প্রিডায়াবেটিস

সচেতন হোন শুরু থেকেই

ডায়াবেটিস হওয়ার আগে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা সাধারণের তুলনায় বৃদ্ধি পায় বা প্রান্তিক সীমায় থাকে। অবস্থাকে বলে ইম্পেয়ার্ড গ্লুকোজ টলারেন্স বা অনেক সময় একে প্রিডায়াবেটিস হিসেবেও অভিহিত করা হয়। পুরোপুরি ডায়াবেটিসের মাত্রায় না পৌঁছালেও সঠিক নিয়মে জীবনযাপন না করলে অবস্থা থেকে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি থাকে সবচেয়ে বেশি।

আমাদের দেশের প্রায় ৩৬ লাখ মানুষ প্রিডায়াবেটিস পর্যায়ে রয়েছে। তবে তাদের মধ্যে মাত্র শতাংশেরও কম মানুষ জানে যে তারা ডায়াবেটিসের ঝুঁকিতে আছে। যদিও বা জানে, খুব কমসংখ্যক মানুষই নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপনের মাধ্যমে ঝুঁকি কমানোর চেষ্টা করে। অথচ একটু সদিচ্ছা, জীবনযাত্রার সামান্য পরিবর্তন ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে বড় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।

কীভাবে বুঝবেন আপনার প্রিডায়াবেটিস আছে? সেজন্য রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা পরীক্ষা করাতে হবে। আমাদের রক্তে গ্লুকোজের স্বাভাবিক মাত্রা থেকে ১২ ঘণ্টা না খেয়ে থাকা অবস্থায় প্রতি লিটার রক্তে মিলিমোল বা তার কম এবং খাবারের ঘণ্টা পরে দশমিক মিলিমোলের কম। যদি প্রতি লিটার রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা না খেয়ে থাকা অবস্থায় মিলিমোল বা তার বেশি এবং খাবারের ঘণ্টা পর ১১ দশমিক মিলিমোল বা তার বেশি হয়, তখন তাকে ডায়াবেটিস হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্বাভাবিক অবস্থা ডায়াবেটিসের মাঝামাঝি অবস্থায় থাকলে তাকে বলা হয় ইম্পেয়ার্ড গ্লুকোজ টলারেন্স বা প্রিডায়াবেটিস।

প্রিডায়াবেটিস থেকে ডায়াবেটিস হওয়ার সবচেয়ে বড় ঝুঁকির কারণ হলো অতিরিক্ত ওজন। উচ্চতা সাপেক্ষে ওজনের অনুপাত অর্থাৎ বিএমআই যদি ২৫ বা তার বেশি হয়, তাহলে ধরে নেয়া যাবে, আপনি অতিরিক্ত ওজনের অধিকারী, আর তা যদি ৩০ এর বেশি হয় তাহলে আপনি স্থূলকায়। কাজেই ওজন মেপে নিন, অতিরিক্ত হলে ঝরিয়ে ফেলুন। গবেষণা বলছে, প্রতি কেজি ওজন কমালে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমে শতকরা ১৬ ভাগ, অর্থাৎ মাত্র কেজি বাড়তি ওজন কমাতে পারলে আপনার ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি কমে যাবে শতকরা ৮০ ভাগ পর্যন্ত। ওজন কমানোর জন্য প্রথমেই যে জিনিসটা দরকারি, তা হলো পরিমিত আহার। পরিমিত আহার মানে কিন্তু ডায়েট কন্ট্রোলের নামে অপুষ্টিতে ভোগা নয়।

সব রকমের খাদ্য উপাদান শরীর যেন পায় ঠিকমতো, তাই খেতে হবে নিয়ম মেনে। অতিরিক্ত ক্যালরি শর্করাযুক্ত খাবার বাদ দিতে হবে তালিকা থেকে। কোন শর্করাজাতীয় খাবার রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কতখানি বাড়ায়, তার ভিত্তিতে ভাগ করা হয়েছে দুই ভাগেহাই গ্লাইসেমিক ইনডেক্স, যেগুলো রক্তে সহজেই গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয় এবং লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স, যেগুলো গ্লুকোজের মাত্রা বাড়ায় ধীরে ধীরে। চিকন সাদা চালের ভাত, ময়দা, কোমল পানীয়, চিনি, গুড় কিংবা নানা পদের মিষ্টান্ন, এগুলো হাই গ্লাইসেমিক ইনডেক্স শর্করা। তাই এগুলো খেতে হবে বুঝেশুনে, পরিমাণমতো। অন্যদিকে লাল ঢেঁকিছাটা চাল, লাল আটা, রঙিন শাকসবজি এগুলো লো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স। তাই প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় এসব থাকা চাই।

গরু কিংবা খাসির লাল মাংস রক্তে ক্ষতিকর চর্বির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, যা কিনা ডায়াবেটিসের অন্যতম কারণ। অন্যদিকে মাছে থাকে প্রচুর ওমেগা- ফ্যাটি এসিড, এটা শরীরের জন্য ভালো। তাই নিত্যদিনের লাল মাংস খাবার অভ্যাস ত্যাগ করা উচিত। সেই সঙ্গে কমানো উচিত ফাস্টফুড কোমল পানীয় খাওয়ার পরিমাণ। কেননা এগুলোর অতিরিক্ত তেল চর্বি শর্করা বাড়িয়ে দেয় ডায়াবেটিসের ঝুঁকি। মাছে ভাতে বাঙালি হওয়াটা কেবল ঐতিহ্যগতভাবেই ভালো নয়, স্বাস্থ্যের জন্যও ভালো। খেতে হবে প্রচুর শাকসবজি। রঙিন সবজি একদিকে যেমন ভিটামিন খনিজ লবণের আধার, তেমনি এগুলো ক্ষুধা মিটিয়ে কমিয়ে দেয় অতিরিক্ত শর্করা গ্রহণের মাত্রা। গবেষণায় দেখা যায়, টাইপ- ডায়াবেটিস রোগী বা ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স সমস্যা যাদের, তাদের প্রচুর শ্বেতসার আহারের আগে টেবিল চামচ ভিনেগার খেয়ে নিলে রক্তের সুগার কমে আসে। ভিনেগারে রয়েছে অ্যাসিটিক এসিড, যা শ্বেতসার পরিপাক করার এনজাইমদের নিষ্ক্রিয় করে শ্লথ করে দেয় শ্বেতসার পরিপাকক্রিয়া।

রক্তের সুগারের ওপর ভিনেগারের প্রভাবটি ডায়াবেটিসের ওষুধ একারবোসের মতোই। আহারে ভাত-মাছ খাওয়ার আগে তিন টেবিল চামচ ভিনেগার, টকদই, সামান্য মধু গোলমরিচের ড্রেসিং দিয়ে বানানো সালাদ সবজি আপনার রুচিশীলতা বাড়িয়ে দেবে বহুগুণ।

ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমাতে খাবারের পরই আসে ব্যায়ামের কথা। আর হাঁটার চেয়ে সহজ ভালো ব্যায়াম আর কী হতে পারে? যুক্তরাষ্ট্রের একটা গবেষণায় দেখা যায়, প্রতিদিন মাত্র আধা ঘণ্টা হাঁটা ডায়াবেটিসের ঝুঁকি অর্ধেকে নামিয়ে আনে। ব্যায়াম করলে দেহকোষের ইনসুলিন রিসেপ্টরের সংখ্যা বাড়ে। এতে শরীর ইনসুলিন হরমোনকে আরো কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারে। হাঁটা ছাড়াও সাঁতার, সাইকেল চালানো ভালো ব্যায়াম হতে পারে।

ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমানোর আর একটা ভালো উপায় মানসিক চাপ কমানো। অতিরিক্ত মানসিক চাপ, দুশ্চিন্তা শরীরের সিমপ্যাথেটিক সিস্টেমকে কার্যকর করে। এমন অবস্থায় মস্তিষ্ক রক্তে এমন কিছু হরমোনের পরিমাণ বাড়িয়ে দেয়, যেগুলো গ্লুকোজের বিপাক প্রক্রিয়া ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ বাড়ে। তাই সবসময় ইতিবাচক চিন্তা করুন। মেডিটেশন করা যেতে পারে। নিয়মিত প্রার্থনা মনকে প্রশান্ত রাখতে সহায়ক। পরিবার পরিজন নিয়ে কোথাও থেকে বেড়িয়ে আসতে পারেন।

নিয়মিত ভালো ঘুমও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি কমায়। নিয়মিত রক্ত পরীক্ষা করে দেখে নিন কোন অবস্থায় আছে গ্লুকোজের মাত্রা। ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকলে সুস্থ থাকার নিয়মগুলো মেনে চলুন।

 

ডা. শাহজাদা সেলিম

সহযোগী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন