স্বাস্থ্যযত্ন

জটিলতা এড়াতে থাকতে হবে চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে

অধ্যাপক ডা. রওশন আরা বেগম বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের (বিএমডিসি) সহসভাপতি অবস্ট্রেটিক্যাল অ্যান্ড গাইনোকোলজিক্যাল সোসাইটি অব বাংলাদেশের (ওজিএসবি) সাবেক সভাপতি। দীর্ঘকাল ধরে প্রসূতি স্ত্রীরোগ নিয়ে চিকিৎসা প্রদান এবং অধ্যাপনা করছেন তিনি। মাতৃমৃত্যু এবং গর্ভকালীন জটিলতা এড়াতে করণীয় বিষয়ে তিনি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

গর্ভকালীন জটিলতা বলতে গাইনি বিশেষজ্ঞরা কী কী বিষয়কে উল্লেখ করছেন?

নারী যখন গর্ভবতী হন, তখন তার জীবন ঝুঁকিপূর্ণ হতে শুরু করে। এছাড়া কিছু রোগ বয়সের কারণে অনেক সময় জটিলতার সৃষ্টি হয়। অল্প বয়সে গর্ভধারণ করলে (কিশোরী গর্ভধারণ) জটিলতা দেখা দেয়। ফলে এসব মায়ের জীবনও বিপন্ন হয়। তারা গর্ভবতী হওয়ার পর প্রায় অসুস্থ থাকেন। প্রয়োজন অনুযায়ী তাদের শারীরিক উন্নতি হয় না। এতে প্রসবের সময়ে ঝুঁকি তৈরি হয়। সন্তান বেরিয়ে আসার জন্য প্রসূতির জরায়ু যতটুকু সম্প্রসারিত হওয়ার কথা তা হয় না। মলদ্বার, প্রস্রাবের রাস্তা জরায়ু কাছাকাছি হওয়ায় সন্তান প্রসবের সময় জরায়ু প্রয়োজনীয় সম্প্রসারণ না হলে প্রবল চাপের কারণে প্রস্রাব পায়খানার রাস্তা এক হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। এতে জরায়ু বড় হয়ে সবসময় প্রস্রাব বের হয়। ওই প্রসূতি এক ঝুঁকিপূর্ণ জীবনে প্রবেশ করেন। এছাড়া গর্ভপাতও হতে পারে। নির্দিষ্ট সময়ের আগে সন্তান ভূমিষ্ঠ হতে পারে। আবার বেশি বয়সে যেমন পঁয়ত্রিশের পরে কেউ গর্ভধারণ করলে জটিলতা তৈরি হয়। বংশগতির কারণ অথবা দীর্ঘমেয়াদি রোগ যেমন ডায়াবেটিস, উচ্চরক্তচাপ জটিলতা বৃদ্ধি পেতে পারে। সম্প্রতি নারীদের মধ্যে ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব বেশি পাওয়া গেছে।

গর্ভকালীন জটিলতার জন্য অসচেতনতা অশিক্ষা কতটুকু দায়ী?

অবশ্যই দায়ী। অশিক্ষার কারণেই অল্প বয়সে বিয়ে হচ্ছে। সামাজিক, অর্থনৈতিক অবস্থা বাল্যবিবাহের ক্ষেত্রে বড় প্রভাবক। সামাজিক অনিরাপত্তাও এর জন্য দায়ী। বর্তমানে বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর কয়েকটি কারণের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে উচ্চরক্তচাপ, রক্তক্ষরণ খিঁচুনি। এগুলো প্রতিরোধযোগ্য। এখনো ৫৫ শতাংশ মা এসব জটিলতার কারণে মারা যাচ্ছেন। গর্ভকালে এসব জটিলতা এড়াতে প্রত্যেক প্রসূতিরই চিকিৎসকের পর্যবেক্ষণে থাকা প্রয়োজন। উচ্চরক্তচাপ মেপে প্রয়োজনীয় ওষুধ সেবন প্রয়োজন। খিঁচুনি যেন না হয় তার জন্য আমরা চিকিৎসা দিয়ে থাকি। নারীদের গর্ভধারণের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ক্যালসিয়াম আয়রনের ট্যাবলেট বাধ্যতামূলক খেতে বলি। গবেষণায় দেখা যায়, ক্যালসিয়াম আয়রন গর্ভবতী মায়ের উচ্চরক্তচাপ খিঁচুনি রোধে কার্যকর। গর্ভবতীদের মধ্যে রক্তশূন্যতাও দেখা যায়। প্রায় ৮০ ভাগ গর্ভবতী রক্তশূন্যতায় ভোগেন। ফলে শিশুও অপুষ্টিতে ভোগে অনেক সময়ে মায়েরা জীবনের ঝুঁকিতে পড়ে যায়। আরো কিছু শারীরিক জটিলতা দেখা যেতে পারে।

প্রসবপূর্ব সেবা কেন গুরুত্বপূর্ণ? কোন সময় থেকে সেবা গ্রহণ করতে হয়?

সন্তান গ্রহণের পরিকল্পনা করার সময় থেকেই মায়েদের চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। সন্তান নেয়ার জন্য মায়ের বয়স ঠিক আছে কিনা, অন্যান্য রোগ আছে কিনা এসব দেখা প্রয়োজন। অনেক ক্ষেত্রে স্বামী-স্ত্রী উভয়ের কোনো রোগ আছে কিনা সে বিষয়েও জানতে হয়। এজন্যই আমরা সব নারীকে গর্ভধারণের ন্যূনতম তিন মাস আগে থেকে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে বলি। সময়ে আমরা গর্ভবতীকে ফলিক অ্যাসিড দিই। গবেষণায় দেখেছি প্রসূতি এই ওষুধ না খেলে মায়ের সন্তানের স্নায়বিক উন্নতি (নিউরোলজিক্যাল ডেভেলপমেন্ট) কম হয়। তাছাড়া মায়ের রক্তশূন্যতাও এই ওষুধে কমে আসে। এছাড়া ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য রোগ থাকলে তিন মাসের মধ্যে আমাদের কাছে এলে আমরা সংশোধন করে নিতে পারি।

দেশে প্রসবপূর্ব সেবা বা এএনসি সেবার হার বৃদ্ধি পেলেও তা আশানুরূপ হয়নি। কীভাবে প্রত্যাশা পূরণ করা যায়?

প্রধানত সবার সদিচ্ছা দরকার। সরকারের যেমন এগিয়ে আসতে হবে তেমনই আমাদের সাধারণ জনগণকেও কাজ করতে হবে। এছাড়া পেশার সঙ্গে যারা জড়িত তারাসহ এনজিওগুলোকে এটি পূরণে সচেতনতা বাড়াতে হবে। আমরা বলি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যেন নবজাতকের জন্ম হয়। প্রান্তিক পর্যায়ে আমাদের প্রায় ১৪ হাজার কমিউনিটি ক্লিনিক রয়েছে। অনেক ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র রয়েছে। এগুলোতে যদি ভালো ব্যবস্থা করা হয়, ইউনিয়ন কাউন্সিলে ভালো ব্যবস্থা করা হয়, তাহলে আমরা গর্ভবতী মায়েদের এখানে আসতে বলতে পারি। বাংলাদেশে এখন মিডওয়াইফ তৈরি হচ্ছে। এটা শুধু মায়েদের সেবা দেয়ার জন্য। তারা যদি ভালোভাবে কাজ করে, এলাকায় আলোচনা করে তাহলে কিন্তু এখানে মায়েরা আসতে পারে। এজন্যই সব পর্যায় থেকে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার যে এখানে কেন আসা দরকার। তবে আমরা এখনো বাড়িতে ডেলিভারি প্রবণতা কমিয়ে আনতে পারছি না।

প্রসব-পরবর্তী সেবা কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ?

অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। প্রসব-পরবর্তী সময়ে মা রক্তক্ষরণ, রক্তশূন্যতায় মারা যায় বা সংক্রমণের কারণে মারা যায়। আবার পরবর্তী সন্তান সে কতদিন পর নেবে বা কীভাবে নেবে সেটা কিন্তু সময়েই ঠিক করতে হয়। তাতে আমরা মায়েদের মৃত্যুহার ৩০ শতাংশ কমাতে সক্ষম হয়েছি। এবং শিশুর যত্ন কীভাবে নিতে হবে সেটাও আমরা বলে থাকি। তাই প্রসব-পরবর্তী সেবা অনেক গুরুত্বপূর্ণ।

প্রসূতিদের সেবা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা কতটুকু?

আমাদের সচেতনতা বাড়াতে হবে। -সংক্রান্ত শিক্ষাগুলো আমাদের স্কুল পর্যায় থেকে দেয়া উচিত। আর সবাই যদি সততার সঙ্গে কাজ করি তাহলে আমার মনে হয় না সেবা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা দূর করা খুব বেশি কঠিন হবে। আগে উঠান বৈঠক হতো, এখন সেটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। আমাদের মানে যেসব চিকিৎসকের গ্রামে সেবা দেয়ার কথা, তারাও কিন্তু সেখানে অবস্থান করছে না। মাঠ কর্মীরা গ্রামের বাসিন্দাদের আস্থা অর্জন করতে পারছে না। ফলে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে আসলে যে অর্থ ব্যয় বা বহন করতে হয় সেটার ভয়ে অনেকে আসতে চান না। অনেকে ভাবেন সেখানে গেলেই আমার হয়তো অপারেশন করতে হবে। ফলে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও বাড়িতে থাকতে চান। সেজন্য আমাদের সততা, নিষ্ঠা অর্থনৈতিক ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে।

কিশোরীদের গর্ভধারণ গর্ভকালীন জটিলতার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ঝুঁকি বাড়াচ্ছে কি?

অবশ্যই ঝুঁকি বাড়াচ্ছে। প্রথমত জরায়ুর ক্যানসারের বড় ঝুঁকি তৈরি করে কিশোরী গর্ভধারণ। অল্প বয়সে বিয়ে বা অল্প বয়সে গর্ভধারণ সবচেয়ে বড় ঝুঁকি। এটার কারণে গর্ভপাতও হতে পারে। সময়ের আগেই সন্তান প্রসব করতে পারে। পরবর্তী সময়ে উচ্চরক্তচাপ হতে পারে।

গর্ভকালীন জটিলতা প্রসূতির মৃত্যুঝুঁকির সঙ্গে নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকিকে প্রভাবিত করছে কি?

অল্প বয়সে সন্তান নেয়ার ক্ষেত্রে নবজাতকেরও মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয়। এছাড়া যদি প্রসবপূর্ব সেবাটা না দেয়া হয় তাহলে নবজাতকের মৃত্যুঝুঁকি তৈরি হয়। পেটে থাকাকালে সন্তান ঠিকমতো বেড়ে উঠল কিনা, পুষ্টি ঠিকমতো পাচ্ছে কিনা, ওজন ঠিক আছে কিনা, মায়ের পেটে ঠিক জায়গায় অবস্থান করছে কিনা এসব বিষয়ে জানতে চিকিৎসকের কাছে আসতে বলি আমরা।

অপুষ্ট শিশু জন্মের জন্য কি গর্ভকালীন জটিলতা দায়ী?

এক্ষেত্রে মায়ের পুষ্টি জরুরি। মা অপুষ্টিতে ভুগলে সন্তানও অপুষ্টিতে জন্ম নেবে। একজন অপুষ্টিতে ভোগা মা কখনই গর্ভকালীন দীর্ঘ সময়ের প্রক্রিয়া ভালোভাবে নিতে পারে না। ফলে তার ওপর ঝুঁকি তৈরি হয়। সন্তানও ঝুঁকির মধ্যে থেকে যায়।

মাতৃমৃত্যু কমানোর জন্য কী কী পদক্ষেপ নেয়া যেতে পারে বলে আপনি মনে করছেন?

অল্প বয়সের বিয়ে বন্ধ করতে হবে। তারপর প্রসবকালীন পরবর্তী সময়ে রক্তক্ষরণ, রক্তশূন্যতা এবং খিঁচুনি বন্ধ করা বা রোধ করা দরকার। মায়েদের প্রাতিষ্ঠানিক (বাড়িতে প্রসব না করে স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে আসা) প্রসবের জন্য উৎসাহিত করতে হবে। তাহলে রক্তক্ষরণ রক্তশূন্যতা এবং খিঁচুনি রোধে আমরা সহায়তা করতে পারব। প্রসবপূর্ব পরবর্তী সেবা পরিপূর্ণভাবে নিতে হবে।     

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন