কৃষিঋণের ৫০ শতাংশ সরাসরি বিতরণের আহ্বান গভর্নরের

কৃষকের স্বার্থরক্ষায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ভূমিকা বাড়াতে হবে

কৃষিকে অগ্রাধিকার দিয়ে অর্থনৈতিক নীতিমালা প্রণয়ন যেকোনো রাষ্ট্রের জন্য সুফল বয়ে আনে। এক্ষেত্রে কৃষির কোনো বিকল্প নেই, এমন দৃষ্টিভঙ্গি লালন অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। কিন্তু আর্থিক খাতে কৃষিকে অবহেলা করা হয়, এমন অভিযোগ বেশ পুরনো। তবে এর মধ্যেই কৃষিঋণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন হচ্ছে, এমন দৃশ্যপট আমাদের দেশের জন্য উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন বয়ে আনবে, সে আশা করাই যায়।

ব্যাংক খাতে কৃষককে ঋণসহায়তা দেয়া সরকারের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অংশ। ফলে কৃষক সহজ শর্তে ঋণ পেয়ে কৃষিকাজে অধিক মনোযোগী হয়ে দেশের খাদ্যনিরাপত্তায় ভূমিকা রাখতে পারছেন। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের পাশাপাশি বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কৃষকের পাশে দাঁড়াবে, সেটিই অর্থনীতি-সংশ্লিষ্টদের প্রত্যাশা। বণিক বার্তায় প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, কৃষিঋণের অন্তত ৫০ শতাংশ বাণিজ্যিক ব্যাংকের মাধ্যমে সরাসরি কৃষকের মাঝে বিতরণের আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। কৃষি খাতে ঋণ বিতরণ বৃদ্ধির লক্ষ্যে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রধান নির্বাহীদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় তিনি আহ্বান জানান।

উল্লেখ্য, প্রতি বছরই ব্যাংকগুলোকে কৃষিঋণ বিতরণে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। লক্ষ্যমাত্রার যে পরিমাণ ঋণ বাণিজ্যিক ব্যাংক বিতরণ করতে পারে, সে পরিমাণ অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংক জমা নিয়ে নেয়। অর্থের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংক কোনো ধরনের সুদ দেয় না। পরবর্তী বছরে লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হলে অর্থ ফেরত পায় বাণিজ্যিক ব্যাংক। এজন্য লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সরাসরি বিভিন্ন এনজিও বা সংস্থার মাধ্যমে ঋণ বিতরণের সুযোগ রয়েছে। সেক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রার কমপক্ষে ৩০ শতাংশ ব্যাংকগুলোকে সরাসরি বিতরণ করতে হয়। অবশিষ্ট ৭০ শতাংশই অন্য কোনো সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ করার সুযোগ থাকে। এবারের বৈঠকে সরাসরি ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণ লক্ষ্যমাত্রা ৩০ থেকে বাড়িয়ে অন্তত ৫০ শতাংশে উন্নীত করার তাগিদ দেন গভর্নর। এর পক্ষে যুক্তি হিসেবে বলা হয়, ব্যাংকের মাধ্যমে কৃষিঋণ বিতরণ করলে শতাংশ সুদে কৃষক পর্যায়ে ঋণ পৌঁছানো সম্ভব হয়। কিন্তু এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করলে ২২-২৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিতে হয় কৃষককে। সভায় বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর একেএম সাজেদুর রহমান খান কৃষিঋণ বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক আনোয়ারুল ইসলামসহ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

বাংলাদেশ ব্যাংক কৃষকের স্বার্থ বিবেচনা করেই এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ কৃষকের হাতে সরাসরি সহজ শর্তে ঋণ পৌঁছে দিলে তাতে কৃষকেরই উপকার হয়। এক্ষেত্রে ব্যাংক খাতের মাধ্যমে ঋণ বিতরণ করলে কৃষকের জন্য কৃষিকাজে ঋণের টাকা ব্যয় করায় ভোগান্তি থাকে না। কারণ এনজিওগুলো অনেক বেশি সুদে কৃষকের কাছে ঋণ বিতরণ করে। এমনিতেই কৃষক ফসলের ন্যায্যমূল্য পান না, এমন অভিযোগ কঠিনভাবেই রয়েছে। এর সঙ্গে সার ডিজেলের মূল্যবৃদ্ধি কৃষকের জন্য ফসল উৎপাদনের ব্যয় অনেক বাড়িয়ে তুলেছে। অবস্থায় কৃষিকাজের খরচ বেড়ে গেলে কৃষক যেন উৎপাদনবিমুখ হয়ে না পড়েন সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তাই এনজিওর মাধ্যমে বেশি সুদে ঋণ নিলে সেটি কৃষকের জন্য স্বস্তিদায়ক হবে না। মূলত জায়গাটি বিবেচনা করেই বেসরকারি ব্যাংকগুলোর প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের আহ্বান। কৃষকের স্বার্থ রক্ষা করে কৃষিকাজে উদ্বুদ্ধ করতে বাংলাদেশ ব্যাংক সাম্প্রতিক সময়ে বেশকিছু প্রশংসনীয় উদ্যোগ নিয়েছে, যা বর্তমানে সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনার ভিত্তিতে বাস্তবায়নের অপেক্ষায় রয়েছে। এর মধ্যে গত জুলাইয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জন্যকৃষি পল্লী ঋণ নীতিমালা কর্মসূচিঘোষণায় প্রায় ৩১ হাজার কোটি টাকার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক যা গত অর্থবছরের চেয়ে দশমিক ৮৮ শতাংশ বেশি।

এছাড়া ফসল সবজি চাষে চলতি অর্থবছরে ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকার কৃষিঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের মাধ্যমে বিতরণ করা হবে ১১ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকা এবং বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে ১৯ হাজার ১৫৩ কোটি টাকা। উল্লেখ্য, গত অর্থবছরে ব্যাংকগুলোর মাধ্যমে ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা কৃষিঋণ বিতরণ করা হয়, যা নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রা ২৮ হাজার ৩৯১ কোটি টাকার চেয়ে বেশি।

ব্যাংক খাতের সংগঠন অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্সের পক্ষ থেকেও চলমান পরিস্থিতি বিবেচনায় কৃষিঋণে গতি বাড়াতে গভর্নরের বিশেষ তাগিদের প্রতি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। তাদের মতে, প্রান্তিক পর্যায়ের ঋণ তুলনামূলক ঝুঁকিমুক্ত। ঋণ সাধারণত খেলাপি হয় না। অর্থাৎ সবদিক বিবেচনায় কৃষককে নিশ্চিন্তে ঋণসহায়তা দেয়া যেতে পারে। মনে রাখতে হবে, কৃষককে অবহেলা করে টেকসই উন্নয়ন সম্ভব নয়। এজন্য কৃষিঋণ বিতরণে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর জোরালো ভূমিকা প্রয়োজন। কোনো ব্যাংক যেন ঋণ বিতরণ থেকে বিরত না থেকে সেটি কেন্দ্রীয় ব্যাংককে তদারক করতে হবে। পরিপ্রেক্ষিতে বড় ব্যবসায়ীদের ঋণ প্রদানের তুলনায় কৃষককে ঋণ দেয়ার ঝুঁকি অনেক কম। কৃষক সাধারণত ঋণখেলাপি হন না। ফসলের ন্যায্যমূল্য না পেলেও তারা ঠিকই সময়মতো ঋণ পরিশোধ করেন। যে কারণে দেশব্যাপী এনজিওগুলো তাদের ঋণ কার্যক্রমের বিস্তার ঘটাতে সক্ষম হয়। অথচ সরল বিশ্বাসের মেহনতী কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর প্রধান দায়িত্ব হওয়া উচিত ছিল বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর। সেটি প্রত্যাশিতভাবে না হওয়ায় এনজিওগুলোর সুযোগ প্রসারিত হয়েছে। যা হোক, অর্থনৈতিক পরিকল্পনার ক্ষেত্রে যেকোনো সিদ্ধান্তই পুনর্বিবেচনা করা সম্ভব। যেহেতু করোনা মহামারী পরবর্তী সময়ে চলমান রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে আগামী বছর বিশ্বে ভয়াবহ খাদ্য সংকট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, সেক্ষেত্রে কৃষিকে বর্তমান সময়ে অবহেলার কোনো সুযোগই নেই। বিশ্বব্যাংক আইএমএফও কৃষি খাতে ঋণ প্রদানের প্রতি গুরুত্ব দেয়ার কথা বলেছে। সব মিলিয়ে উদ্দেশ্য যেহেতু কৃষককে ঋণসহায়তা দেয়া, তাই এটি যতটা সহজলভ্য হিসেবে কৃষকের কাছে পৌঁছে দেয়া যায়, সেদিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করব, যে উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে, তা যথার্থরূপে পালন করা হবে। কৃষক সহজ শর্তে ঋণ পাবেন এবং চড়া সুদে ঋণ পরিশোধের দুশ্চিন্তা ছাড়াই ফসল উৎপাদন করবেন, সেটিই আমাদের কাম্য।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন