ফেলিনি থেকে স্পিলবার্গ

ফ্রেমে ফ্রেমে স্মৃতি ধরে রাখেন তারা

সাদাকালো ফ্রেমে ডাবলিন। ষাটের দশকের শেষ দিকে আয়ারল্যান্ডের অস্থিতিশীল অবস্থা ও পরিবর্তনের গল্প নিয়ে বড় পর্দায় হাজির হয় বেলফাস্ট। কেনেথ ব্রানার সিনেমার গল্পটি বলা হয়েছে বাডি নামে এক শিশুর দৃষ্টি নিয়ে। মজার ব্যাপার বেলফাস্টের বাডির মধ্যে কেনেথ ব্রানার ছায়া স্পষ্ট। ২০২২ সালের অস্কারে সেরা সিনেমার জন্য মনোনীত হয়েছিল বেলফাস্ট। ২০২৩ সালের জন্য আলোচনায় আছে স্টিভেন স্পিলবার্গের দ্য ফেবলম্যানস। স্পিলবার্গের সিনেমাটি তার জীবনের, মুখ্যত শৈশবের গল্প ও অভিজ্ঞতা থেকে নির্মিত। বিখ্যাত পরিচালকদের ক্ষেত্রে স্মৃতিচারণমূলক সিনেমা নির্মাণের ঝোঁক দেখা যাচ্ছে, বলা ভালো অতীতেও ছিল। নির্মাণের এ ঝোঁক নতুন নয়। এ কালে ব্রানা বা স্পিলবার্গের মতো এককালে ফেলিনিও নির্মাণ করেছিলেন আত্মজৈবনিক সিনেমা।

গত অক্টোবরের শেষে মুক্তি পেয়েছে জেমস গ্রের সিনেমা ‘‌আর্মাগেডন টাইম’। অ্যানা হ্যাথাওয়ে, অ্যান্টনি হপকিন্স প্রমুখ অভিনীত সিনেমাটি গ্রের বেড়ে ওঠার সময়ের গল্প। সিনেমা দুটোর গল্প বলার ধরন আলাদা কিন্তু অন্তর্গত ভাব একই। কোনো না কোনোভাবে ব্যক্তির বেড়ে ওঠার সময়ের নস্টালজিয়ার গল্প বলেছেন নির্মাতারা। গ্রের সিনেমায় আমেরিকান অভিবাসীর জীবনের সংগ্রাম এবং তার গভীরতা উঠে এসেছে। অন্যদিকে স্পিলবার্গের সিনেমায় বাবা-মায়ের সম্পর্ক ও সংসারে তৈরি হওয়া সংকটকে উপজীব্য করা হয়েছে। এ সময়ে এসে সহজ গল্প বলা বা গল্প বলার সহজ ধারার বাইরে গিয়ে এ ধরনের সিনেমা দর্শককে ভাবনায় মগ্ন করে। 

তবে এগুলোর কিছু ‘‌কমন’ বিষয় আছে। সিনেমা পারাদিসোর গল্প বলার ধারার সঙ্গে মিল পাওয়া যায়। স্পিলবার্গ হোক, গ্রে, ব্রানা কিংবা গুইসেপ্পে টোর্নাটোর-সবার সিনেমায়ই উচ্ছ্বলতার পাশাপাশি এক ধরনের বিষণ্নতা থাকে। এসবে শৈশব বা কৈশোর স্মৃতির বাইরে আরো থাকে সমাজের নানা অনুষঙ্গ। কখনো রাজনৈতিক জটিল বক্তব্যও রাখা হয় কিন্তু নস্টালজিয়ার পরত পেরিয়ে তা সবসময় ধরা যায় না।

স্মৃতিচারণ বা আত্মজৈবনিক সিনেমাগুলো ব্যবসায়িকভাবেও সফল হচ্ছে। গুইসেপ্পে টোর্নাটোর সিনেমা পারাদিসো যুক্তরাষ্ট্রের বক্স অফিসে ভালো ব্যবসা করেছিল। অথচ সিনেমাটির গল্প সিসিলির। কেবল এতেই সীমাবদ্ধ থাকে না সিনেমাটির প্রভাব। রীতিমতো নতুন একটি জোয়ার তৈরি হয়। সিনেমা নির্মাণ ও গল্প বলার ধরনে পরিবর্তন আসে এবং এ ধারার সিনেমা জনপ্রিয় হতে থাকে নানা বয়স ও শ্রেণীর দর্শকের কাছে।

মানুষ স্বভাবতই তার শৈশবে ফিরতে চায়। কামিং অব এজ সিনেমাগুলো সে কারণে দর্শককে আকর্ষণ করে। সিনেমা পারাদিসো বহু মানুষকে তার ছেলেবেলার বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়েছে। সিনেমার জাদু এমনই। নির্মাতার জন্য কঠিন হতে পারে, তবে গল্প ও দৃশ্যগুলোর সঙ্গে নিজেকে জড়ানো দর্শকের জন্য সহজ। স্মৃতিকথার সিনেমায় এক ধরনের অপেক্ষা থাকে। হতে পারে সেটা পরিণতির অপেক্ষা। সব ক্ষেত্রে তা পাওয়া যায় না। কখনো কখনো জীবন সম্পর্কে রূঢ় সত্য উচ্চারণ করা হয়। আর্মাগেডন টাইমে কোনো অপেক্ষা নেই। সিনেমাটি একটি সত্য মেনে নিতে শেখায়। সে বলে কিছু অপরাধবোধ থেকে কখনো মুক্তি পাওয়া যায় না। মানুষকে তা বহন করতে হয়।

স্পিলবার্গের সিনেমাটিও প্রায় একই ধরনের ভাব ধারণ করে। ‘‌আলফনসো কুরোর রোমা’ এ ধারার আরেকটি সিনেমা, যা শৈশব থেকে শুরু হওয়া জটিলতা নিয়ে কথা বলে। ফেদেরিকো ফেলিনিও ১৯৭২ সালে ‘‌রোমা’ নামে একটি সিনেমা নির্মাণ করেছিলেন। সে সিনেমায় ফ্যাসিবাদী সরকারের শাসনামলে রোমের এক ১৮ বছর বয়সী তরুণের গল্প বলা হয়। রোমার গল্পটি ফেলিনি কিছুটা পৌরাণিক ভাব দিয়ে উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছেন। যেন অন্য একটা মোড়কে উপস্থাপিত নিজের জীবনের গল্প। তবে এটি ফেলিনিরই ভিন্নধর্মী ধারা। কেননা রোমার পরের বছর মুক্তি পায় ‘‌আমারকড’। সিনেমাটি অনানুষ্ঠানিকভাবে রোমার প্রিকুয়েল। এখানেও ফেলিনি সমাজের কঠিন বাস্তবতার গল্পটিই বলেন, সেই সঙ্গে তার বেড়ে ওঠার সময়ের একটা ছাপ থেকে যায়, থাকে ফ্যাসিস্ট সময়ের ইতালির দিনকাল।

টেরান্স মালিকের সিনেমার ক্ষেত্রে কিছুটা ভিন্নতা দেখা যায়। তার সিনেমায় বাস্তবতার পাশে এক ধরনের নৈর্ব্যক্তিক ভাব থাকে। তার ২০১১ সালের সিনেমা দ্য ট্রি অব লাইফের সঙ্গে মিলে যায় ইংমার বার্গম্যানের ফ্যানি। তারা তাদের গল্পগুলোর কোনো পরিণতি দিতে চান না। এমন একটি জায়গায় সিনেমা থেমে যাবে, যেখান থেকে দর্শককে ভাবতে হবে নিজের মতো করে। কিংবা সে অসমাপ্ত অংশের অতৃপ্তিই সিনেমার গুণ হয়ে উঠবে।

আত্মজৈবনিক হলেও নির্মাতারা সাধারণত সিনেমায় নিজেদের আবছাভাবে রাখেন না। স্পষ্ট হয়ে থাকে সময়। কিংবা এর উল্টোটাও হতে পারে। কিন্তু সবকিছুর ওপর বড় হয়ে ওঠে স্মৃতি। ফ্রেমে ফ্রেমে স্মৃতি ধরে রাখেন তারা।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন