কপ-২৭ শুরুর আগে আশঙ্কা

বৈশ্বিক উষ্ণতা বাড়লে বিলুপ্ত হবে পৃথিবীর সব পুরাকীর্তি!

বণিক বার্তা অনলাইন

মানুষের খামখেয়ালিপনা আর বেহিসেবি কর্মকাণ্ডে ক্রমশ পৃথিবী নামক গ্রহটির উষ্ণতা বাড়ছে। খরা, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা, ঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সাইক্লোন আঘাত হানার পারিমাণও বাড়ছে। এরই সঙ্গে আরো একটি আশঙ্কা যোগ হয়েছে, আগামী একশ বছরের মধ্যে পৃথিবী থেকে হারিয়ে যেতে পারে সব পুরাকীর্তি বা প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা।

জলবায়ুর নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কিত আলোচনায় ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার অঙ্গীকারগুলো এখনো ততটা গুরুত্ব পায়নি; যার প্রভাব পড়বে মানুষের ইতিহাস-ঐতিহ্যে।

আগামীকাল রোববার শুরু হচ্ছে জাতিসংঘের জলবায়ুবিষয়ক ২৭তম বৈশ্বিক সম্মেলন বা কপ-২৭। আয়োজনটি বসছে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিসমৃদ্ধ অন্যতম ভূমি মিসরে। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় প্রচেষ্টার অংশ হিসেবে শীর্ষস্থানীয় নেতাদের পাশাপাশি কয়েক হাজার কর্মকর্তা, গবেষক ও আন্দোলনকর্মী অংশ নিচ্ছেন অবকাশযাপন ও উত্সব আয়োজনের কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত শারম আল শেখে।

সব মিলিয়ে কপ-২৭ খুবই বিশেষ আয়োজন। তাই জলবায়ু ইস্যুতে আন্দোলনকর্মী তথা বিশ্ববাসীর ব্যাপক প্রত্যাশা রয়েছে।

জাতিসংঘের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে সতর্ক করে বলা হয়েছে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করতে বৈশ্বিক প্রচেষ্টা এখনো ‘দুর্ভাগ্যজনকভাবে অপর্যাপ্ত’। অভিযোগের তীর বিশ্বের ধনী রাষ্ট্র ও বিশ্বনেতাদের দিকে। যারা সমর্থ থাকার পরও বৈশ্বিক পরিস্থিতি সামলাতে উদ্যোগী নন।

পরিবেশবাদীরা অনেক আগে থেকেই সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, বিশ্ব এখন চরম ‘বিপর্যয়ের মুখে’। তাই কপ-২৭ সম্মেলন ঘিরে আয়োজক দেশ মিসরও কঠিন লক্ষ্য স্থির করেছে। গত বছর যুক্তরাজ্যের স্কটল্যান্ডের গ্লাসগো শহরে কপ সম্মেলনে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস, জলবায়ু কর্মসূচিতে অর্থায়ন, বন সুরক্ষাসহ অন্যান্য কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গীকার করা হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয়নি। মিসর বলছে, সে সব অঙ্গীকার বাস্তবায়নকে কেন্দ্র করে এবারের সম্মেলন হবে।

পিরামিড, স্ফিংস আর তুতেনখামেনের সমাধিসহ পুরাকীর্তিবহুল দেশ মিসর। এসব পুরাকীর্তিগুলো বৈরি আবহাওয়া, উত্তপ্ত তাপমাত্রা আর সমুদ্রের ক্রমবর্ধমান হুমকির সম্মুখীন বলে মনে করছেন দেশটির নীতি নির্ধারকদের অনেকে।

মিশরের প্রত্নতাত্ত্বিক বিষয়ক সাবেক প্রতিমন্ত্রী জাহি হাওয়াস সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, কার্যত মিসরের সমস্ত উন্মুক্ত প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান গুরুতর ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। আমার দৃষ্টিতে ১০০ বছরের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সমস্ত পুরাকীর্তি ধ্বংস হয়ে যাবে। 

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব আমলে নিয়ে ঐতিহ্যরক্ষার জন্য কাজ করা উচিত বলে মনে করেন রবার্ট জেনস। লেস্টারের স্কুল অব মিউজিয়াম স্টাডিজের এ গবেষক অভিযোগ, বিশ্বব্যাপী যাদুঘরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীগুলো কেন তাদের সম্মিলিত ইচ্ছা ও বুদ্ধিমত্তা দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলা করছে না? জলবায়ু পরিবর্তন যেন একটি নিষিদ্ধ বিষয় যা নিয়ে পরিবার, বন্ধু কিংবা সহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলা উচিত নয়।

ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডনের হেরিটেজ স্টাডিজের অধ্যাপক রডনি হ্যারিসন মনে করেন, বৈশ্বিক তাপমাত্রা আরো ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস নিচে রাখার বিষয়টিকে নিশ্চিত করার জন্য সমাজ জুড়ে আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। যাদুঘরগুলো এ রূপান্তরে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে।

ইউনেস্কোর সংস্কৃতি বিষয়ক সহকারী মহাপরিচালক এবং চিলির সাবেক সংস্কৃতি মন্ত্রী আর্নেস্তো অটোন রামিরেজ দ্য আর্ট নিউজপেপারকে জানান, সব মন্ত্রীরাই একমত হয়েছেন যে টেকসই উন্নয়ন ও পরিবেশগত সমস্যার অংশ হিসেবে সংস্কৃতিকে কাজে লাগাতে হবে।

২০২২ সালের আগস্টে প্রাগে ইন্টারন্যাশনাল কাউন্সিল অব মিউজিয়ামের বার্ষিক সভায় যাদুঘরকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করার বিষয়ে সবাই সম্মত হয়েছিলেন। কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবের বিপরীতে প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনাকে রক্ষা করতে কী ধরনের কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া যায় সে সব বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ-আলোচনা চলছে।

তাই মনে করা হচ্ছে কপ-২৭ সম্মেলনে বিশ্বনেতাদের বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে। শীর্ষ দুই দূষণকারী যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মতো বড় দেশের ভূমিকা এ সম্মেলনে গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্পর্কে গত সপ্তাহে জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বলেন, উন্নয়নশীল দেশগুলোর ক্ষোভকে অবমূল্যায়ন করবেন না। তারা মনে করে, উচ্চ আয়ের দেশগুলো ২০১৫ সালে ফ্রান্সের প্যারিস সম্মেলনে সম্পাদিত যুগান্তকারী জলবায়ু চুক্তিটি বাস্তবায়নে আগ্রহী নয়।

২০০৯ সালে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতি প্রশমনে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নত বিশ্ব বছরে ১০ হাজার কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দেবে। ২০২০ সালে ওই প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের কথা ছিল। কিন্তু প্রায় তিন বছর পর এখন পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। তাই মনে করা হচ্ছে, উন্নত দেশের সেই সহায়তার প্রতিশ্রুতি এবারের কপ সম্মেলনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হবে।

আয়োজক মিসর অবশ্য সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ক্ষয়ক্ষতি বৃদ্ধি পেলে সম্মেলনকে ঘিরে ‘আস্থার সংকট’ তৈরি হবে। অবশ্য সেই চিত্র আগেই দেখা যাচ্ছে। হতাশ হয়ে এবারের সম্মেলনে যাচ্ছেন না সুইডেনের তরুণ জলবায়ু আন্দোলনকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ।

দ্য আর্ট নিউজপেপার, ইউনেস্কোর অফিশিয়াল ওয়েব সাইট অবলম্বনে

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন