
বিশ্বকাপের স্বাগতিক দেশের সামনে অনেক চ্যালেঞ্জ
থাকে। যার একটি, নিজেদের সংস্কৃতি ও তার ইতিবাচক দিক উপস্থাপনের চাপ। সে দিক থেকে
এবারের উদ্বোধনে আসরে কাতারের তুরুপের তাস ছিলেন ঘানিম আল মুফতাহ। দেশটি নিয়ে অনেক
আলোচনা-সমালোচনার ভিড়ে সারাবিশ্বে কৌতুহল জাগিয়েছেন ঘানিম আল মুফতাহ।
হলিউডের কৃষ্ণাঙ্গ তারকা মর্গান ফ্রিম্যানের
সঙ্গে সেদিন নজর কেড়েছিলেন তিনি। শুধু উদ্বোধনী অনুষ্ঠান নয়, এবারের বিশ্বকাপে ফিফার
অ্যাম্বাসেডরের ভূমিকা পালন করছেন ঘানিম আল মুফতাহ। আর অনুষ্ঠানের হাজির হওয়ার পর আঞ্চলিক
সীমানা পেরিয়ে গিয়েছেন আরবের এই ইয়ুথ আইকন।
ঘানিম আল মুফতাহর জন্ম ২০০২ সালের ৫ মে। কাউডাল রিগ্রেশন সিনড্রোম (সিডিএস) নামে বিরল এক ব্যাধি নিয়ে পৃথিবীর আলো দেখেন তিনি। কিন্তু কোনো প্রতিবন্ধকতায় তার জন্য বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।
সিডিএসে আক্রান্ত শিশুরা জন্মগ্রহণ করে শরীরের
নিচের অংশ ছাড়াই। বিষয়টি ধরা পড়লে ঘানিমের জন্মের আগেই তার মাকে গর্ভপাতের পরামর্শ
দেন অনেকে। তাতে করে ছেলে ও তার মা-বাবা রেহাই পাবে প্রতিবন্ধী জীবনের অভিশাপ থেকে।
কিন্তু ঘানিমের বাবা-মা তা করলেন না। নিজেদের প্রস্তুত করলেন ভবিষ্যৎ সংগ্রামের জন্য।
যে কোন মূল্যে তারা ঘানিমের পাশে থাকার জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হলেন। ঘানিমের বাবা বললেন,
তাদের একজন হবেন ছেলের বাম পা, অন্যজন ডান পা।
এই ছিল মা-বাবার সিদ্ধান্ত। কিন্তু ঘরের বাইরে
ছিল বিরূপ দুনিয়া। হয়তো অন্য অনেকে এই পরিস্থিতিতে হাল ছেড়ে জীবন সঁপে দিতেন বাস্তবতার
ওপর। কিন্তু ঘানিম তা করেনি। কী নেই- সেদিকে না তাকানোর সময় নেই তার। যা কিছু আছে,
তার সদ্ব্যবহার করতে শুরু করলেন। এখানেই ঘানিম স্বাতন্ত্র্য।
খুব দ্রুতই প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে আরবের মানুষের কাছে অনুপ্রেরণায় পরিণত করলেন নিজেকে। সেই অনুপ্রেরণা এখন বৈশ্বিক মাত্রা পেয়েছে।
বর্তমানে তিনি কূটনৈতিক হবার স্বপ্ন নিয়ে
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে পড়ছেন ঘানিম। শারিরীক প্রতিবন্ধকতা এড়িয়ে অংশগ্রহণ করেন নানা রকমের
খেলাধুলায়।
অবশ্য প্রথম দিকে স্কুলে হাজির হওয়াটা তার
জন্য বেশ কষ্টদায়ক ছিল। ক্লাসের ছেলেরা প্রায়ই ঠাট্টা-বিদ্রূপ করত। ঘানিম হতাশ হলেও
মা সাহস জোগাতেন। সে যেন নিজে থেকেই সহপাঠীদের সঙ্গে কথা বলে। যেন নিজের শারিরীক অবস্থা
সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করে। এভাবে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বেড়ে ওঠে ঘানিম।
যদিও তাকে নিয়মিত চিকিৎসকের কাছে হতে হয়,
মেনে চলতে হয় নানা নিয়ম। তারপরও স্বপ্ন ও অধ্যবসায় থমকে যায়নি। সহজাত বুদ্ধিমত্তা ও
স্বভাবসুলভ হাস্যোজ্জ্বল মুখ দিয়ে জয় করে নিয়েছেন মানুষের মন। নিজেকে যুক্ত করেন সামাজিক
কর্মকাণ্ডে। শুধু এক উদ্যোগেই লেবাননের ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের জন্যই ১০ লাখ রিয়াল
সংগ্রহ করেন তিনি।
বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘানিম আল
মুফতাহর ৩০ লাখের বেশি অনুসারী। নিজের দেশ কাতার আর কাতারের বাইরের লাখো-কোটি মানুষ
তাকে ভালোবাসে ও সম্মান করে। প্রাপ্তির ঝুলি নেহায়েত ছোট না ঘানিমের। রোটা ফাউন্ডেশন
তাকে শুভেচ্ছা দূত মনোনীত করেছে আগেই। কাতার ফাইন্যান্সিয়াল সেন্টার অথোরিটি মর্যাদা
দিয়েছে ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডরের। বহুজাতিক টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি উরিদু কাতারের
ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর। পেয়েছেন শেখ মুহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম কর্তৃক আরব সোশ্যাল
নেটওয়ার্কিং পায়োনিয়ার পদক ও তাকরিম অ্যাওয়ার্ডস।
সবচেয়ে বড় কথা পৃথিবীর নানা প্রান্তের মানুষ
তার গল্প শুনে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে চায়, বাঁচতে চায়।