অভিমত

জোগান ব্যবস্থার ব্যর্থতার ফল মূল্যস্ফীতি: তুলনামূলক বিশ্লেষণ

রকিবুল হক

মূল্যস্ফীতি সবসময়ই জোগান ব্যবস্থার ব্যর্থতার ফল। এক্ষেত্রে মিল্টন ফ্রিডম্যানের বক্তব্য ছিলমূল্যস্ফীতি সবসময় সবখানেই অতিরিক্ত অর্থের জোগানের ফল।অতিরিক্ত অর্থের জোগান অতিরিক্ত চাহিদা তৈরি করে যা মূল্যস্ফীতি ঘটায়, কিন্তু বাস্তবতা হলো অতিরিক্ত চাহিদা মানে মূল্যস্ফীতি নয়, বরং উল্টো অতিরিক্ত চাহিদা মানে অর্থনীতি এখনো তার উৎপাদন সক্ষমতার যথেষ্ট ব্যবহার করতে পারেনি। অন্যদিকে ঐতিহাসিকভাবেই এটা দেখা যায়, সব বড় ইনফ্লেশনারি ঘটনার শুরু মূলত সরবরাহ ব্যবস্থার ব্যর্থতার কারণে সেটা ১৯৭০-এর গ্রেট ইনফ্লেশনই হোক অথবা চলমান বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি।

MV=PY, মূলত সমীকরণের ওপর ভর করেই দাঁড়িয়ে আছে মানিটারিস্টদের তত্ত্ব, গাণিতিকভাবে সমীকরণ ঠিক আছে। সমীকরণে যেকোনো সময়ে অর্থের সরবরাহ বাড়লে পণ্যের দাম বাড়বে সেটা সমস্যা নয়, সমস্যা হলো এর অনুসিদ্ধান্তগুলোয়। প্রথমত, অর্থ সরবরাহ কেবল কেন্দ্রীয় ব্যাংকই করতে পারে; এটা সর্বাংশে সত্য নয়। কারণ আমরা জানি, অর্থ সরবরাহ এখন আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একার কাজ নয়, সিডিউলড যেকোনো ব্যাংকই যখন ঋণ দেয় তখনমানি সারকুলেটহয়। এটা ফাইন্যান্সিয়াল ক্যাপিটালিজমের একটা দুর্দান্ত আবিষ্কার বলা যায়। দ্বিতীয়ত, অর্থ সরবারহ কখনো জোর করে বাড়ানো যায় না, ফ্রিডম্যান তার তত্ত্বেহেলিকপ্টার মানিধারণার উদাহরণ দিয়েছিলেন। উদাহরণের মতো কাজ হলে হয়তো সম্ভব। কিন্তু বাস্তবতা হলো অর্থনীতিতে টাকার চাহিদা থাকলেই কেবল টাকা সরবরাহ বাড়ানো সম্ভব। মডার্ন মানিটারি থিওরিস্ট এবং টেক্সাস ইউনিভার্সিটির ইকোনমিক্স ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক টিএইচ হার্ভে একটা দারুণ উদাহরণ দেন—‘অর্থের সরবরাহ বাড়ানো হলো চুল কাটানোর সেবা দেয়ার মতো, কাউকে চাইলেই যেমন জোর করে চুল কেটে দেয়া যায় না, তেমনি চাইলেই কাউকে ঋণ দেয়াও যায় না।দ্বিতীয়ত, ভেলোসিটি অব মানিকে স্থির ধরে নিয়েই মানিটারিস্টরা এগোয়, কিন্তু টেকনোলজির অভূতপূর্ব উত্থানের কারণে ভেলোসিটি আর স্থির নয়। যেহেতু পুঁজিবাদ মূলত টিকে থাকে ভোগ ব্যয়ের ওপর, কাজেই ভেলোসিটি অব মানি স্থির এটা ধরে নেয়া যাচ্ছে না। অর্থনীতি যখন সচল থাকে তখন ভেলোসিটি বেশি থাকে আবার মন্দায় কম থাকে যুক্তিই ওই অনুসিদ্ধান্তকে দুর্বল করে দেয়। তৃতীয়ত, দাম; মানিটারিস্টরা মনে করেন বাজার এতটাই প্রতিযোগিতাপূর্ণ যে চাইলেই যে কেউ দাম বাড়াতে পারবেন না। এটা এতটাই সরল হাইপোথিসিস যে অর্থনীতি বিষয়ে কোনো গভীর ধারণা তো দূরের কথা প্রতিদিন বাজার করতে গেলেই হয়তো আপনি টের পাবেন যে দাম, এমনকি পাড়ার দোকানিও বাড়াতে পারেন, যদি ক্ষমতার সঙ্গে তার ন্যূনতমও যোগাযোগ থাকে। ক্রনি ক্যাপিটালিজমে সরকার যেহেতু নিজেই ব্যবসায়ী তাই দাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে তারও একচেটিয়া ক্ষমতা আছে, যেমন তেল, পানি বা বিদ্যুৎ এমনকিমানি’; ফলত অনুসিদ্ধান্তও অতি দুর্বল। সর্বশেষ, Y; বা একটা নির্দিষ্ট সময়ে অর্থনীতির মোট উৎপাদন ক্ষমতা, মানিটারিস্টরা ধরে নিচ্ছে যে এটা সবসময় সর্বোচ্চ ব্যবহারের কাছাকাছি থাকে কিন্তু তা অধিকাংশ সময়ই ঠিক নয়।

কেন আমি বললাম মূল্যস্ফীতি মূলত একটা সাপ্লাই শক্ বা সাপ্লাই সাইড অর্থনৈতিক সমস্যা সেটার ব্যাখ্যায় আসি। এখনকার চলমান বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির প্রধান কারণ তিনটি। প্রথমত, করোনা মহামারী। সময়ে দুনিয়াজুড়ে পণ্য চলাচল স্থবির হয়ে যায়। ফলে পণ্য সরবরাহ ভয়াবহ আকারে কমে যায়। কাজেই দামও বেড়ে যায় এবং শুরু হয় মূল্যস্ফীতি। দ্বিতীয়ত, ইউরোপের চলমান যুদ্ধ এবং এর কারণে রাশিয়ার ওপর পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞা যা খাদ্যশস্যের সরবরাহ এবং জ্বালানি সরবরাহের ব্যাপক বাধা সৃষ্টি করছে। একই সঙ্গে ওপেক ১৯৭০-এর অয়েল শকের মতো এবারও তার তেলের উৎপাদন কমানের ঘোষণা দিয়েছে, নিজের ক্ষতি কমানোর জন্য এবং তৃতীয়ত, আমেরিকার চীনের ওপর টেকনোলজিক্যাল নিষেধাজ্ঞা বিশেষত সেমিকন্ডাক্টর-চিপের ওপর। ফল হচ্ছে ইলেকট্রনিকস পণ্যের উৎপাদন এবং সরবরাহ বাধাগ্রস্ত হওয়া। এমনকি এবারের মার্কিন মূল্যস্ফীতির শুরুও হয় মূলত তাদের পুরনো গাড়ির বাজারের মূল্যস্ফীতি থেকে, যার কারণ ছিল সেমিকন্ডাক্টর চিপের অভাবে নতুন গাড়ি নির্মাণ বাধাগ্রস্ত হওয়া।

মানুষ সবসময়ই তার বর্তমান সমস্যার সমাধান খুঁজে অতীতে। আগের একই ঘটনায় কী করেছিলেন আমাদের পূর্বপুরুষরা তা হয়তো আমাদের পথ দেখায়, কিন্তু তা যে সবসময় সঠিক হবে তা নয়। যেমন গত শতাব্দীর ১৯৭০-১৯৮৩ পর্যন্ত চলা অর্থনৈতিক মন্দা এবং ইনফ্লেশনারি চাপ যা গ্রেট ইনফ্লেশন নামে পরিচিত। সে সময় পল ভলকার ফেডের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে যে মানিটারি পদক্ষেপগুলো নিয়েছিলেন তা এখন আবারো আলোচিত হচ্ছে। যদিও ওই গ্রেট ইনফ্লেশনও একই কারণে ঘটনা ঘটে, আঘাতটা আসে মূলত সরবরাহ ব্যবস্থা বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে। যার শুরু আবার মূলত দুটি কারণে: প্রথমত, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে চলতে থাকা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক চাঙ্গা ভাবের পতন। পতনের শুরু হিসেবে বলা হয়ে থাকে মার্কিনিদের ভিয়েতনাম যুদ্ধসহ একাধিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়া। ওই যুদ্ধগুলো বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ায়। কারণ তখন বেটন উডস ব্যবস্থার কারণে সব দেশকে তাদের কারেন্সিকে ডলারের বিপরীতেপেগডকরে রাখতে বাধ্য করা হয়। আর ডলারপেগডথাকত গোল্ডের বিপরীতে। ফলে সব ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে ডলারের ওপর নির্ভর করে থাকতে হতো।  যার অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল ব্রেটন উডসের ভেঙে পড়া। ১৯৭১- এসে মার্কিনিরা তাদের একক সিদ্ধান্তে নিজেরাই ব্রেটন উডস থেকে বের হয়ে আসে এবং ডলারের বিপরীতে গোল্ড দেয়ার ব্যবস্থা বাতিল করে জিমি কার্টার প্রশাসন। ডেভিড হেমস, হাওয়াই হাইলো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এবং ডগলাস উইলস, ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের সহযোগী অধ্যাপক, তাদের ব্ল্যাক গোল্ড; দি ইন্ড অব ব্রেটন উডস অ্যান্ড দি অয়েল প্রাইস শকস অব দ্য ১৯৭০ নিবন্ধে বলছেন, ‘১৯৭১-এর দিকে ৭০ বিলিয়ন ডলারের বিপরীতে আমেরিকার কাছে ছিল মাত্র ১২ বিলিয়ন সমমূল্যের গোল্ড, তাই ডলারের বিপরীতে গোল্ড দেয়া থামাতে আমেরিকা একক সিদ্ধান্তে এমনকি আইএমএফের সঙ্গেও কোনো আলোচনা ছাড়াই আগস্ট ১৫, ১৯৭১ গোল্ড উইন্ডো বন্ধ করে দেয়।

মার্কিন মুল্লুকে ইনফ্লেশনারি চাপও তখন চলমান। তবে ওপেকের অয়েল শক বা এনার্জি ক্রাসইসিসের আগ পর্যন্ত তা নিয়ন্ত্রণযোগ্য ছিল। সত্তরের দশকে আরব-ইসরাইল সংকট এবং বিশ্ববাজারে গোল্ডের বিপরীতে তেলের দাম কমে যাওয়ায় ওপেকও তার তেলের উৎপাদন হ্রাস করে দাম ধরে রাখার জন্য। এর অবশ্যম্ভাবী পরিণতি ছিল তেলের দামের ভয়ানক উল্লম্ফন, যা প্রায় সব পণ্যের দাম ভয়াবহ আকারে বাড়িয়ে দেয়। ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব সেন্ট লুই, রিচমন্ড এবং ফেডারেল রিজার্ভ হিস্টরির অনেক রিসার্চ আটিকেল পাবলিশ হয়েছে মূল্যস্ফীতির কারণ নিয়ে, যার অসংখ্য নিবন্ধে এটা স্বীকার করে নেয়া হয় যে তেলের জোগান বাধাগ্রস্ত হওয়াই ছিল মূল্যস্ফীতির মূল কারণ। ডেভিড হার্ভে তার ব্রিফ হিন্ট্রি অব নিও লিবারেলিজমবইতে পরিস্থিতির ভয়াবহতা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বলছেন, ‘এমনকি আমেরিকা সৌদি আরবে আক্রমণের কথা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেছিল।’  রকম পরিস্থিতিতেই ১৯৭৯ সালে ফেডের দায়িত্ব নেন পল ভলকার, তখন আমেরিকায় মূল্যস্ফীতি দুই অংকের ঘরে। দায়িত্ব নিয়েই তিনি মানিটারি পলিসিকেই প্রধান হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে থাকেন। সুদহার বাড়িয়ে মানি সাপ্লাই কমানোর মাধ্যমে মূল্যস্ফীতিকে নিয়ন্ত্রণে আনা ছিল তার মূল লক্ষ্য, তাতে যা ক্ষতি হয় হবে। কন্ট্রাকশনারি মানিটারি পলিসির কারণে পরের কয়েক বছরে, অর্থাৎ আশির দশকের শুরুর দিক থেকে মূল্যস্ফীতি কমা শুরু করে, কিন্তু প্রচুর বেকারত্ব মন্দার বিনিময়ে।

বিগত কয়েক দশক ধরে বিশেষ করে করোনার সময় কেন বিভিন্ন দেশের সরকার মানি সাপ্লাই বাড়াচ্ছিল? এর একটা কারণ হচ্ছে নাগরিকদের ক্রয়ক্ষমতা একেবারে হ্রাস পেয়ে অর্থনীতি যেন মন্দাক্রান্ত না হয়ে পড়ে। যদিও প্রথাগত অর্থনীতিবিদরা সবসময়ই বলেন অর্থের সরবরাহ বাড়লে মূল্যস্ফীতি বাড়বে কিন্তু তারা কেউ এটা প্রমাণ করতে পারেনি মূল্যস্ফীতি কেবল অর্থ সরবরাহের কারণে ঘটে। তবে কথা ঠিক, সাপ্লাই শক যখন চরম নেগেটিভ হয় তখন মানি সাপ্লাই বাড়তে থাকলে তা মূল্যস্ফীতি বাড়াবে। কিন্তু তার মানে এই নয় অর্থের জোগান না বাড়লে পণ্যের দাম কম থাকত, কারণ সরবরাহের ঘাটতিজনিত দাম বৃদ্ধি চাহিদার ওপর নির্ভরশীল নয়। এখন বিকল্প কী হতে পারত, মানুষের কাছে টাকা পৌঁছানো না হলে স্রেফ তাদের অর্থাভাবে ভোগ ব্যয় কমাতে হতো, অন্যদিকে সরবরাহ স্বাভাবিক না হলে আপনি যতই টাকা দেন পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে আসবে না। আবার যখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সুদের হার বাড়ায় তখন ঋণের সুদের হার বাড়বে, যা কস্ট অব মানি বাড়াবে, ফলে উৎপাদন খরচ বাড়বে, পণ্যের দাম বাড়বে, তার মানে ইনফ্লেশন এক্সপেক্টেশন এবং ইনফ্লেশন দুটিই বাড়বে। মানে দাঁড়াল সুদের হার বৃদ্ধি ইনফ্লেশনকে কমাতে নয় বরং বাড়াতে সহায়তা করে। আর যদি এভাবেমানিক্রমাগত অনেক ব্যয়বহুল হয়ে ওঠে তাহলে অর্থনীতিতে মন্দা তৈরি হবে, তখন অবশ্য ইনফ্লেশন কমতে বাধ্য কারণ কারো কাজ থাকবে না তাই কিছু কেনার প্রশ্নই ওঠে না। পরিস্থতি নিয়ে বার্ড কলেজের অর্থনীতির অধ্যাপক এল র্যান্ডাল রে খুব বিস্ময় নিয়ে বলেন, “সকল পণ্যের দাম বাড়লে যদি মূল্যস্ফীতি বাড়ে তাহলেমানিরদাম বাড়লে কেন মূল্যস্ফীতি কমবে!” মূল্যস্ফীতির দায় পুরোটা মুদ্রানীতির ওপর চাপানোর একটা বড় গলদ হল এতে এটা ধরে নেয়া হয় যে বিদ্যমান ব্যবস্থা ঠিকই আছে, শুধু কোনো এক কারণে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থাটা কাজ করছে না, যা ঠিকঠাক করে নিলেই হবে। তবে বাংলাদেশের মতো ক্রনি পুঁজিবাদী রাষ্ট্রগুলোর চলমান মূল্যস্ফীতিকে স্রেফ তাত্ত্বিকভাবে ভুল আকারে দেখার কোনো সুযোগ নেই, কোনো তত্ত্ব দিয়ে এটা ব্যাখ্যা করাও অসম্ভব। এসব দেশে সব ধরনের প্রতিষ্ঠানকে ভেঙে অনিয়মকেই নিয়মে রূপান্তর করা হয়েছে ফলে  তথ্যের অপ্রতুলতা, দুর্নীতি বৈষম্য এখানে সব তত্ত্বকেই হাস্যকর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। শেষ কথা, চলমান বৈশ্বিকস্ট্যাগফ্ল্যাশন’, মন্দা এবংডেটক্রাইসিসকে মোকাবেলা করতে হলে রাজস্ব মুদ্রানীতির সমন্বয়েই নতুন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে।

 

রকিবুল হক: ব্যাংকার রাজনৈতিক অর্থনীতি বিশ্লেষক

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন