ফেলে রাখা কূপে ছয় বছর পর মিলল গ্যাস

পরিত্যক্ত গ্যাসকূপগুলোয় অনুসন্ধান জোরদার করুক বাপেক্স

সিলেটের বিয়ানীবাজারে পরিত্যক্ত একটি গ্যাসকূপ পুনর্খনন করে গ্যাসের সন্ধান পেয়েছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম অ্যান্ড এক্সপ্লোরেশন কোম্পানি (বাপেক্স) কূপটি উৎপাদনে গেলে জাতীয় গ্রিডে ১৫-১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস যুক্ত হবে বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন। সংকটের সময়ে পরিত্যক্ত কূপ থেকে গ্যাসের সন্ধান নিঃসন্দেহে আশাব্যঞ্জক একটি খবর। এর সঙ্গে দেশের পরিত্যক্ত অন্যান্য কূপ থেকে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনাও বেড়েছে। সঠিকভাবে অনুসন্ধান চালালে স্থলভাগে নতুন গ্যাসকূপ পাওয়ার আশাও বেড়েছে এতে। প্রত্যাশা থাকবে, পেট্রোবাংলা বাপেক্স এক্ষেত্রে যথাযথ পদক্ষেপ নেবে।

বাংলাদেশে যেসব স্থানে গ্যাস পাওয়া গিয়েছে, তা গড়ে পাঁচ হাজার মিটার গভীরতায়। বিজিএফসিএলের পাঁচটি গ্যাসক্ষেত্রেও স্তর থেকে গ্যাস মিলেছে। স্তরের আরো নিচে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এজন্য প্রয়োজন ডিপ ড্রিলিং বা মাটির আরো গভীরে খনন। বাংলাদেশের সরকারি সংস্থা বাপেক্সসহ বিদেশী যেসব কোম্পানি রয়েছে, তাদের রিগগুলো গড়ে পাঁচ হাজার মিটার খনন করার ক্ষমতা রয়েছে। সাত হাজার মিটারের বেশি গভীরতায় খনন করতে হলে নতুন রিগ কিনতে হবে বাপেক্সের জন্য। এছাড়া রিগ ভাড়া করে ঠিকাদার দিয়েও বেশি গভীরতায় খনন করা গেলে গ্যাসের নতুন মজুদের সন্ধান মিলবে বলেই অনুমান। দেশে একমাত্র ভোলায় দুটি গ্যাসক্ষেত্র ছাড়া আবিষ্কৃত সব ক্ষেত্রের ভূ-কাঠামোগত বৈশিষ্ট্য হলো অ্যান্টি ক্লেইন স্ট্রাকচার। ভোলায় আবিষ্কৃত দুটি ক্ষেত্র নতুন বৈশিষ্ট্যের স্ট্র্যাটিগ্রাফিক ভূ-কাঠামোর। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, ভোলা, বরিশাল হয়ে খুলনা এমনকি রাজশাহী পর্যন্ত স্ট্র্যাটিগ্রাফিক স্ট্রাকচারে গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। পাবনার মোবারকপুর স্ট্র্যাটিগ্রাফিক স্ট্রাকচারে দেশের ২৭তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে। ভোলা পাবনার মোবারকপুর হলো বেঙ্গল বেসিনভুক্ত এলাকা। এসব এলাকার বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো দেশের প্রধান নদনদীগুলোর অববাহিকায় মিলছে গ্যাস। অথচ এসব স্থানে অনুসন্ধান উত্তোলন কূপ খননের দৃশ্যমান কোনো কর্মসূচি নেই সরকারের। ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ওএনজিসিও একই ধরনের ভূ-কাঠামোয় গ্যাস তেল পেয়েছে। এটি মোবারকপুর থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের স্ট্র্যাটিগ্রাফিক স্ট্রাকচারে ইছাপুরে। ভূ-কাঠামো গোটা উত্তরবঙ্গে রয়েছে। সেখানেও গ্যাসপ্রাপ্তির সম্ভাবনা রয়েছে। এসব সম্ভাবনার পরস্ফুিটন প্রয়োজন। তবে দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়াতে যে পরিমাণ কূপ নতুন নতুন এলাকায় খনন করা দরকার, পেট্রোবাংলা তা করছে না। দেশের একমাত্র রাষ্ট্রীয় তেল গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলনকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড বা বাপেক্স। অনেক সময় প্রতিষ্ঠানটি বেশির ভাগ ক্ষেত্র আবিষ্কার করেও উত্তোলন ব্যবস্থাপনার সুযোগ পায় না। এক অজানা কারণে বাপেক্সের আবিষ্কৃত ক্ষেত্রগুলোয় কূপ খনন, উত্তোলন ব্যবস্থাপনার কাজ দেয়া হয় বিদেশী প্রতিষ্ঠানগুলোকে। প্রশ্ন আছে বাপেক্সের সক্ষমতারও। এদিকে দৃষ্টি দিতে হবে।

এরই মধ্যে যে উন্নয়ন কূপগুলো পরিত্যক্ত বা শেষ হয়ে গিয়েছে সেগুলো থেকে আরো কিছু গ্যাস উত্তোলনের সুযোগ রয়েছে। এমন প্রায় ৪০-৫০টি কূপ রয়েছে। গ্যাসের দ্রুত সরবরাহ বাড়াতে এগুলোয় ওয়ার্কওভার বা সংস্কার খনন করা হলে অনেকখানি গ্যাস পাওয়া যাবে। এগুলোর পাশাপাশি স্থল এবং সমুদ্রে গ্যাস অনুসন্ধান জোরদার করতে হবে। কিন্তু সেদিকে সরকার প্রকৃতপক্ষে জোর দিচ্ছে না। দেশের যে ভূ-গঠন তাতে স্থলভাগে এখনো গ্যাস পাওয়ার বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে, কিন্তু সিলেট-কুমিল্লা-চট্টগ্রাম অঞ্চলের বাইরে তেমন বড় কাজ এখনো হয়নি। গত ২০ বছরে মাত্র ২৫টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে। ফরিদপুর-যশোর অঞ্চল এবং নোয়াখালী অঞ্চলে গ্যাস পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে, যা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন। ইতিবাচক বিষয় হলো, অনেক ওয়ার্কওভার কূপ খনন করার কাজ শুরু করেছে বাপেক্স। গতকাল সালদা গ্যাসক্ষেত্রে একটি পরিত্যক্ত কূপে থাকা অবশিষ্ট গ্যাস উত্তোলন শুরু হয়েছে। এটি থেকে প্রতিদিন পাঁচ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে। কৈলাসটিলার একটি কূপেও অবশিষ্ট গ্যাস পাওয়া গিয়েছে। এটি থেকে দৈনিক ১০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে বলে খবর মিলছে।

বাংলাদেশ ভূখণ্ডে স্বাধীনতার পর মাত্র ৬৮টি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হয়েছে, ত্রিপুরা তার স্বল্প আয়তনে কূপ খনন করেছে ১৬০টি। ত্রিপুরা ১৬০টি কূপ খনন করে মাত্র ১১টি গ্যাসফিল্ড আবিষ্কার করেছে। বাংলাদেশে গত ১১০ বছরে মাত্র ৯৫টি কূপ খননের মাধ্যমে ২৮টি গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। বাংলাদেশের সফলতার হার উচ্চ হলেও এখন তিমিরেই রয়ে গিয়েছে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান। ১৯৯৫ সালের জ্বালানি নীতিমালায় বছরে চারটি অনুসন্ধান কূপ খননের কথা বলা হলেও কোনো সরকারই তা মেনে চলেনি। বিশাল সমুদ্রসীমা অর্জন করলেও সেখানে কোনো কাজ করা যায়নি। সাগরে পিএসসি (উৎপাদন বণ্টন চুক্তি) আহ্বান করা হলে আগ্রহ দেখাচ্ছে না বিদেশী কোম্পানিগুলো। স্থলভাগের পাশাপাশি সমুদ্রেও অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদার করা প্রয়োজন।

জাতিসংঘ ঘোষিত ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনে যে ১৭টি লক্ষ্যমাত্রা, তার অন্যতম সবার জন্য টেকসই জ্বালানি নিশ্চিত করা। এসডিজির অন্যতম শর্ত সবার জন্য জ্বালানি নিরাপত্তা সহজলভ্য করে তোলা। এক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে নেই বাংলাদেশ। জ্বালানি নিরাপত্তার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ চারটি উপাদানজ্বালানি সহজলভ্যতা, জ্বালানির সমর্থতা, জ্বালানির উপযোগিতা জ্বালানির নিরাপত্তামূলক কার্যক্রম। বাংলাদেশ এর কোনোটিই সন্তোষজনকভাবে এগিয়ে নিতে পারেনি। জার্মানির মতো উন্নত দেশ ২০৫০ সালের মধ্যে নবায়নযোগ্য জ্বালানি দিয়ে নিজেদের সম্পূর্ণ চাহিদা মেটানোর ঘোষণা দিয়েছে। এখন ইউরোপ থেকে শুরু করে চীন পর্যন্ত বেশির ভাগ উন্নত দেশই প্রাকৃতিক শক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে ঝুঁকছে। আমাদের জ্বালানি ব্যবস্থাপনাও ঢেলে সাজাতে হবে। বর্তমানে জ্বালানি সংকটের কারণে শিল্পের উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। অন্যথায় আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বেন বাংলাদেশের উদ্যোক্তারা। করোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে শিল্প মালিকরা হিমশিম খাচ্ছেন। উপরন্তু গ্যাসের সংকটে উৎপাদনে প্রভাব পড়লে অনেকের জন্য টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে।

আন্তর্জাতিক জ্বালানির বাজার সবসময়ই দোদুল্যমান। ফলে কোনো পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় বিষয়টি বিবেচনায় রেখে একক জ্বালানিনির্ভরতা এড়িয়ে চলা প্রয়োজন। বাংলাদেশে জল স্থলভাগে আরো গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এটিকে কাজে লাগাতে হবে। জ্বালানি ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা নিশ্চিত করতে হলে গ্যাস অনুসন্ধান উত্তোলনের কাজ বেগবান করতে হবে। বাস্তবতা হলো, দেশে গ্যাস অনুসন্ধান এখনো পরিপক্ব হয়নি, বরং প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। দেশের ভূখণ্ডের অনেক অংশই এখনো অনুসন্ধানের আওতায় আনা হয়নি; বিশাল সমুদ্র এলাকায় অনুসন্ধান ন্যূনতম পর্যায়ে রয়ে গিয়েছে। জলসীমার আইনগত মীমাংসার পর থেকে মিয়ানমার ভারত বঙ্গোপসাগরে ব্যাপকভাবে অনুসন্ধান কার্যক্রম হাতে নিয়েছে। অথচ অনেকটা সময় পেরোলেও আমাদের দেশে এটি করা হয়নি। এটি জরুরি ভিত্তিতে করতে হবে। এজন্য বিনিয়োগ জাতীয় সক্ষমতা উভয়ই বাড়াতে হবে। দেশের সব গ্যাস ফুরিয়ে যাচ্ছে, ধারণা থেকে জ্বালানি আমদানির ওপর সর্বতোভাবে ঝুঁকে পড়া সমীচীন নয়। জ্বালানিনির্ভরতা কমাতে গ্যাসসহ নিজেদের প্রাকৃতিক সম্পদ অনুসন্ধান আহরণকে বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। নবায়নযোগ্য জ্বালানির উৎপাদন ব্যবহার বাড়াতেও কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন