বিশ্বকাপে টেলিভিশন

তোফাজ্জল হোসেন

মধ্যপ্রাচ্যের দেশ কাতারে বসেছে ফুটবল বিশ্বকাপের এবারের আসর। দীর্ঘ বাছাই প্রক্রিয়া শেষে বিশ্বকাপে অংশ নিচ্ছে ৩২টি দল। সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে তো বটেই, বিশ্বজুড়ে ছড়িয়েছে উন্মাদনা। প্রিয় দলের লড়াই দেখছে মুখিয়ে থাকা ফুটবলপ্রেমীরা। আয়োজক দেশ কাতারের স্টেডিয়ামগুলোতে বসে খেলা দেখার সুযোগ মাত্র ৩০ লাখ মানুষের। বাকিদের ভরসা বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক ডিভাইস, যার মধ্যে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছে টেলিভিশন।

সময়ের পরিক্রমায় মানুষ এখন টেলিভিশনের পর্দা ছাড়াও অন্যান্য মাধ্যমে খেলা দেখার সুযোগ পায়। কিন্তু সাধারণ মানুষের মধ্যে অনেকে একসঙ্গে মিলে বিশ্বকাপের ম্যাচ উপভোগের অভ্যাস রয়ে গিয়েছে। ফলে হাতে স্মার্টফোনের অ্যাপ রেখেও বন্ধু বা পরিবারের সঙ্গে বসে টিভি পর্দায় চোখ রাখতেই ভালোবাসে বেশির ভাগ ফুটবলপ্রেমী। বিচ্ছিন্নতার জীবনে ফুটবল বিশ্বকাপ আবারো মানুষকে এক করেছে, সঙ্গ উদযাপনের সুযোগ করে দিয়েছে। কারণ ফুটবল বিশ্বকাপ এখন আর শুধু খেলা নয়, সাধারণ মানুষের একযোগে উদযাপনের মতো উৎসবও।

১৯৫৪ সালে প্রথম ফিফা বিশ্বকাপের ম্যাচ টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয়। সে বছর খেলা হয়েছিল যুক্তরাজ্যে। ফাইনালে হাঙ্গেরির বিরুদ্ধে - গোলে জয় পায় পশ্চিম জার্মানি। ২০১৮ সালে রাশিয়ায় ফিফা বিশ্বকাপের ফাইনাল ছিল ইতিহাস সৃষ্টিকারী ম্যাচ। বিশ্বের ১১০ কোটি মানুষ একযোগে টেলিভিশন পর্দায় ফ্রান্স ক্রোয়েশিয়ার মধ্যকার খেলা উপভোগ করে।

বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজক সংস্থা ফিফার আয়ে বড় ভূমিকা রাখে টেলিভিশন। সংস্থাটির আয়ের সিংহভাগ আসে বিভিন্ন কোম্পানির কাছে টিভি প্রচার এবং সম্প্রচার স্বত্ব বিক্রির মাধ্যমে। টিভিতে সরাসরি খেলা দেখানোর ফলে চড়া দাম হাঁকানো হয় খেলার মাঠের স্পন্সর কোম্পানিগুলোর কাছেও। বড় বড় প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন পদ্ধতি মার্কেটিংয়ের জগেক অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। বিজ্ঞাপন থেকে অর্থ আয়ের হার যেভাবে বেড়েছে তেমনি বেড়েছে টেলিভিশন চ্যানেলের সংখ্যা। আর সম্প্রচার প্রতিষ্ঠানগুলো সবচেয়ে বেশি ব্যয় করছে ফুটবলের পেছনে। বছরের প্রায় ১২ মাসই পৃথিবীর কোথাও না কোথাও ফিফার অধীনে বিভিন্ন টুর্নামেন্ট আয়োজিত হয়। সেসব টুর্নামেন্টের ম্যাচ থেকে শুরু করে ট্রেনিং সেশন সরাসরি সম্প্রচারের জন্য টেলিভিশন চ্যানেলগুলোকে ব্যয় করতে হচ্ছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার।

প্রতিটি বিশ্বকাপকে ঘিরে চার বছরের একটি চক্র হিসাব করে ফিফা। ২০১৫ থেকে ১৮ চক্রে ফিফার মোট আয় ছিল ৬৪০ কোটি ডলার, যার মধ্যে টেলিভিশন স্বত্ব থেকেই এসেছিল ৪৬০ কোটি ডলার। চলতি কাতার বিশ্বকাপকে ঘিরে আবর্তিত চক্রে ৭৫০ কোটি ডলার আয় করেছে ফিফা, যা সংগঠনটির ইতিহাসে রেকর্ড।

জানা গিয়েছে, ইএসপিএনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ২০২২ বিশ্বকাপের সম্প্রচার স্বত্ব কিনেছে টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি ফক্স। প্রতিষ্ঠানটি ফিফাকে ৪০ কোটি ডলার অগ্রিম পরিশোধ করেছে। ম্যাচের হাইলাইটস প্রচারের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছে বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমও।

২০১৮ সালের ফুটবল বিশ্বকাপ শেষে স্ট্যাটিস্টা একটি পরিসংখ্যান প্রকাশ করে। ২৭টি দেশের প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর চালানো জরিপে দেখা যায়, ৬২ শতাংশ মানুষ টেলিভিশনে খেলা দেখেছে। ইন্টারনেট ব্যবহার করে খেলা দেখেছে ২৫ শতাংশ, সেলফোন ডিভাইসে দেখেছে ১৩, ট্যাবলেট ডিভাইসে রেডিওতে খেলার ধারাভাষ্য শুনেছে শতাংশ মানুষ। অর্থাৎ গত বিশ্বকাপ পর্যন্তও টেলিভিশন ছিল বিশ্বকাপ দেখার জনপ্রিয়তম মাধ্যম।

ফুটবল বিশ্বকাপ সামনে রেখে বরাবরই বাংলাদেশে টেলিভিশন বিক্রির পরিমাণ বাড়ে। অবশ্য কেবল বাংলাদেশেই নয়, খালিজ টাইমসের প্রতিবেদন বলছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিশ্বকাপ উপলক্ষে টেলিভিশন বিক্রির পরিমাণ দ্বিগুণ হয়েছে। অনেক ক্রেতাই ১১.১১-এর ছাড়কে কাজে লাগিয়ে নিত্যনতুন মডেলের টেলিভিশন কিনেছে। বিশেষ করে আধুনিক প্রযুক্তির বড় স্ক্রিনের টিভির চাহিদা দেশটিতে বেশি। ৫৫ থেকে ৮৫ ইঞ্চি পর্যন্ত স্ক্রিনের টিভি বেশি বিক্রি হয়েছে। সবচেয়ে বড় স্ক্রিন অর্থাৎ ৯৮ ইঞ্চি স্ক্রিনের টিভিও কিনেছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের অনেক মানুষ।

ফুটবল বিশ্বকাপকে ঘিরে যুক্তরাজ্যেও বেড়েছে টেলিভিশনের বেচাবিক্রি। দেশটির ইলেকট্রনিকস পণ্য বিক্রেতাপ্রতিষ্ঠান এও ওয়ার্ল্ডের প্রতিষ্ঠাতা সিইও জন রবার্টস রয়টার্সকে বলেন, বিশ্বকাপ ঘিরে বরাবরই বাড়ে টিভি বিক্রির পরিমাণ। বিশেষ করে কভিড-পরবর্তী পরিস্থিতিতে ব্যবসার পরিবেশের জন্য ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছে বিশ্বকাপ। তবে যদি যুক্তরাজ্য বিশ্বকাপে চূড়ান্ত পর্ব পর্যন্ত পৌঁছতে পারে তাহলে টিভি বিক্রির পরিমাণ আরো অনেক বাড়বে। মূল্যস্ফীতির কারণে দেশে বিলাসপণ্যে খরচ কমিয়েছে ব্রিটেনের মানুষ। পরিস্থিতিতে দলের ভালো খেলার ওপর যুক্তরাজ্যের টিভি বিক্রেতাদের লাভ-লোকসানও অনেকটা নির্ভরশীল।

এর আগে ২০১৮ সালের বিশ্বকাপকে ঘিরে আগের বছরের তুলনায় যুক্তরাজ্যে টিভি বিক্রির পরিমাণ বেড়েছিল ১৫০ শতাংশ।

বাংলাদেশে ডলার সংকট যন্ত্রাংশের দাম বেড়ে যাওয়ায় প্রায় সব ধরনের টিভির দাম -১০ শতাংশ বেড়েছে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির বাজারেও ফুটবলপ্রেমীদের টেলিভিশন কেনা বন্ধ হয়নি। এবারো বিশ্বকাপ ফুটবল উপলক্ষে দেশের বাজারে বেড়েছে টেলিভিশন বেচাকেনা। অবশ্য টেলিভিশন বিক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো উপলক্ষে নানা ধরনের অফারও দিয়েছে, যা নিজের সুবিধা অনুযায়ী গ্রহণ করেছে ক্রেতা।

গত বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মার্কেটিং বিভাগের সেমিনার কক্ষে মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশ আয়োজিত বাংলাদেশে টেলিভিশন শিল্পের ওপর গবেষণা কার্যক্রমের ফল প্রকাশ করা হয়। সেখানে বলা হয়, ২০২০ সালে দেশে টেলিভিশনের বাজারের আকার ছিল ৬৩৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। ২০২৫ সালে তা বেড়ে দাঁড়াতে পারে ৯৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন