মামুন রশীদ ব্যাংকার ও অর্থনীতি বিশ্লেষক। স্নাতকোত্তর ডিগ্রি নিয়েছেন অর্থনীতি ও ব্যবসায় প্রশাসনে। পেশাগত দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য গেছেন যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিজনেস স্কুল, কেলগ স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট, কলাম্বিয়া বিজনেস স্কুল, যুক্তরাজ্যের লন্ডন বিজনেস স্কুল, ক্রেনফিল্ড স্কুল অব ম্যানেজমেন্ট, ফ্রান্সের ইনসিয়াড ও ভারতের ইন্ডিয়ান স্কুল অব বিজনেসে। প্রিয় বিষয় প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন, বাজার সংস্কার ও উন্নয়ন। প্রায় ২৫ বছর কাজ করেছেন বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় তিনটি আন্তর্জাতিক ব্যাংকে, দেশে ও বিদেশে। পাশাপাশি ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষক হিসেবে সম্পৃক্ত রয়েছেন প্রায় ৩০ বছর। বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক ও ইউএনডিপির পরামর্শক হিসেবেও কাজ করছেন প্রায় এক যুগ ধরে। সম্প্রতি তিনি বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট ও আর্থিক খাত নিয়ে বণিক বার্তার নানা প্রশ্নের উত্তর দিয়েছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন এম এম মুসা
বাংলাদেশে বর্তমানে তিনটি সংকটকে মুখ্য হিসেবে চিহ্নিত করছেন বিশেষজ্ঞরা—মূল্যস্ফীতি, ডলারের সংকট ও জ্বালানি। সংকটগুলো কেন তৈরি হলো? এটা কি বহির্বিশ্বের প্রভাব নাকি অভ্যন্তরীণ নীতি পরিকল্পনার দুর্বলতার ফল?
বাংলাদেশে বেশ কয়েক
দিন ধরে
অর্থনীতি পরিচালনায় কেন্দ্রীভূত উদ্যোগের বহিঃপ্রকাশ ঘটছে। কেন্দ্রীভূত উদ্যোগ
বা কয়েক
ব্যক্তির উদ্যোগ
যে খুব
একটা কাজ
করে না
এটা তারই
প্রমাণ। বিশেষভাবে আমরা দেখতে পাচ্ছি
বিপিসির সংরক্ষণাগারগুলোয় কী পরিমাণ তেল
আছে, ইস্টার্ন রিফাইনারি কী পরিমাণ
তেল পরিশোধন
করছে কিংবা
সরকারি খাদ্যগুদামগুলোয় কী পরিমাণ খাদ্য
সংরক্ষিত আছে
অথবা খাদ্যের
চাহিদা—জোগান,
সাপ্লাই চেইন
ব্যবস্থাপনা প্রভৃতি
অনেকটা খামখেয়ালির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছিল।
কয়েক মাস
ধরে বিজ্ঞাপন চলছে ‘ঘরে ঘরে
বিদ্যুৎ’। আজ হঠাৎ
করে কী
হলো যে
লোডশেডিং করতে
হচ্ছে। দ্বিতীয়ত, বিদ্যুতের ক্যাপাসিটি পেমেন্ট
যে মহীরুহ
আকার ধারণ
করবে, বিদ্যুৎ
উৎপাদন না
করেও উৎপাদক
প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগ
ঝুঁকি মোকাবেলায় সরকারের বেশকিছু টাকা
নিয়ে নেবে—এটা সরকার
বুঝতে পারেনি।
তারা গ্রিডকে
বিদ্যুৎ দিতে
পারছে না।
আসলে তারা
বিদ্যুৎ উৎপাদন
করছে কিনা
সেটার অডিট
কে করছে?
তৃতীয়ত, সরকারের
সামগ্রিক আমদানি
কীভাবে নিষ্পন্ন হচ্ছে? সরকার যে
আমদানি ঋণপত্রগুলো খুলেছে, সেটার বিপরীতে
ব্যক্তি খাতে
যেমন হয়,
তেমন করে
সরকারের আমদানি
খতিয়ে দেখা
হয়েছে কি?
চতুর্থত, সরকারের
সামগ্রিক অর্থের
ব্যবহারে যে
পরিমাণ শৃঙ্খলা
আমরা অতীতে
দেখতে পেয়েছি,
অর্থ বিভাগের
পক্ষ থেকে
অর্থ ব্যয়
ও অর্থ
আয়ে জাতীয়
রাজস্ব বোর্ডের
পক্ষ থেকে
যে শৃঙ্খলাটুকু আমরা আগেও বিভিন্ন
সময় লক্ষ
করেছিলাম, সেটা
ধীরে ধীরে
ঢিলে হয়ে
গেছে। অ্যাকাউন্টটিবিলিটির ক্ষেত্রে কভিডকে কিছুটা
দায়ী হয়তো
আমরা করতে
পারি। কভিডকালীন যে উদ্ভূত অবস্থা
ছিল, সেখানে
বিশেষ ব্যবস্থার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু
আমরা যখনই
দেখলাম অর্থ
বিভাগের অর্থ
ব্যয়ের শৃঙ্খলার বিষয়টি রাজনৈতিক কিছু
নেতার বক্তব্যে এসেছে, তখনই আমরা
সন্দেহের মধ্যে
পড়ে গেলাম।
গ্রামগঞ্জে রাজনৈতিক বিবেচনায় থোক বরাদ্দ
দেয়া হচ্ছে।
কোথাও যদি
বিরোধীদলীয় এমপি
হয়, সে
এলাকায় বরাদ্দ
কম। গেল
কয়েক বছরে
আমরা দেখেছি
রাজনৈতিক নেতাদের
পাশ কাটিয়ে
কিছুসংখ্যক সরকারি
কর্মকর্তা সর্বেসর্বা হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন।
এটাকে আমি
খারাপ চোখে
দেখি না।
তারা হয়তো
অপেক্ষাকৃত সৎ।
তবে সরকারি,
সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার একটা সমস্যা হচ্ছে
‘চেইন অব
কমান্ড’। তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারেন
না। আরেকটি
বিশেষ বিষয়
হচ্ছে, কোনো
বিষয় যদি
মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নজরদারিতে না আসে
তাহলে কোনো
সিদ্ধান্ত হয়
না। সিদ্ধান্ত গ্রহণে শৈথিল্যের কারণে
খাদ্যনিরাপত্তার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় মজুদ নেই। একটা
সময় শুনতে
পেয়েছিলাম তিন
সপ্তাহের জ্বালানি রয়েছে। তারপর আছে
প্রচুর দুর্নীতি। বাংলাদেশের অর্থনীতি যে
পরিমাণ বড়
হয়েছে এবং
বাংলাদেশের সরকারের
সিদ্ধান্ত মোতাবেক
চালিত অর্থনীতি যে পরিমাণ বড়
হয়েছে, সে
পরিমাণে সরকারি
কর্মকর্তাদের সক্ষমতা
বাড়েনি। সরকারি
প্রতিষ্ঠানে বেসরকারি খাতের মতো দ্রুত
সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। অনেক সরকারি প্রকল্প
বাস্তবায়ন হচ্ছে।
কিন্তু সরকার
দক্ষ প্রকল্প
পরিচালক পায়
না। প্রকল্পে প্রচুর দুর্নীতি হয়।
প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রচুর শৈথিল্য ও দক্ষতার অভাব
রয়েছে। অডিট
হতে গিয়ে
আবার প্রকল্প
পিছিয়ে যায়।
বেশির ভাগ
প্রকল্প সরকার
ঠিক সময়ে
শেষ করতে
পারেনি এবং
প্রকল্পগুলোর ব্যয়
বেড়ে গেছে।
প্রকল্পে অনেক
সময় ঠিকাদার
প্রতিষ্ঠান সরকারকে
জিম্মি করে
বরাদ্দ বাড়িয়ে
নিয়েছে। ফলে
সরকারের আয়
কমে গেছে,
ব্যয় যথেচ্ছভাবে বেড়েছে। সরকার অভ্যন্তরীণভাবেও অর্থ সংকটে পড়ে
গেছে। বাংলাদেশ শ্রীলংকা হবে না
দেখে আত্মতৃপ্তিতে ভুগছিলাম। সবাই ডিফেন্ড
করছিল, কিন্তু
শ্রীলংকা যাতে
না হতে
হয় সে
কারণে আমাদের
কী কী
করা উচিত
ছিল তা
কি করা
হয়েছে? আমরা
কি চ্যালেঞ্জ ও সংকট পর্যালোচনা করেছি?
অনেকে
বলছেন টাকাকে
অনেক আগেই
ধীরে ধীরে
অবমূল্যায়ন করা
উচিত ছিল।
সেটা করা
হয়নি, বরং
উল্টো ব্যাংকগুলোকে ধমক দেয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কিছুসংখ্যক লোকের প্রধান
দায়িত্ব ছিল
বিনিময় হারের
বেশি যাতে
কেউ ডলার
বিক্রি করতে
না পারে
সেটি দেখা।
এ কারণে
রিয়েল ইফেক্টিভ এক্সচেঞ্জ রেট অনেক
উচ্চ কিন্তু
বাজারে ডলার
বিক্রি হচ্ছে
আরো কমে।
তথাপি হঠাৎ
করে আবার
‘কমান্ড ইকোনমি’
চালু করা
হলো সার্কুলার দিয়ে। ডলার বাজারে
প্যানিক সৃষ্টি
হয়েছে। যারা
আমাদের বৈদেশিক
বাণিজ্য ব্যবস্থাপনা করে তারাও প্রশ্ন
করা শুরু
করল বাংলাদেশে ডলার নেই। আইএমএফের হিসেবে যদি ২৭
বিলিয়ন ডলার
রিজার্ভ হয়,
তাও কিন্তু
সাড়ে তিন
মাসের আমদানি
ব্যয় মেটানোর
জন্য যথেষ্ট।
কিন্তু মানুষ
আস্থার সংকটে
ভুগছে। দুঃখজনক
বিষয় হলো,
এত বছরেও
বৈদেশিক মুদ্রার
ব্যবস্থাপনা ম্যানুয়ালটাকে ঢেলে সাজানো গেল
না। সরকার
বেসরকারি খাতকে
বিশ্বাস করতে
পারে না।
অথচ তারা
জানে সংকটে
কোথা থেকে
খাদ্য আমদানি
করা যায়।
অস্ট্রেলিয়া না
হলে আর্জেন্টিনা, আর্জেন্টিনা না দিতে
পারলে কে
দিতে পারে?
রাশিয়া। রাশিয়া
না দিতে
পারলে কে
দিতে পারে?
ইউক্রেন। ইউক্রেন
না দিতে
পারলে মালয়েশিয়া, মালয়েশিয়া না দিতে
পারলে...। ব্যক্তি খাত
যা জানে
বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তা জানে না।
বাংলাদেশের ব্যক্তি
খাত ১৭
কোটি মানুষকে
চাল, ডাল,
লবণ, চিনি
ও তেল
খাওয়াচ্ছে। বাণিজ্য
মন্ত্রণালয়ের ভাষায়
প্রয়োজনীয় নয়টি
পণ্য আমদানি
ও বাজারজাত কিন্তু বেসরকারি খাতের
মাধ্যমেই হচ্ছে।
মানুষ সঞ্চয় ভেঙে ফেলছে, খেলাপি ঋণও বাড়ছে। আর্থিক খাতে কি বড় কোনো সংকট আসন্ন?
কভিড উপলক্ষে ঋণ
পরিশোধে শৈথিল্য
দেখানো হয়েছে,
এখন অর্থনৈতিক সংকটের কথা বলে
শৈথিল্য দেখানো
হচ্ছে। এত
কিছুর পরও
খেলাপি ঋণ
বাড়ছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)
কয়েক বছর
আগেই বলেছিল,
বাংলাদেশে শ্রেণীভুক্ত ঋণের হার মোট
ঋণের ২০
শতাংশের ওপরে।
তারা বিভিন্ন
মানুষের সঙ্গে
কথা বলে
এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। ঋণ পুনঃতফসিলীকরণ চলছে তো চলছেই।
ফলে আমরা
প্রকৃত অবস্থাটা বুঝতে পারছি না।
কভিডে যারা
স্বল্প সুদে
ঋণ পেয়েছে,
তারা বিদ্যমান ব্যবসায়ী। নতুন উদ্যোক্তারা ঋণ পাননি। গ্রামীণ
উদ্যোক্তাদের কাছে
কী পরিমাণ
নতুন ঋণ
গিয়েছে? খুব
কমই গিয়েছে।
যে যুক্তি
দেখানো হয়েছে,
৯ শতাংশ
হারে যদি
ঋণ দেয়া
হয় তাহলে
গ্রামে অর্থ
যাবে। সেটি
একটি ভুল
যুক্তি ছিল,
যা আজ
প্রমাণিত। বলা
হয়েছিল, ব্যাংক
কিছু কিছু
এনজিওকে ঋণ
দেবে, এনজিওরা
ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের ঋণ দেবে। এ প্রক্রিয়া খুব
একটা কাজ
করেনি। ফলে
নতুন ঋণ
তৈরি হয়নি,
শুধু পুনঃতফসিলীকরণ হয়েছে। সবকিছু মিলে
ঋণের বাজারে
ছোটখাটো একটি
দুষ্টচক্র হয়ে
গিয়েছে। এ পর্যায়ে ক্রনি
ক্যাপিটালিজমের কথা
আমরা মনে
করতে পারি।
উচ্চমূল্যস্ফীতির মধ্যেও সুদের হার
নির্দিষ্ট করে
রাখা হয়েছে।
আমানতের সুদের
হার মূল্যস্ফীতির চেয়েও কম। একটা
পর্যায়ে এসে
মানুষের নাভিশ্বাস উঠেছে। মানুষ চিন্তা
করল, সঞ্চয়পত্র কিনি। সঞ্চয়পত্রের সুদের
হারও কমানো
হয়েছে, এটি
ক্রয়ে লিমিট
আরোপ করা
হয়েছে। অর্থ
চলে গেল
লিজিং কোম্পানির কাছে। তারা বেশি
সুদ দিচ্ছিল। তারপর পিপলস লিজিং
বা উত্তরা
ফাইন্যান্সের অডিটের
ঘটনায় সামগ্রিকভাবে নন-ব্যাংক আর্থিক
প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) ওপর একটা চাপ
তৈরি হয়েছে।
এনবিএফআই থেকে
ঋণ নেয়ার
জন্য কিছু
লোক রাজি
ছিল। কিন্তু
এনবিএফআই পর্যাপ্ত টাকা পায় না।
তারা যদি
৭ শতাংশে
অর্থ না
পায়, তাহলে
১১ শতাংশে
কীভাবে ঋণ
দেবে? দ্বিতীয়ত, পিপলস লিজিং ও উত্তরা ফাইন্যান্সকে কেন্দ্র করে আর্থিক
প্রতিষ্ঠান ঘিরে
একটা অনাস্থার সৃষ্টি হয়েছে। ব্যাংকগুলোও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে
তাদের ‘লাইফলাইন ক্রেডিট’ উঠিয়ে নিচ্ছে।
ব্যাংকগুলোয় প্রচুর তারল্য ছিল।
কিন্তু মন্দ
ঋণের কারণে
তাদের প্রচুর
অর্থ আটকে
যায়। অনেক
সরকারি প্রতিষ্ঠান মন্দ ঋণের ভাগী
হলো। যার
কারণে ব্যাংকগুলো নতুন ঋণ দিতে
পারছিল না।
ডলারের বিপরীতে
টাকার পতনের
কারণে কিছু
সঞ্চয়কারী ডলারে
সঞ্চয় শুরু
করল। এদিকে
হঠাৎ করে
প্রবাসী আয়
কমে গেল।
অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংক ডলার বিক্রি
শুরু করল।
যে কারণে
টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে গেল।
ব্যাংকিং সেক্টরের টাকাটা বাংলাদেশ ব্যাংকে
চলে গেল।
পাশাপাশি প্রচুর
ডলার বাইরে
যাওয়া শুরু
করল। যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়ায় অনেকে
বাড়ি কেনা
শুরু করে।
ইউটিউবে কিছু
ছবি দেখার
সুযোগ হয়েছে।
উপজেলা চেয়ারম্যান এমনকি এক-দুজন
ইউনিয়ন পরিষদের
চেয়ারম্যানের বিদেশে
বাড়ি আছে।
আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম তারা টাকাটা
কীভাবে পাঠান?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা কানাডায় ১০
হাজার ডলারের
বেশি জমা
দেয়া অত্যন্ত
কঠিন। তখন
আমরা ইউএই
ও সৌদি
আরবের কথা
জানতে পারলাম।
এ প্রসঙ্গে আমি কেন ইউএই
ও সৌদি
আরবকে আনলাম?
কারণ ইউএই
থেকে প্রবাসী
আয় আসা
সবচেয়ে বেশি
কমেছে। কারণ
এটা অন্য
জায়গায় চলে
যাচ্ছে। বিশেষ
করে ইউএই
থেকে যখন
ডলার যায়,
তখন প্রশ্ন
করা হয়
না। বাংলাদেশ থেকে ডলার গেলেই
প্রশ্ন করা
হয়। একই
মালিক বা
একই মালিকসংশ্লিষ্ট সুবিধাভোগী গ্রুপের ব্যাংকগুলো তাদের এক্সচেঞ্জ হাউজগুলো থেকে ডলারটা পাঠায়
না। ডলারটা
তারা অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, ইউএসএ, ইউকেসহ
অন্যান্য দেশে
পাঠিয়ে দিচ্ছে।
স্থানীয়ভাবে বিভিন্ন
মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের সুযোগ নিয়ে
টাকাটা ত্বরিত
পৌঁছে যাচ্ছে।
কেউ যদি
আপনার অ্যাকাউন্টে ডলার পাঠাতেন, আমরা
টাকাটা ব্যাংকে
ক্রেডিট করতাম।
এখন যেহেতু
মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা
প্রেরিত হচ্ছে,
সেহেতু ডলারটা
আসছে না।
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে কী কী কারণ রয়েছে বলে আপনি মনে করেন। আপনি একটি বহুজাতিক ব্যাংকের ট্রেজারি ব্যবস্থাপনার দায়িত্বও সামলিয়েছেন বেশ কয়েক বছর। এক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রক সংস্থা কর্তৃক কয়েকটি ব্যাংকের ট্রেজারিপ্রধানদের অপসারণ ও ব্যাংক এমডিদের চিঠি প্রদানকে কীভাবে দেখেন?
ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের কাজই
আন্তর্জাতিক বাজারে
বৈদেশিক মুদ্রার
বিনিময় হারের
ওঠানামাকে কেন্দ্র
করে আয়
করবে। আমার
জীবনের বড়
অংশ দেশে
ও বিদেশে
ট্রেজারি ডিলিং
রুমে কাটিয়েছি। সে অভিজ্ঞতা থেকে
বলছি, এটি
অন্যায় নয়।
সেখানে কোনো
কারসাজি বা
অপরাধ হয়েছে
কিনা তা
খতিয়ে দেখা
যেতেই পারে।
নিয়ম-কানুন
ঠিকমতো পরিপালিত হয়েছে কিনা সেটি
দেখা প্রয়োজন। বেশকিছু বিদেশী ব্যাংকের ডে-লাইট লিমিট
থাকে, ওভারনাইট লিমিট থাকে। মুদ্রা
অনুযায়ী লিমিট
থাকে। বিদেশী
ব্যাংকগুলো প্রয়োজনের নিরিখেই হয়তো ডলারটা
ধরে রেখেছে,
তাদের লিমিটটাও অনেক বড়। পরের
দিন হয়তো
ডলারের দাম
বেড়ে গেছে।
এতে হয়তো
তারা একটু
বেশি মুনাফা
করেছে। অনেক
সময় গ্রাহকই
ব্যাংককে ডলার
রাখতে বলেন।
কারণ গ্রাহক
হয়তো কোনো
কিছু আমদানি
করবেন। কিন্তু
দুদিন পরই
ডলারের দাম
বেড়ে গেছে।
এটি অপ্রত্যাশিত মুনাফা। এর জন্য
ব্যাংককে দায়ী
করা যায়
না। কোনো
ব্যাংক যদি
বাংলাদেশ ব্যাংকের লিমিটের বাইরে গিয়ে
ডলার ধরে
রাখে সেটাকে
চিহ্নিত করে
ব্যবস্থা নেয়া
যেতে পারে।
বাজারে এখন ডলারের বিভিন্ন হার বিদ্যমান। বৈদেশিক মুদ্রাবাজার স্থিতিশীলতার জন্য এটি কতটা কার্যকর বলে মনে করেন?
বৈদেশিক মুদ্রা ব্যবস্থাপনায় বাংলাদেশ ব্যাংকের অদক্ষতা রয়েছে। এটি ব্যবস্থাপনায় তাদের দক্ষ জনবলের অভাব রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের অর্থ চুরি হয়ে যাওয়ার পর তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। তারা একটি প্রতিবেদনও জমা দিয়েছে বলে শোনা যায়, কিন্তু সেটি এখনো জনসম্মুখে আসেনি। সেটি প্রকাশ হলে হয়তো কিছু দুর্বলতা চিহ্নিত করে তা ঠিক করা যেত। এমনকি সিআইডির প্রতিবেদনও জনসম্মুখে আনা হয়নি। জনসম্মুখে বা আদালতের নজরদারিতে আনলে বিষয়টা ভালো হতো। আদালত একটি শক্তিশালী বিষয়। কোনো কিছু আদালতের নজরদারিতে আনার মানেই জবাবদিহিতা সৃষ্টি হওয়া। আমরা কিন্তু জানতে পারিনি বাংলাদেশ ব্যাংক এটার মধ্যে কতটুকু দায়ী, বাইরের হ্যাকাররা কতটুকু দায়ী কিংবা কোন প্রসেস বা প্লাটফর্ম দায়ী। নাকি কোনো গাইডলাইন ছিল না? নাকি সুইফট প্লাটফর্মের ত্রুটি ছিল। আমাদের এখানে যত তদন্ত কমিটি হয়, সেখানে খাতসংশ্লিষ্ট কোনো বিশেষজ্ঞকে রাখা হয় না। সরকারি তদন্ত কমিটিগুলো কিংবা সরকার পরিচালিত তদন্ত কমিটিগুলোর প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হচ্ছে ব্যক্তিকে দায়ী করা। এ কারণে ত্রুটি থেকে যাচ্ছে। বিভিন্ন কারণে যে অঘটনগুলো ঘটছে, সব জায়গায় যে ব্যক্তি দায়ী সেটা নয়, অনেক জায়গায় দায়ী প্রক্রিয়া বা সিস্টেম। অনেক জায়গায় আইটি প্লাটফর্ম দায়ী। আমরা বলি কিছুটা পিপল, কিছুটা প্রসেস, কিছুটা প্লাটফর্ম দায়ী। এখানে কোনো ফরেনসিক ইনভেস্টিগেশন হয় না। তদন্ত কমিটিগুলোর ফরেনসিক দক্ষতা থাকে না। এটি কিছু আছে ফার্মের, আর আছে পুলিশের। এজন্য আমরা চেয়েছিলাম নিদেনপক্ষে যদি সিআইডির রিপোর্টটুকু জনসম্মুখে আনা হতো, তাহলে কিছু বিষয় জানা যেত। সে সুযোগ মেলেনি।
আরেকটি বিষয় হলো, বেসরকারি খাতের জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে শক্তিশালী করা হয়েছে। তবে তাদের মধ্যে যোগাযোগ থাকতে হবে। পৃথিবীর অন্য কোথাও সরকার আর ব্যক্তি খাত এমন যোজন যোজন দূরত্বে থাকে না। আমাদের বেসরকারি খাতকে এখানে প্রচুর সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখা হয়, যা কাম্য নয়। ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কোন গাড়িতে চড়বে, তার রুম কেমন হবে ইত্যাদি ঠিক করে দেয়ার দায়িত্ব নিয়ন্ত্রক সংস্থার নয়। তাদের কাজ প্রতিষ্ঠানটি নিয়ম-কানুন মেনে পরিচালিত হচ্ছে কিনা, এতে অর্থনীতি ও মানুষের স্বার্থ রক্ষিত হচ্ছে কিনা ইত্যাদি। এসব বিষয় উপেক্ষিতই থেকে যাচ্ছে।
পণ্যমূল্য কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা
হবে, তার
কোনো গাইডলাইন আমরা পাই না।
বেসরকারি খাত
যখন ১৩৬
টাকা ভোজ্যতেলের মূল্য নির্ধারণ করল,
তখন ভারতে
২০৯ রুপিতে
তেল বিক্রি
হচ্ছে। স্বাভাবিকভাবে আমার মূল্যবান বৈদেশিক
মুদ্রায় আনীত
তেল ভারতে
পাচার হয়ে
চলে যাবে।
সুতরাং দাম
নির্ধারণ একটি
গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
যখনই সরকার
কোনো পণ্যের
দাম নির্ধারণ করে তখন পাচারের
কথা বিবেচনায় রাখতে হবে। বর্ডারগুলো কিন্তু সুরক্ষিত নয়।
আমাদের বর্ডার
ফোর্স কিন্তু
উঁচুমানের নৈতিকতার প্রমাণ দিতে পারেনি।
সারা দেশে
আইনের শাসনের
অভাব, সুশাসনের অভাব, অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় জবাবদিহিতার অভাব থাকবে
আর আপনি
ব্যাংকিং খাতকে
মনে করবেন
পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন থাকবে, এটা তো
সম্ভব নয়।
অভিযোগ রয়েছে, আর্থিক খাতের বেশকিছু সিদ্ধান্ত রাজনৈতিক প্রভাবতাড়িত। এতে কী ধরনের সমস্যা তৈরি হচ্ছে?
বেসরকারি খাত কাদের
থেকে আসছে?
মালিকপক্ষ। মালিকপক্ষ তারাই যারা এফবিসিসিআইয়ের নেতা। তারাই বিভিন্ন
ব্যবসা-প্রতিষ্ঠানের মালিক। তারা ব্যাংকটাকেও চালান। আরেকটি সমস্যা
হচ্ছে, আমাদের
ব্যাংকগুলোয় ঘন
ঘন বৈঠক
হয় যেখানে
পরিচালকরা থাকেন।
আপনি যেকোনো
ব্যাংকে গেলে
দেখবেন কোনো
না কোনো
পরিচালকমণ্ডলীর বৈঠক
চলছে। অডিট
কমিটি, রিস্ক
কমিটি, এক্সিকিউটিভ কমিটি, না হয়
অপারেশনস কমিটি,
মানে বিভিন্ন
কমিটির মিটিং
চলে। ব্যাংকগুলো অতিমাত্রায় বোর্ড চালিত
হওয়ায় ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের কোনো বক্তব্য
নেই। দেশে
দুষ্ট ঋণগ্রহীতা এবং দুষ্ট ব্যাংক
মালিকদের একটা
পৃষ্ঠপোষকতা শুরু
হয়েছে। এটি
বন্ধ করতে
হবে।
আইএমএফের ঋণ ও ব্যাংক খাতের সংস্কার সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
আইএমএফের সাড়ে ৪ বিলিয়ন ডলার
কিংবা বিশ্বব্যাংক বা এডিবিকে যোগ
করলে সাড়ে
৬ বিলিয়ন
ডলার আমাদের
সামগ্রিক আমদানির
তুলনায় বেশ
নগণ্য। আমাদের
বিদেশী দায়
নিষ্পত্তির পরও
চলতি অর্থবছরের শেষে ৯০ থেকে
১০০ বিলিয়ন
ডলার পরিশোধ
করতে হবে।
আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক আমাদের
বড় উন্নয়ন
সহযোগী। তাদের
প্রস্তাবিত সংস্কারগুলো যদি সরকার করতে
পারে, তবে
আর্থিক খাতে
ন্যূনতম জবাবদিহিতা প্রতিষ্ঠিত হবে। এটি
খারাপ কী!
আইএমএফ যেসব শর্ত পূরণের কথা বলছে সেগুলো সম্পর্কে আপনার মতামত কী?
জ্বালানির ক্ষেত্রে ধরুন
আমি একটি
বিএমডব্লিউ, মার্সিডিজ বা রেঞ্জ রোভার
চালাই। সুতরাং
আমার সক্ষমতা
আর কৃষকের
সক্ষমতা এক
নয়। কারণ
কৃষক সেচের
জন্য জ্বালানি ব্যবহার করে। আমাদের
পাশের দেশ
ভারত কিন্তু
একটি অত্যন্ত
নির্ভরযোগ্য ভর্তুকি
ব্যবস্থাপনা তৈরি
করতে পেরেছে।
ভুক্তভোগীদের কাছে
কীভাবে ভর্তুকি
পৌঁছে দিতে
হয়, সেটির
একটি মডেল
তারা দাঁড়
করিয়েছে। এমন
মডেল বাংলাদেশেরও দাঁড় করাতে হবে।
এখন জ্বালানি তেলের দাম বিশ্ববাজারে বেড়েছে, এক্ষেত্রে সরকার
জ্বালানি তেলের
ডায়নামিক মূল্য
নির্ধারণ করতে
পারেন। আমি
এটার পক্ষে।
আমার যতদূর
মনে পড়ে,
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় তৎকালীন
জ্বালানি উপদেষ্টা ও জ্বালানি সচিব
মিলে আমাদের
বৈঠকে ডেকেছিলেন। আমরা একটা ডায়নামিক এনার্জি প্রাইসিং পলিসির
কথা তখনই
বলেছিলাম, তখন
বিশ্বব্যাংকও এটার
ওপর জোর
দিচ্ছিল। আপনি
হয়তো বলবেন
যে ঢালাওভাবে ভর্তুকি প্রত্যাহার করা
এ সময়ে
আমাদের আকাঙ্ক্ষিত নয় এবং সমর্থনযোগ্য নয়। ঢালাওভাবে হয়তো
নয়, তবে
কারা ভর্তুকি
পেতে পারে,
এ লক্ষ্যে
আমরা কিন্তু
আইএমএফের সঙ্গে
একটা বিতর্ক
করতেই পারি।
বেসরকারি খাত ডলারে বিপুল পরিমাণ ঋণ নিয়েছিল। এখন ডলারের দর বেড়ে যাওয়ায় ঋণ পরিশোধে তাদের বেগ পেতে হচ্ছে...
ব্যবসায়ী তার ব্যালান্স শিট দেখিয়ে, অর্ডার
বুক দেখিয়ে
ঋণ নিয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক
এখন তাকে
ডলার পাঠাতে
দিচ্ছে না,
রিজার্ভ নেই।
এতে করে
তার সময়ক্ষেপণ ছাড়া আর কোনো
পথ নেই।
এ কারণে
বাংলাদেশ ব্যাংক
এবং চেম্বারগুলোর অনতিবিলম্বে একসঙ্গে বসা
উচিত। বিশেষ
করে যারা
বৈদেশিক মুদ্রায়
ঋণ নিয়েছে
তাদের সঙ্গে
বাংলাদেশ ব্যাংকের বসা উচিত। ওই
সময়ে যারা
বড় বড়
ঋণ নিয়েছে—পাঁচ, দশটি
ব্যাংক যারা
বড় তাদের
সঙ্গে বসা
উচিত। ঋণ
পরিশোধে কোনো
সমস্যা তৈরি
হলে বহির্বিশ্বে এটি ভুল বার্তা
দেবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটা উদ্যোগ
নেয়া উচিত।
অনেকেই এলসি
খুলতে পারছে
না, সাইট
এলসি নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে, বলা
হলো তোমরা
ইউজেন্স এলসি
খুলো। কভিডকালে আমরা পরিশোধ করিনি,
বায়াররাও কিংবা
পেয়াররাও তা
মেনে নিয়েছেন। এখন আমদানি দায়গুলো
আমাদের গলার
মধ্যে এসে
আটকে গেছে।
এটার একটা
অংশ হয়তো
দ্রুত নিষ্পন্ন করতেই হবে। কিন্তু
আমরা যদি
একটু ডেফারেল
নিতে পারি,
খুবই ভালো
হয়। দ্বিতীয়ত, আমাদের রফতানি বাড়াতে
হবে, প্রবাসী
আয়কে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে আনতে হবে,
মুদ্রা পাচার
বন্ধ করতে
হবে।
আর্থিক খাতে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা খুবই
জরুরি। আর্থিক
খাতের কর্তাব্যক্তি ও আর্থিক খাতের
মালিক ও ঋণগ্রহীতার মধ্যে
সম্পর্ক কিছুটা
লেপ্টালেপ্টি হয়ে
গেছে। সেটা
আইসোলেশন বা
ফায়ারওয়াল ক্রিয়েট
না করে
এটার সমাধান
হবে না।
আর ফায়ারওয়ালটা দিতে পারে একমাত্র
কেন্দ্রীয় ব্যাংক,
একটি স্বাধীন
এবং ভিশনারি
কেন্দ্রীয় ব্যাংক।
শ্রুতলিখন: তৌফিকুল ইসলাম