অভিমত

উন্নয়ন ও ‘চাষার পুতে’র বঞ্চনা

তৌফিকুল ইসলাম

সুজলা, সুফলা শস্য শ্যামলা বাংলার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে যে ফসল উৎপাদন হয়ে আমাদের খাবারের পাতে অন্ন হিসেবে আসে, বিরাট কর্মযজ্ঞের নেপথ্য কারিগর যারা তাদের কতটা মূল্যায়ন করা হয় এমন প্রশ্নের উত্তর যেন আজও অমীমাংসিত হয়ে আছে। অর্থাৎ কাজী নজরুল ইসলামের ভাষ্যমতে, শক্তির পেছনে রুধির ধারার মতো যারা মানুষের পাতে অন্নের ব্যবস্থা করেন তারা সমসময় অবহেলিতই থেকে গেছেন। সে ধারা আধুনিক নগর সভ্যতার চরম উত্কর্ষের যুগেও অব্যাহত রয়েছে।

এখন আমন ধানের মৌসুম চলছে, প্রতিকূলতার মধ্যেও কৃষকের সেচকার্যের ফলে চলতি বছর আমন ধানের ব্যাপক ফলন হয়েছে। এর ফলে সারা বিশ্বে খাদ্য সংকট হলেও বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা নেই বলে বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি (ডব্লিউএফপি) জানিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য ইতিবাচক সংবাদ। আমরা এভাবেই আশান্বিত হতে চাই।

এদিকে অর্থনৈতিক মন্দার কারণে বৈশ্বিক খাদ্য সংকট হতে পারে আশঙ্কা থেকে সংকট মোকাবেলায় বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের সব ব্যাংকগুলোকে শিল্পঋণের চেয়ে কৃষি খাতে ঋণ বিতরণে গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছে। এমনকি বিশ্বব্যাংক আইএমএফও কৃষিঋণের ওপর গুরুত্বারোপের পরামর্শ দিয়েছে। এক্ষেত্রে ব্যাংকাররাও বলছেন, প্রান্তিক পর্যায়ের ঋণে ক্ষতির পরিমাণ অনেক কম।

তার অর্থ দাঁড়ায় কৃষি খাতে ঋণ দিয়ে ব্যাংকগুলোর বিপুল ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা নেই, কিন্তু তার পরও এক্ষেত্রে পর্যাপ্ত ঋণসহায়তা নিয়ে ব্যাংকগুলো কৃষকের পাশে থাকে না, এমন অভিযোগ অতীতে থাকলেও কৃষি ঋণের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকের দৃষ্টিভঙ্গি উদ্যোগ পরিবর্তন হচ্ছে। এক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য, গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ২৮ হাজার ৩৯১ কোটি টাকার চেয়ে বেশি। কৃষি খাতের প্রতি ব্যাংকগুলোর এমন সহযোগিতাপূর্ণ মনোভাব আমাদের আশাবাদী করে তোলে।

এছাড়া সরকারিভাবে সারা দেশের ২৭২ উপজেলায় কৃষকের কাছ থেকে আমন ধান কেনার ক্ষেত্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলাসহ যে জটিলতা ছিল তা নিরসনে সম্প্রতি কৃষকের অ্যাপের মাধ্যমে ধান কেনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, যা কৃষকের ভোগান্তি লাঘবে ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা যাচ্ছে। তবে কৃষকের কাছে প্রযুক্তির সহজ ব্যবহার দ্রুত পৌঁছে দেয়ার জন্য খাদ্য অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে যে ১৩টি নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, সেগুলোও অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা উচিত। আমরা প্রত্যাশা করি, সরকারের পাইলট প্রকল্প সফলতার মুখ দেখবে এবং এতদিন ধরে সরকারি খাদ্যগুদামে ধান সরবরাহের ক্ষেত্রে কৃষকের যে অনিহা ছিল সেটি দূর করতে সহায়তা করবে। এক্ষেত্রে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খোলার বাধ্যবাধকতার পরিপ্রেক্ষিতে মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের ব্যবহার করা যায় কিনা সেটিও বিবেচনা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজনে ডাক বিভাগের ডিজিটাল লেনদেন ব্যবস্থানগদকে কাজে লাগানো উচিত। মোটকথা, শস্য সরবরাহ এবং এক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় আর্থিক ব্যবস্থার সুযোগ একেবারে কৃষকের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যেতে হবে। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রচারণা চালিয়ে কৃষককে উদ্বুদ্ধ করার যে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, আশা করি সেগুলোর বাস্তবায়ন করা হবে।

অর্থনীতিবিদদের পূর্বাভাস অনুযায়ী এখন দরকার খাদ্য উৎপাদনের দিকে মনোযোগ দেয়া। এজন্য কৃষককে সর্বাত্মক সহায়তা করতে হবে। এটা সত্য যে শিল্পের প্রসারের ফলে কৃষিজমি কমে গিয়েছে। ক্রমবর্ধমান নগরায়ণের ফলে কৃষি জমির পরিমাণ আরো কমছে। সভ্যতার বিকাশে দিকটি অস্বীকার করার উপায় নেই, কিন্তু কৃষিজমি যেন টিকে থাকে এবং আবাদশীল জমিতে স্বতঃস্ফূর্ত কৃষি উৎপাদনের জন্য সবাইকে উদ্যোগী হতে হবে। এখন কথা হচ্ছে, কৃষিকাজের প্রতি আমাদের যে দৃষ্টিভঙ্গি সেটি আসলে কৃষি বিকাশে কতটা ভূমিকা রাখছে? সেই সঙ্গে কৃষকের প্রতি অবহেলার যে ব্যবস্থাপনা আমরা প্রান্তিক পর্যায় থেকে শুরু করে শহরের বাজার পর্যন্ত ছড়িয়ে রেখেছি, সে বৃত্তকে অতিক্রম করার মানসিকতা আমাদের রয়েছে কিনা?

কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না, এমন কঠিন অভিঘাতের মধ্য দিয়ে আমরা শহরে উচ্চমূল্যে কৃষিপণ্য ক্রয় করি। অথচ বৃত্ত ভাঙার কেউ যেন নেই, যে পণ্য কৃষক খেত থেকে খুবই নিম্নমূল্যে বিক্রি করেন, সেটি শহরের বাজারে আসার আগে কয়েক হাত ঘুরে শেষ পর্যন্ত উচ্চমূল্যে বিক্রি হয়। মধ্যস্বত্বভোগী যারা কৃষিপণ্য থেকে বিপুল পরিমাণ মুনাফা লাভ করে তারা কি আদৌ ভাবে ন্যায্যমূল্য না পেয়ে কৃষক যদি ফসল আবাদ করা বন্ধ করে দেন তখন তাদের রকম অন্যায়ভাবে লাভবান হওয়ার সুযোগের কী হবে?

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি অনলাইন নিউজ পোর্টালের বরাতে দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর কৃষক আজাদের আক্ষেপের দৃশ্য ভাইরাল হয়েছে। কৃষিকাজের উপার্জন দিয়ে সংসার চালাতে না পেরে তিনি এর পাশাপাশি শহরে রিকশা চালান। রিকশা চালাতে গিয়ে কারো দুর্ব্যবহারের শিকার হলে তিনি মনে মনে আক্ষেপ করে বলেন, ‘আমার মতো গরিব যদি আবাদ না করে, তাহলে দেশের মানুষের পেটে ১০০ টাকা কেজিতেও ভাত জুটবে না।

মোদ্দাকথা, কৃষকের রক্ত পানি করা টাকায় ধান হয়, অথচ মানুষ কৃষককে মর্যাদা দেয় না।চাষার পুতশব্দটিকেও গালি সম্বোধনেই ব্যবহার করা হয়। কিন্তু একবারও ভাবা হয় না কৃষক যদি ফসল না ফলান তাহলে আমাদের পেটে অন্ন কীভাবে আসবে? তাই দেশের জন্য যত উন্নয়ন পরিকল্পনাই করা হোক না কেন, কৃষিকে বাদ দিয়ে কোনো উন্নয়ই টেকসই হবে না সেটি নিশ্চিত করে বলা যায়। 

চলতি বছর দেশের খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক হাজার কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন স্কিম গঠন করেছে। তহবিল থেকে কৃষক শতাংশ সুদে ঋণ পাবেন। এছাড়া গত জুলাইয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্যকৃষি পল্লী ঋণ নীতিমালা কর্মসূচিঘোষণায় প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক, যা গত অর্থবছরের চেয়ে দশমিক ৮৮ শতাংশ বেশি।

ফসল সবজি চাষে চলতি অর্থবছরে ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে ১১ হাজার ৭৫৮ কোটি এবং বেসরকারি ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ১৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা বিতরণ করা হবে।

এভাবে সংকটকালীন সময়ে কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা গ্রহণ করা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। এক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে অবশ্যই দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মতো সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীকে ঋণ দেয়ার ক্ষেত্রে ১৩টি ব্যাংক কোনো ঋণ দেয়নি এমন উদাহরণ যুক্ত হবে না সেটিও আমরা আশা করতে পারি। বস্তুত একশ্রেণীর ব্যবসায়ী সম্পদের চাহিদার ক্ষেত্রে ব্যবসার কথা বলে ঋণ নিয়ে প্রকৃত ব্যবসা না করে গাড়ি-বাড়ি বানিয়ে ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে ডিফল্টার হয়ে যান। খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার ১৯ নভেম্বর এমন অনুযোগ প্রকাশ করেছেন। রকম চিত্র ধনাঢ্য ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে হলেও দরিদ্র কৃষক প্রয়োজনে নিজে না খেয়ে এমনকি অনেক প্রয়োজনীয় খরচ না করে হলেও ঋণের টাকা জমা দিয়ে দেন, এমন চিত্রই দেখা যায়। তাই তো মাঠপর্যায়ে এনজিওগুলো ক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম এত জোরদার করতে পেরেছে। অর্থাৎ তুলনামূলক পরিসংখ্যান ঘাঁটলে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ক্ষেত্রে কৃষি খাতে অনাদায়ি ঋণের পরিমাণটা বড় মাপের ঋণের বিপরীতে অনাদায়ের তুলনায় কম পাওয়া যাবে। এটিকে আমলে নিয়ে ব্যাংকগুলোর নিজস্ব আর্থিক পরিকল্পনা প্রণয়ন করা উচিত।

সংকট এলে দেশের কোনো খাতই শঙ্কামুক্ত থাকবে না, তাই খাদ্য সংকট এড়াতে কৃষি উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। এজন্য কৃষিকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণমূলক ভূমিকা আরো বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের উচিত বাজার নিয়ন্ত্রণ এবং বাজারে যেন খাদ্য সরবরাহে বিশৃঙ্খলা না হয় সেজন্য ন্যায্যমূল্যে কৃষকের কাছ থেকে কৃষিপণ্য কেনা। সব মিলিয়ে বর্তমান সময়টা আসলে হেলাফেলা করার মতো নয়। সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিলে আমাদের ভুগতে হবে না। না হলে ভবিষ্যতে ভয়াবহ দুর্দশার ভেতর হাবুডুবু খেতে হবে। তাই সময় থাকতেই কৃষিকাজের গুরুত্ব উপলব্ধি কৃষকের মর্যাদা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা আশাবাদী হতে চাই, বাংলাদেশে আর কোনো দুর্ভিক্ষ কেউ প্রত্যাশা করে না। এজন্য কৃষি খাতকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট সবাই অগ্রণী ভূমিকা রাখবে, সেটিই সবার প্রত্যাশা।

 

তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন