স্বাস্থ্যযত্ন

সরকারকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বেশি মনোযোগ দিতে হবে

চিকিৎসাবিজ্ঞানী শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ডা. লিয়াকত আলী দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা করছেন। পেশাগত জীবনে স্বাস্থ্যশিক্ষা স্বাস্থ্যসেবায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন তিনি। ডায়াবেটিস, প্রতিকার, চিকিৎসা নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাত্কার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

ডায়াবেটিস বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে কেন?

এটি জনস্বাস্থ্যের জন্য সাংঘাতিক উদ্বেগের কারণ। সারা বিশ্বে ডায়াবেটিস বাড়ছে। নিম্ন নিম্নমধ্যম আয়ের দেশগুলোর প্রতি চারজনের তিনজনই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। রোগ অর্থনৈতিকভাবে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করছে। ডায়াবেটিস সে অর্থে একক রোগ নয়। এটি অনেকগুলো রোগের সমাহার। এটি নিজে যত ভয়ংকর তার চেয়ে বেশি জটিলতা তৈরি করে। কভিডের সময় সবচেয়ে বেশি মারা গেছেন ডায়াবেটিসের রোগীরা। এর কারণে হূদরোগের ঝুঁকি চার গুণ বেড়েছে। ধারণা করা হয়েছিল, বিশ্বে ২০৪০ সালে ৬৪ কোটি ডায়াবেটিস রোগী পাওয়া যাবে। তবে এখন মনে করা হচ্ছে সংখ্যা ২০৩০ সালেই হয়ে যাবে। ইন্টারন্যাশনাল ডায়াবেটিস ফেডারেশনের তথ্য অনুযায়ী, এখনই ৫৩ কোটি রোগী। ধারণা করা হয়েছিল ২০৪০ সালে ৬৪ কোটি হবে, সেটি ২০৩০ সালেই হয়ে যাচ্ছে। ২০৪৫ সালে সেটা ৭৮ কোটি হবে। সাধারণ মানুষ এমনিতেই স্বাস্থ্য ব্যয় মেটাতে পারে না। ডায়াবেটিস সারা জীবনের রোগ। এর জন্য হূদরোগ, কিডনি, চোখ অন্যান্য জটিলতা মিলিয়ে ভয়ংকর একটা চিত্র ধারণ করে। ফলে ডায়াবেটিস বৈশ্বিক জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুতর সমস্যা।

উচ্চরক্তচাপ ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী, নাকি ডায়াবেটিসের জন্য উচ্চরক্তচাপ হতে পারে?

ডায়াবেটিস উচ্চরক্তচাপের কারণ। ডায়াবেটিসের কারণে রক্তনালির বিভিন্ন পরিবর্তন দেখা যায়। টাইপ টু ডায়াবেটিসে ইনসুলিন অনেক সময় বেড়ে যায়। বৃদ্ধিপ্রাপ্ত ইনসুলিন রক্তনালির ক্ষতি করে। ইনসুলিন একই সঙ্গে বন্ধু আবার শত্রুও। নানা কারণে ইনসুলিন রক্তনালির পরিবর্তন করে। এতে উচ্চরক্তচাপ তৈরি হয়।

ডায়াবেটিস কোন কোন দীর্ঘমেয়াদি রোগকে প্রভাবিত করে?

ডায়াবেটিস হার্ট অ্যাটাক, উচ্চরক্তচাপ স্ট্রোকের প্রভাবক হিসেবে কাজ করে। এগুলো মাইক্রোভাসকুলার। বড় বড় রক্তনালি দিয়ে যেগুলো হচ্ছে সেসব কার্ডিওভাসকুলারকে ম্যাক্রো ভাসকুলার বলা হয়। অন্যটি হলো মাইক্রো ভাসকুলার। আমাদের শরীরের অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রক্তনালির ক্ষেত্রে কিডনি, চোখ, রেটিনায় অসুখ হতে পারে। আবার নিউরোপ্যাথি বা নার্ভের (স্নায়ু) ক্ষতি করছে ডায়াবেটিস। যার ফলে আঘাত বা ক্ষত হলে আমরা টের পাই না। গর্ভকালে এটি হলে বাচ্চার জন্য মারাত্মক সমস্যা হয়।

ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য সার্জারিতে ঝুঁকি বেশি কেন?

যখন আপনার শরীরে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় তখন প্রত্যেক অঙ্গপ্রতঙ্গে গ্লুকোজের অতিরিক্ত মাত্রা পৌঁছে যায়। ফলে শরীরের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যায়, গ্লুকোজ হলো রোগ-জীবাণুর আদর্শ খাদ্য। সেখানে এই জীবাণুগুলো অনুকূল পরিবেশ পায়। এতে সংক্রমণ ঘটে।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ডায়াবেটিসকে প্রভাবিত করছে কিনা?

এটি প্রচণ্ডভাবে দায়ী। কায়িক শ্রম না করলে ইনসুলিনের সংবেদনশীলতা অর্থাৎ কার্যকারিতা অনেক কমে যায়। নগরায়ণের ফলে আমাদের কায়িক শ্রম কমে গেছে। অন্যদিকে খাদ্যাভ্যাসও বদলে গেছে। তার সঙ্গে রয়েছে বিষাক্ত পরিবেশ। অনিয়ন্ত্রিত খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রম জীবনাচার ডায়াবেটিসকে রোগকে প্রভাবিত করে। নগরায়ণ এসব কারণকে ত্বরান্বিত করছে।

বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে, নাকি যেকোনো বয়সে ডায়াবেটিস দেখা দিতে পারে? নারী পুরুষের মধ্যে কাদের ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বেশি?

শিশুদের মধ্যে টাইপ- দেখা দেয়। এখানে জিনের প্রভাব বেশি রয়েছে। তবে পরিবেশও ভূমিকা পালন করে। টাইপ-- ইনসুলিন তৈরি হয় না। আমাদের দেশেও টাইপ- ডায়াবেটিস দেখা দেয়, তবে সংখ্যাটা বেশি নয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ২০ বা ২৫ বছরের পর ডায়াবেটিস ধরা পড়ে। বয়সের সঙ্গে আমাদের যে ইনসুলিনের কার্যকারিতা কায়িক শ্রমের পরিমাণ কমে যাওয়া খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তনের ফলে এটি বাড়তে দেখা দেয়। আমাদের দেশে নারী-পুরুষদের মধ্যে এর ঝুঁকির তফাত নেই। তবে ইদানীং আশঙ্কাজনক হারে আমাদের দেশে নারীদের মধ্যে রোগের প্রবণতা বাড়ছে। আগে গ্রামাঞ্চলে নারীদের পরিশ্রম করতে হতো, তাদেরও কায়িক শ্রমের মাত্রা কমে গেছে। ফলে পুরুষদের চেয়ে নারীদের মধ্যে ওজনাধিক্য বাড়ছে। ফলে তারা বেশি ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হচ্ছেন। এটি জিনের জন্য নয়, জীবনাচারের জন্য। 

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা যায়, ডায়াবেটিস আক্রান্তদের অর্ধেক জানে না তারা ডায়াবেটিস রোগী। না জানার কারণ কী?

যেহেতু আমাদের দেশে সচেতনতার অভাব, চিকিৎসাসেবা ব্যবস্থা, সমন্বিত উদ্যোগ প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার প্রচারণার অভাবসহ নানা কারণ রয়েছে। এছাড়া যথাসময়ে যথা উপায়ে পরীক্ষা না করার কারণে অনেক ক্ষেত্রে ডায়াবেটিস ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকে। এতে ডায়াবেটিসে আক্রান্তদের অনেকেই জানতে পারছে না যে তারা ডায়াবেটিস রোগী।

উপজেলা জেলা পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে ডায়াবেটিস উচ্চরক্তচাপের বিষয়ে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ রয়েছে। বিষয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সরকারকে এক্ষেত্রে গুরুত্ব দিলেও মাঠ পর্যায়ে পদক্ষেপগুলো সফল কার্যকরভাবে বাস্তবায়িত হয়নি। এছাড়া বিশেষজ্ঞ প্রশিক্ষিত লোকের অভাবের কারণে স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলোতেও মানুষ সেভাবে সেবা পাচ্ছে না। সরকারের উদ্যোগ ব্যবস্থাগুলো ঠিক থাকলেও যথাযথভাবে বাস্তবায়ন ঠিক নেই। হাসপাতাল তৈরি, বেড তৈরির চেয়ে সরকারকে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় বেশি মনোযোগ দিতে হবে।

ডায়াবেটিস প্রতিরোধে স্বাস্থ্যশিক্ষার বিষয়ে আপনার পরামর্শ কী?

আমরা কভিড থেকে একটা শিক্ষা লাভ করেছি। জনগণকে রোগের জ্ঞানের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। শরীর যার তাকে ডায়াবেটিসের মতো রোগে কী করতে হবে সেটা বোঝাতে হবে। জীবনাচার, খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রমের মতো সমন্বিত ব্যাপারগুলোয় সবাইকে সম্মিলিতভাবে জোর দিতে হবে। হাজার হাজার কোটি টাকা খরচ করে হাসপাতাল তৈরি করে ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করার সাধ্য কারো নেই। এটি করতে না পারলে আমাদের উন্নয়ন ফিকে হয়ে যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন