দেশে রেমিট্যান্স আনায় বিপ্লব ঘটিয়েছেন ব্যাংকগুলোর নিয়োগ দেয়া এজেন্টরা। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে আসা প্রবাসী আয়ের পরিমাণ ১ লাখ কোটি টাকার মাইলফলক ছাড়িয়েছে। চলতি বছরের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত নতুন ধারার এ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এসেছে ১ লাখ ৬ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা। এর প্রায় ৯৬ শতাংশই এসেছে কেবল পাঁচটি ব্যাংকের এজেন্টদের মাধ্যমে। ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড এনেছে একাই ৫২ শতাংশ রেমিট্যান্স। বাংলাদেশ ব্যাংকের এজেন্ট ব্যাংকিং-সংক্রান্ত ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এজেন্টদের মাধ্যমে রেমিট্যান্সের অর্থ বিতরণে ডাচ্-বাংলা ব্যাংকও বড় ধরনের সাফল্য পেয়েছে। ২৪ দশমিক ৪৮ শতাংশ রেমিট্যান্স এনে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছেন বেসরকারি এ ব্যাংকটির এজেন্টরা। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স বিতরণ করা বাকি তিন ব্যাংক হলো ব্যাংক এশিয়া, আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক ও রাষ্ট্রায়ত্ত অগ্রণী ব্যাংক লিমিটেড।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এজেন্টদের মাধ্যমে রেমিট্যান্সের বড় অংশই এসেছে গত তিন বছরে। ২০১৯ সাল শেষেও ব্যাংকগুলোর এ প্রতিনিধিদের মাধ্যমে আসা মোট রেমিট্যান্সের পরিমাণ ছিল মাত্র ১৫ হাজার ৫৩৪ কোটি টাকা, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর শেষে যা ১ লাখ ৬ হাজার ৬২৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ হিসাবে তিন বছরেরও কম সময়ে এসেছে ৯১ হাজার ৯৪ কোটি টাকা। মূলত এজেন্টদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আসার স্রোত শুরু হয় করোনাভাইরাস সৃষ্ট বৈশ্বিক দুর্যোগের সময়ে। এর মধ্যে ২০২০ সালে এজেন্টদের মাধ্যমে ৩৩ হাজার ২৭২ কোটি টাকার রেমিট্যান্স আসে। আর ২০২১ সালে বিশেষ এ ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রবাসী আয় এসেছে ৩৩ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা। চলতি বছরের প্রথম নয় মাসেই (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) এজেন্টদের মাধ্যমে দেশে ২৪ হাজার ২৮৫ কোটি টাকার রেমিট্যান্স এসেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এজেন্টরা এখন প্রবাসী পরিবারের বন্ধুতে রূপান্তর হয়েছেন। বাড়ির কাছের হাটবাজারে এজেন্ট আউটলেট পাওয়া যাচ্ছে। এ কারণে প্রবাসীরা নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে এজেন্ট ব্যাংকিংকে বেছে নিচ্ছেন। আবার অনেক এজেন্ট রেমিট্যান্সের অর্থ প্রবাসীদের ঘরেও পৌঁছে দিচ্ছেন। এতে প্রবাসী পরিবারের ভোগান্তি যেমন কমছে, তেমনি নিরাপদে অর্থপ্রাপ্তির বিষয়টিও নিশ্চিত হয়েছে।
দেশে এজেন্ট ব্যাংকিং চালু করার স্বপ্নদ্রষ্টাদের একজন ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আরফান আলী। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, এজেন্ট ব্যাংকিং চালুর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল রেমিট্যান্স বিতরণ প্রক্রিয়া সহজ করা। এ প্রক্রিয়ায় বাড়ির কাছে ব্যাংকের এজেন্ট পাওয়া যায়। এ কারণে প্রবাসীরা নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য এজেন্ট ব্যাংকিংকে বেছে নিচ্ছেন। বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে প্রবাসীরা এ মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছেন। ব্যাংকগুলো প্রচার-প্রচারণা বাড়ালে আগামীতে এজেন্টদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স প্রবাহ আরো বাড়বে।
এজেন্ট ব্যাংকিং চালু না হলে এ মাধ্যমে আসা রেমিট্যান্সের বড় একটি অংশ হুন্ডিতে চলে যেত বলে মনে করেন আরফান আলী। তিনি বলেন, প্রবাসী পরিবার এখন ঘরে বসে কিংবা বাড়ির কাছের হাটবাজারে গিয়ে রেমিট্যান্সের অর্থ পাচ্ছে। আগে হুন্ডি কারবারিরা এ প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্সের অর্থ পৌঁছাত। এজেন্টদের কারণে এখন গ্রামেগঞ্জে হুন্ডির তত্পরতা অনেকটাই কমেছে। তবে বৈধ মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর জন্য প্রবাসীদের উৎসাহ দিতে হবে। এজেন্টদের মাধ্যমে রেমিট্যান্স এলে তার জন্য সার্টিফিকেট ইস্যু করা হয়। এটি ব্যবহার করে প্রবাসীদের কর অব্যাহতি পাওয়ার সুযোগ আছে। এজেন্টদের ব্যবহার করে ব্যাংকগুলো প্রবাসী পরিবারের সন্তানদের উদ্যোক্তা হিসেবেও গড় তুলতে পারে। আবার প্রবাসীদের সন্তানদের জন্য শিক্ষাবৃত্তি, আইনগত সহায়তাসহ বিভিন্ন ধরনের উদ্যোগ নেয়া হলে এজেন্ট ব্যাংকিং আরো বেশি জনপ্রিয়তা পাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫৫ হাজার ৫৩৭ কোটি টাকা রেমিট্যান্স এসেছে ইসলামী ব্যাংকের এজেন্টদের মাধ্যমে। অর্থাৎ এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে দেশে আসা প্রবাসী আয়ের ৫২ শতাংশই এনেছে দেশের সর্ববৃহৎ এ ব্যাংক। এজেন্ট আউটলেট ও ব্যাংক হিসাব খোলার দিক থেকে ইসলামী ব্যাংকের অবস্থান তৃতীয়। যদিও আমানত সংগ্রহ ও রেমিট্যান্স আহরণের দিক থেকে তাদের অবস্থান শীর্ষে। সারা দেশে বতর্মানে বেসরকারি এ ব্যাংকের এজেন্ট আউটলেট রয়েছে ২ হাজার ৬৯২টি। আর এজেন্টরা চালু করেছেন ৩২ লাখ ১৪ হাজার ব্যাংক হিসাব। এসব হিসাবে ১২ হাজার ৩৮১ কোটি টাকার আমানত জমা হয়েছে। তবে এজেন্টদের মাধ্যমে ঋণ বিতরণে ইসলামী ব্যাংক এখনো বেশ পিছিয়ে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটি এ মাধ্যমে মাত্র ২১৬ কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে।
এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে রেমিট্যান্স আহরণের দ্বিতীয় স্থানটি ডাচ্-বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বেসরকারি এ ব্যাংকের এজেন্টরা ২৬ হাজার ১০৫ কোটি টাকার রেমিট্যান্স এনেছেন। তবে ৬ হাজার ৫টি এজেন্ট আউটলেট খুলে এক্ষেত্রে সবার শীর্ষে আছে ডাচ্-বাংলা। এসব আউটলেট ব্যবহার করে ব্যাংকটি চালু করেছে ৫১ লাখ ২৭ হাজার ৩৬১টি ব্যাংক হিসাব। দেশের মোট এজেন্ট আউটলেটের ৩০ শতাংশ ও ব্যাংক হিসাবের প্রায় ৩১ শতাংশই ডাচ্-বাংলা ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে।
এজেন্ট ব্যাংকিং ধারণার উত্পত্তি লাতিন আমেরিকার দেশ ব্রাজিলে। দ্রুততম সময়ের মধ্যে এ ব্যাংকিং ধারণা ছড়িয়েছে চিলি, কলম্বিয়া, পেরু ও মেক্সিকোয়। বিস্তৃত হয়েছে কেনিয়াসহ আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতে। প্রতিবেশী ভারতেও আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশে সেবাটি চালু করা হয়েছে। একই উদ্দেশ্য নিয়ে ২০১৩ সালের ৯ ডিসেম্বর এজেন্ট ব্যাংকিং কার্যক্রম পরিচালনা-সংক্রান্ত নীতিমালা জারি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০১৪ সালের জানুয়ারিতে পাইলট কার্যক্রমের অংশ হিসেবে প্রথম এজেন্ট নিয়োগ দেয় ব্যাংক এশিয়া। এরপর অন্যান্য ব্যাংকও দ্রুততম সময়ের মধ্যে এজেন্ট ব্যাংকিংয়ে যুক্ত হয়।
ব্যাংক এশিয়া সারা দেশে ৫ হাজার ৩৫১টি এজেন্ট আউটলেট চালু করেছে। দেশের সব ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে এজেন্ট আউটলেট দিয়েছে ব্যাংকটি। এজেন্টদের মাধ্যমে হিসাব খোলার দিক থেকে ব্যাংক এশিয়ার অবস্থান সবার শীর্ষে। সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকটির এজেন্টরা খুলেছেন ৫৪ লাখ ৩১ হাজার ১৮৮টি ব্যাংক হিসাব। এসব হিসাবে ৩ হাজার ৮৩২ কোটি টাকার আমানত জমা হয়েছে। আর ব্যাংক এশিয়ার এজেন্টদের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ১১ হাজার ১১৯ কোটি টাকা। এজেন্টদের মাধ্যমে দেশে আসা রেমিট্যান্সের ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশই এসেছে ব্যাংক এশিয়ার মাধ্যমে।
আল-আরাফাহ্ ইসলামী ব্যাংক এজেন্টদের মাধ্যমে দেশে রেমিট্যান্স এনেছে ৫ হাজার ৭০৮ কোটি টাকা। ব্যাংকটি সারা দেশে ৬৪৯টি আউটলেট খুলেছে। এজেন্টদের মাধ্যমে আল-আরাফাহ্র চালু করা হিসাব ৬ লাখ ৬২ হাজার ১৬টি। এসব ব্যাংক হিসাবে ৩ হাজার ৬৮৭ কোটি টাকার আমানত জমা রয়েছে। এরই মধ্যে এজেন্টদের মাধ্যমে ৩৪৮ কোটি টাকার ঋণও বিতরণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৩১টি সরকারি-বেসরকারি ব্যাংক। সারা দেশে এ ব্যাংকগুলো ১৪ হাজার ৬৬৩ এজেন্ট নিয়োগ দিয়েছে। নিয়োগপ্রাপ্ত এজেন্টরা চালু করেছেন ২০ হাজার ১৭৭টি আউটলেট। এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে এরই মধ্যে ১ কোটি ৬৭ লাখ ৮০ হাজার ৫৭৬টি হিসাব খোলা হয়েছে। এজেন্টদের খোলা হিসাবের ৮১ লাখ ৯৫ হাজার ৭৯০টি খুলেছেন নারীরা, যা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে চালু করা হিসাবের ৪৮ দশমিক ৮৪ শতাংশ।
স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে শহরাঞ্চলকে ঘিরে বিকশিত হয়েছে বাংলাদেশের ব্যাংকগুলো। এ কারণে তাদের খোলা শাখার বড় অংশই নগরে সীমাবদ্ধ ছিল। তবে এজেন্ট ব্যাংকিং আসার পর নগর ব্যাংকিংয়ের ধারণাকে ভেঙে দিয়েছে। গ্রামাঞ্চলকে প্রাধান্য দিয়ে বিকশিত হয়েছে নতুন এ ব্যাংক ব্যবসা। এ কারণে ব্যাংকগুলোর এজেন্ট আউটলেটের ৮৬ শতাংশই চালু হয়েছে প্রত্যন্ত অঞ্চলে। এজেন্টদের খোলা ব্যাংক হিসাবের ৮৬ শতাংশও গ্রামাঞ্চলের লোকজনের। এ তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে ব্যাংকগুলো সংগ্রহ করেছে ৩০ হাজার ৬৬৩ কোটি টাকার আমানত। একই সময়ে ব্যাংকগুলো ৮ হাজার ৮৮০ কোটি টাকার ঋণও বিতরণ করেছে।
বাংলাদেশ ব্যাংক যখন এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের নীতিমালা জারি করে তখন গভর্নর ছিলেন অর্থনীতিবিদ ড. আতিউর রহমান। এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক এ গভর্নর বণিক বার্তাকে বলেন, এজেন্টরা ব্যাংকেরই প্রতিনিধি। এটি নতুন মডেলের ব্যাংকিং। ব্যাংকের এজেন্ট হওয়ার মাধ্যমে গ্রামে একজন উদ্যোক্তা তৈরি হয়। ওই উদ্যোক্তা নিজে আরো কয়েকজনের কর্মসংস্থান তৈরি করেন। এজেন্টদের যথাযথভাবে ব্যবহার করা হলে দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব।
ড. আতিউর রহমান আরো বলেন, এজেন্টদের কাজের পরিধি বাড়ালে তাদের ব্যবসা ও মুনাফা বাড়বে। বিশেষ করে স্কুলের শিক্ষার্থীদের বৃত্তি, বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতাসহ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা ভাতাগুলো এজেন্টদের মাধ্যমে বিতরণ হলে এক্ষেত্রে আরো বেশি স্বচ্ছতা আসবে। এজেন্টদের মাধ্যমে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি রেমিট্যান্স আসা অবশ্যই বড় মাইলফলক। এ মাধ্যমে রেমিট্যান্স আহরণ আরো বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। হুন্ডির সঙ্গে সম্পৃক্তরা প্রবাসীদের কর্মস্থলে গিয়ে অর্থ নিয়ে আসেন। আবার দেশে প্রবাসীর স্বজনের কাছে তারা নিজেরাই রেমিট্যান্স পৌঁছে দিচ্ছেন। মানি এক্সচেঞ্জগুলো প্রবাসীদের জন্য একটি মোবাইল অ্যাপ চালু করতে পারে। তাতে মরুভূমিতে কাজ করা প্রবাসীরাও অ্যাপের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারবেন।