প্রকৃতির ক্ষতি না করে প্রকল্প গ্রহণের নির্দেশ প্রধানমন্ত্রীর

বাস্তবায়ন করার দায়িত্ব মন্ত্রণালয়ের

রাষ্ট্রের অবকাঠামোগত উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন প্রকল্প গ্রহণ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এক্ষেত্রে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষা করার বিষয়টি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কেননা প্রকৃতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করে গৃহীত উন্নয়নের সুফল দীর্ঘদিন স্থায়ী হয় না। তাই যেকোনো পরিকল্পনার ক্ষেত্রে স্থানীয় পরিবেশের সঙ্গে সেটি সাযুজ্যপূর্ণ কিনা সেটি যাচাই করে দেখতে হবে। বিষয়ে খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জোর দিয়েছেন। তাই পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের উচিত প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করা।

বণিক বার্তায় প্রকাশ, মঙ্গলবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দেন। একনেক চেয়ারপারসন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সভায় সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য এবং সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সচিবরা উপস্থিত ছিলেন। বৈঠক শেষে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান জানিয়েছেন, হাজার ৫৮০ কোটি টাকা ব্যয়েউপকূলীয় জলবায়ুসহিষ্ণু শহরপ্রকল্প অনুমোদনের সময় প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, উপকূলীয় এলাকা সাধারণত ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। তাই প্রাকৃতিক ভারসাম্য নষ্ট না করে প্রকল্পটি সতর্কতার সঙ্গে বাস্তবায়নের জন্য সংশ্লিষ্টদের কাজ করতে হবে।

আমাদের দেশের উপকূল এলাকাগুলো দুর্যোগপ্রবণ হওয়ায় সেখানে বসবাসরত মানুষের ভোগান্তির শেষ নেই। বিশেষ করে বন্যা আর ঘূর্ণিঝড়ের সময় উপকূলবাসীকে তটস্থ থাকতে হয়। এক্ষেত্রে সাইক্লোন শেল্টার আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ করা হলেও সবাইকে সেখানে সময়মতো জড়ো করা সম্ভবপর হয় না। ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস অনুযায়ী দুদিন আগে থেকে মাইকিং করা হয়, কিন্তু উপকূলের জনসংখ্যা অনুযায়ী সবাইকে সীমিত সময়ের মধ্যে আশ্রয়কেন্দ্রে পাঠানো সম্ভব না হওয়ায় অনাকাঙ্ক্ষিত প্রাণহানি ঘটে। চলতি বছর ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের সময়ও ২৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এক্ষেত্রে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূলে বেশি তাণ্ডব চালিয়ে বিদায় নিয়েছে। আবহাওয়া অফিস থেকে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে না পড়লে আরো তাণ্ডব চালাতে পারত। তাই ভবিষ্যতে এমন তাণ্ডব থেকে রক্ষা পেতে অবশ্যইউপকূলীয় জলবায়ুসহিষ্ণু শহরগড়ে তোলার যে পরিকল্পনা নেয়া হয়েছে, সেটি বাস্তবায়ন গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রকৃতির যেন ক্ষতি না হয় সেটিও খেয়াল রাখতে হবে। বিশেষ করে গাছ কাটার যেন প্রয়োজন না হয়, সেভাবে পুরো পরিকল্পনাটা সাজাতে হবে। আমরা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার ক্ষেত্রে অতীতে দেখেছি আমাদের দেশের সুন্দরবন কীভাবে ঢাল হিসেবে ভূমিকা রাখে, এর মাধ্যমে প্রাকৃতিক বনাঞ্চল রক্ষার যে প্রয়োজনীয়তা সেটি নতুন করে আর বলার অপেক্ষা রাখে না। অন্যদিকে ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে গণ্য হচ্ছে। তাই উপকূল এলাকাজুড়ে জলবায়ুসহিষ্ণু শহর গড়ে তোলা অবশ্যই যুগোপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে গণ্য হবে। এজন্য প্রধানমন্ত্রীর দূরদৃষ্টি অনুসারে রকম মডেল শহর গড়ার ক্ষেত্রে অবশ্যই প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা প্রয়োজন।

উপকূলীয় জলবায়ুসহিষ্ণু শহরছাড়াও একনেকের বৈঠকে কুমিল্লা সড়ক বিভাগাধীন চারটি জেলা মহাসড়ক যথাযথ মান প্রশস্ততায় উন্নীতকরণ প্রকল্প; লেবুখালী-বাউফল-গলাচিপা-আমড়াগাছিয়া জেলা মহাসড়কের ৭০তম কিলোমিটারে রাবনাবাদ নদীর ওপর গলাচিপা সেতু নির্মাণ প্রকল্প; ট্রান্সপোর্ট মাস্টারপ্ল্যান অ্যান্ড প্রিলিমিনারি ফিজিবিলিটি স্টাডি ফর আরবান মেট্রোরেল ট্রানজিট কনস্ট্রাকশন অব চিটাগং মেট্রোপলিটন এরিয়া প্রকল্প, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে তৃতীয় সাবমেরিন কেবল স্থাপন প্রকল্প; কারা নিরাপত্তা আধুনিকায়ন, ঢাকা, ময়মনসিংহ চট্টগ্রাম বিভাগ প্রকল্প; জাতীয় তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তি অবকাঠামো উন্নয়ন (ইনফো-সরকার তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্প এবং কৃষি উন্নয়নের মাধ্যমে পুষ্টি খাদ্যনিরাপত্তা জোরদার প্রকল্পের অনুমোদন দেয়া হয়।

এসব প্রকল্প সম্পূর্ণরূপে প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে জড়িত। তাই উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণের সঙ্গে যথার্থ প্রাকৃতিক বাস্তুসংস্থানের বিষয়টিও নিশ্চিত করতে হবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যেকোনো উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক পরিবেশ, বনাঞ্চল জীববৈচিত্র্যের ভারসাম্য বজায় রাখা জরুরি। কারণ প্রকৃতির ক্ষতি করে উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদে ভালো ফলাফল বয়ে আনে না। এক্ষেত্রে যে ক্ষতিটা হয়, তা ক্ষেত্রবিশেষে পূরণ করাও অসম্ভব হয়ে পড়ে।

একনেকের সভায় প্রধানমন্ত্রী আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরেছেন, সেটি হচ্ছে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে প্রকল্পগুলো শেষ করা এবং প্রকল্পগুলোয় বারবার সংশোধনী না আনা। এটি অবশ্যই বিবেচনা করতে হবে, কেননা প্রকল্প নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে শেষ না করতে পারলে ব্যয় বেড়ে যায় এবং প্রকল্পের জন্য যেসব প্রয়োজনীয় উপকরণ জড়ো করা হয় সেগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর হয়ে ওঠে। তাই পরিবেশের ক্ষতি যেন না হয়, সেদিকে লক্ষ রেখে নির্মাণসামগ্রী জোগাড় করার পর নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ করতে হবে। আর বারবার সংশোধনী আনা হলে সে প্রকল্পও কাঙ্ক্ষিত ফলাফল বয়ে আনতে পারে না।

প্রধানমন্ত্রী রাজধানীর খালগুলোয় স্বাভাবিক জলপ্রবাহ নিশ্চিত করতে খালগুলো মুক্ত রাখার ক্ষেত্রেও বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন। এটি উন্নয়ন করতে গিয়ে প্রাকৃতিক পরিবেশের ক্ষতি করার একটি জলজ্যান্ত উদাহরণ। কারণ অবকাঠামো নির্মাণ করতে গিয়ে ঢাকার খালগুলোকে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে, যার ফলাফল ঢাকাবাসীকে আজও পেতে হচ্ছে। তাই ঢাকার পরিবেশগত বিপর্যয় থেকে শিক্ষা নিয়ে দেশজুড়ে যে প্রকল্পগুলো হাতে নেয়া হয়েছে সেখানে অন্তত পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে নাএমনটিই সবার প্রত্যাশা।

আমরা প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা করে টেকসই উন্নয়নকে সমর্থন করি। পুরো বিশ্বেই ধারণা বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক, ইতালির ভেনিসসহ পৃথিবীর উন্নত শহরগুলোয়ও প্রকৃতিকে সঙ্গে নিয়েই বিস্তর পরিকল্পনা সাজানো হয়েছে। এসব দৃষ্টান্ত অনুসরণ করে উন্নয়ন প্রকল্পের সমন্বয় করলে অন্তত আমরা পরিবেশগত বিপর্যয়ের সম্মুখীন হব না, সেটি প্রত্যাশা করা যায়। বর্তমান বিশ্বে গবেষণার জায়গাটি উন্মুক্ত হওয়ায় একটি শহরকে কীভাবে ঢেলে সাজানো যায় তা নিয়ে বিস্তর অনুসন্ধান করা যেতে পারে। সেই সঙ্গে বিগত সময়ে গৃহীত দুর্যোগ মোকাবেলার পদক্ষেপগুলো যাচাই করে নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য আগে থেকে সম্ভাব্যতা যাচাই করা থাকলে একটি প্রকল্প থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল আশা করা সম্ভব হতে পারে। অতীতের ভুলগুলো বিবেচনা করে আগামীর উন্নয়ন প্রকল্পগুলো সময়মতো নিষ্পন্ন করা হবেআমরা সে প্রত্যাশাই করি। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হওয়ার পরও বাংলাদেশ প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে রোল মডেল হোক, সেটিই পরিবেশসংশ্লিষ্ট সবার কাম্য। উন্নয়নের মহাসড়কে বাংলাদেশের যে অদম্য যাত্রা হয়েছে, সেটি সচেতনভাবেই অব্যাহত থাকুক।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন