। তবে সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয় হলো, এটি নতুন একটি শীতল যুদ্ধের সূচনা ঘটাতে পারে এবং সেই সঙ্গে আমাদের সামরিক যুদ্ধের আরো এক ধাপ কাছে নিয়ে যেতে পারে। সে রকম কিছু ঘটলে আর যা হোক, তা কারো জন্যই মঙ্গলজনক নয়।

[স্বত্ব:প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

 

পিনেলোপি কুজিয়ানো গোল্ডবার্গ: ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক; বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ আমেরিকান ইকোনমিক রিভিউর সাবেক প্রধান সম্পাদক

 

ভাষান্তর: আল আমিন হাওলাদার

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন