লেদার ইঞ্জিনিয়ার তৈরির সূতিকাগার

ফিচার প্রতিবেদক

উই লাভ পিপল, উই লাভ ন্যাচার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির (আইএলইটি) গেট দিয়ে প্রবেশের পর প্রথমেই চোখে পড়বে লেখাটি। নীল অপরাজিতা গাছের সবুজ চাদরে মোড়ানো ফুল বাগানের বেষ্টনীর মাঝে একটি স্থায়ী ব্যানার। মানুষ প্রকৃতিকে ভালোবাসার বার্তা দিতেই হয়তো আয়োজন। অবশ্য ল্যাব গবেষণাগারে শিক্ষার্থীদের কর্মযজ্ঞ দেখে এর সত্যতাও মিলল। চামড়া চামড়াজাত পণ্য মানুষের ক্ষতি না করে পরিবেশবান্ধব উপায়ে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সেসব নিয়ে গবেষণা করছেন শিক্ষার্থীরা।

আইএলইটি ইনস্টিটিউটের সুনামের জন্য সুদূর কেনিয়া থেকে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে পড়তে এসেছেন রেমন্ড সিকুকু নামে এক শিক্ষার্থী। ইনস্টিটিউটের ইতিহাসে প্রথম বিদেশী শিক্ষার্থী জানালেন ইনস্টিটিউটের গবেষণাগার খুবই সমৃদ্ধ আধুনিক। লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের খুঁটিনাটি সব বিষয়ই হাতে-কলমে শেখানো হয় এখানে। আন্তর্জাতিক যেকোনো শিল্প-কারখানায় নেতৃত্ব দেয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে।

শিক্ষার্থীদের জন্য আইএলইটিতে রয়েছে সমৃদ্ধ গ্রন্থাগার, আধুনিক প্রযুক্তিসম্পন্ন ল্যাব গবেষণাগার। লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং লেদার প্রডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের তিনটি ল্যাব যেন একেকটি কারখানা। একটি পূর্ণাঙ্গ কারখানায় যে ধরনের সরঞ্জাম দরকার তার সবই রয়েছে সেখানে। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়া করে ফিনিশড লেদার তৈরি, চামড়াজাত প্রডাক্ট ডিজাইন প্যাটার্ন তৈরি থেকে শুরু করে ফুটওয়্যার তৈরিসহ সব কাজই করছেন শিক্ষার্থীরা।

কাজের প্রক্রিয়া নিয়ে লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক মো. সাইদুর রহমান শাকিল জানান, ল্যাবে তিনটি ধাপে কাঁচা চামড়া থেকে তৈরি হয় ফিনিশড লেদার। প্রথম ধাপ প্রি-ট্যানিংয়ে কাঁচা চামড়া ভালোভাবে ওয়াশ করে লোমমুক্ত করা হয় এবং কয়েক ধাপ প্রক্রিয়াকরণের পর তা পরবর্তী ধাপ ট্যানিংয়ের জন্য প্রস্তুত করা হয়। ট্যানিং ধাপে বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহারের মাধ্যমে কাঁচা চামড়া অপচনশীল ওয়েট ব্লুতে রূপান্তর করা হয়। ওয়েট ব্লু আরো কিছু কেমিক্যালের সাহায্যে ক্রাস্ট লেদারে পরিণত করা হয়। সবশেষে ক্রাস্ট লেদারের ওপর নানা ধরনের রঙ এবং ডিজাইনের ফিল্ম প্রয়োগের মাধ্যমে সমাপ্ত হয় ফিনিশড লেদার বানানোর প্রক্রিয়া।

তো গেল কাঁচা চামড়া থেকে ফিনিশড লেদার তৈরির প্রক্রিয়া। এরপর রয়েছে চামড়া দিয়ে বিভিন্ন পণ্য তৈরি। আর এজন্য রয়েছে লেদার প্রডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের একটি ল্যাব, যেখানে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি অবলম্বন করে বিভিন্ন যন্ত্রের সাহায্যে ফিনিশড চামড়া দিয়ে তৈরি করা হয় চামড়াজাত জ্যাকেট, ব্যাগসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য। পণ্যের ডিজাইন করে সে অনুযায়ী প্যাটার্ন (বেসিক প্যাটার্ন, মেকিং প্যাটার্ন, কাটিং প্যাটার্ন) তৈরি করে নেয়া হয়। প্যাটার্ন দিয়ে লেদার, লাইনিং, রি-এনফোর্সমেন্টের মতো উপকরণগুলো কেটে নিয়ে ডিজাইন অনুযায়ী বিভিন্ন অংশ একত্র করে সেলাই ফিনিশিংয়ের মাধ্যমে তৈরি হয় চামড়াজাত পণ্য। সবশেষ আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম ব্যবহার করে সম্পন্ন হয় পণ্য আকর্ষণীয় করে তোলার কাজ।

দৈনন্দিন জীবনে চামড়াজাত পণ্য ব্যবহারের মধ্যে অন্যতম হলো জুতা। বিভিন্ন ঋতু, উৎসব, নানা উপলক্ষকর্মক্ষেত্র, আড্ডা বা ঘোরাঘুরি, খেলাধুলা, ভ্রমণ কেন্দ্র করে প্রতিনিয়তই আমরা বাহারি জুতা পরে থাকি। এসব জুতা তৈরিতে ডিজাইন থেকে শুরু করে অতিক্রম করতে হয় বিভিন্ন ধাপ। জুতা তৈরির জন্য শিক্ষার্থীরা প্রথমে ডিজাইন প্যাটার্ন তৈরি করেন। তৈরি জুতার বিভিন্ন অংশের প্যাটার্নগুলো ফিনিশড লেদারের ওপর বসিয়ে কেটে নেয়া অংশগুলোকে সেলাইয়ের মাধ্যমে প্রস্তুত হয় জুতার ওপরের অংশ। এরপর লাস্টিং প্রক্রিয়ার মাধ্যমে জুতাকে তার কাঙ্ক্ষিত আকৃতি দেয়া হয়। সর্বশেষ সোলিং উপকরণ যুক্ত করে ফিনিশিংয়ের মাধ্যমে তৈরি হয়ে যায় ক্রেতার পছন্দসই জুতা। তাত্ত্বিক ব্যবহারিক উভয় জ্ঞানের প্রয়োগ হয় ল্যাবে। ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষার্থীরা দেশীয় কোম্পানি বাটা, এপেক্সসহ বিশ্বখ্যাত ব্র্যান্ড এডিডাসে চাকরি করছেন বলে জানালেন ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রভাষক মো. রায়হান সরকার।

এই ইনস্টিটিউটের রয়েছে গৌরবময় ইতিহাসও। ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর ইস্ট বেঙ্গল ট্যানিং ইনস্টিটিউট নামে যাত্রা হয়। পরবর্তী সময়ে ১৯৬৭ সালে ইনস্টিটিউটের নাম হয় পাকিস্তান লেদার টেকনোলজি। স্বাধীনতার পর, ইনস্টিটিউটের নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ লেদার টেকনোলজি কলেজ রাখা হয় এবং এটি ১৯৭৯ সাল পর্যন্ত লেদার টেকনোলজির ওপর ডিপ্লোমা কারিগর পর্যায়ে শিক্ষাদান শুরু করে। ১৯৮০ সালে প্রতিষ্ঠানটিকে বাংলাদেশ কলেজ অব লেদার ইঞ্জনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞান অনুষদের অধীনে নিয়ে আসা হয়। শুরু হয় লেদার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে বিএসসি ডিগ্রি। ২০১১ সালে ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজি নামে প্রতিষ্ঠানটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি ইনস্টিটিউট হিসেবে নতুন উদ্যমে যাত্রা করে। বর্তমানে ইনস্টিটিউটে স্নাতক স্নাতকোত্তর পর্যায়ে তিনটি বিষয়ে শিক্ষাদান করা হয়। লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং, ফুটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এবং লেদার প্রডাক্টস ইঞ্জিনিয়ারিং।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড টেকনোলজির পরিচালক অধ্যাপক . মোহাম্মদ মিজানুর রহমান বলেন, দেশের শিল্পোদ্যোক্তা বিদেশী বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে ১৯৯৩ সালের পাঠ্যক্রম পরিবর্তন করে আধুনিক পাঠ্যক্রম প্রণয়ন করা হয়েছে। গ্র্যাজুয়েটরা চামড়া শিল্পের আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত হচ্ছেন। বর্তমান পাঠ্যক্রম শিল্পভিত্তিক হওয়ায় গ্র্যাজুয়েশন শেষে কোনো শিক্ষার্থীকে একদিনও বেকার থাকতে হয় না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন