বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিয়ে ব্যবসায়ীরা শঙ্কিত

রিজার্ভ নিয়ে শঙ্কা, দিনে বিদ্যুৎ কম ব্যবহারের পরামর্শ জ্বালানি উপদেষ্টার

নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের বিদ্যমান জ্বালানি সংকটের সমাধান চেয়ে গত দুদিনে দুটি সেমিনার করেছেন শিল্প মালিকরা। সেমিনারে মূলত ব্যবসায়ীরা দেশের শিল্প-কারখানা সচল রাখতে গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর দাবি তুলেছেন। এমনকি বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম বিবেচনায় তারা বাড়তি অর্থ দিতেও রাজি। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বিষয়ে তেমন কোনো সাড়া মিলছে না। প্রধানমন্ত্রীর বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ-বিষয়ক উপদেষ্টা তৌফিক--ইলাহী চৌধুরী অবশ্য দিনের বেলায় বিদ্যুৎ ব্যবহারে সবাইকে কৃচ্ছ্রসাধনের আহ্বান জানান।

ব্যবসায়ীরা বলছেন, গ্যাস সংকট প্রকট আকার ধারণ করায় দেশের শিল্প-কারখানাগুলো উৎপাদন সংকটে ভুগছে। বিশেষ করে গ্যাসের চাপ কমে যাওয়ায় দিনে-রাতে ১২ ঘণ্টার বেশি কারখানা চালু রাখতে পারেন না কারখানা মালিকরা। এতে উৎপাদন ৬০ শতাংশেরও নিচে নেমে এসেছে। অন্যদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রেও গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় ব্যাপক হারে বেড়েছে লোডশেডিং। এতে নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্প মালিকরা। তাই শিল্প-কারখানা বাঁচাতে সরকারকে অতিরিক্ত আরো অন্তত ৩৫০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।

এদিকে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমে গিয়েছে। ফলে চাহিদামতো গ্যাস জ্বালানি তেল আমদানি করা যাচ্ছে না। বন্ধ রাখতে হচ্ছে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এমন পরিস্থিতিতে দিনের বেলায় কম বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরামর্শ দিয়ে জ্বালানি উপদেষ্টা তৌফিক--ইলাহী চৌধুরী বলেন, ইন্ডাস্ট্রিতে বিদ্যুৎ বেশি দেয়ার জন্য প্রয়োজনে বিদ্যুৎ ব্যবহার কম করব। দরকার হলে দিনের বেলা ব্যবহারই করব না। বিদ্যুৎ যদি আমরা শিল্পে দিই, তাহলে আবাসিকে সাপ্লাই কমাতে হবে।

রাজধানীর অভিজাত একটি হোটেলে গতকাল শিল্পে জ্বালানি সংকট সমাধান শীর্ষক আলোচনা সভায় তৌফিক--ইলাহী চৌধুরী বলেন, আমাদের রিজার্ভের যে অবস্থা, তাতে তো রিস্ক নিতে পারি না। প্রতি মাসে গ্যাস কিনতে যদি ২০০ মিলিয়ন ডলার করে লাগে, তাহলে আগামী ছয় মাসে দশমিক বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। সামনে কী হবে, তা আমরা জানি না। যুদ্ধ কতদিন চলবে, আমরা জানি না। যদি জানতাম, তাহলে এখানে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া যেত। ইউরোপীয় সব দেশ এসে এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) কিনে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে দামটা আগামীতে কী হবে, সেটিও জানি না। কথাগুলো এজন্যই বলছি যে আমরা সমাধানটা যেন করতে পারি। আর সংকট সমাধান করতে হলে আমাদের চাহিদা কমিয়ে ন্যাচারাল গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যেতে পারে।

গ্যাসের বিদ্যমান সমস্যার তাৎক্ষণিক প্রয়োজন মেটাতে ভোলার গ্যাসের প্রসঙ্গ টেনে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, আমরা এরই মধ্যে একটা কাজ শুরু করেছি। ভোলায় কিছু গ্যাস আছে, সেগুলো সিএনজিতে (সংকুচিত প্রাকৃতিক গ্যাসরূপান্তর করে বার্জে ঢাকায় নিয়ে আসতে চাই। সেখানে ৮০ এমএমসিএফডি গ্যাস পাওয়া যাবে। আমরা দু-তিন মাসে সেটা নিয়ে আসতে পারব এবং বার্জে সরবরাহ করব। শিল্প খাতে এলপিজি ব্যবহারের বিষয়টি উল্লেখ করে তৌফিক--ইলাহী চৌধুরী বলেন, সিএনজি স্টেশন থেকে গ্যাস নিয়ে ব্যবহারের ক্ষেত্রে কোনো বাধা নেই। আমরা বাধা দিতেও চাই না। শিল্পে যদি এলপি গ্যাস ব্যবহারের সুযোগ থাকে, সেখানে আমরা সহযোগিতা করতে চাই। সেটি কীভাবে করা যায় আপনারা (ব্যবসায়ী) পরামর্শ দেন।

বিদ্যুৎ সমস্যার কথা উল্লেখ করে জ্বালানি উপদেষ্টা বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ সমস্যা সমাধানে কৃচ্ছ্রসাধন করতে হবে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে যাচ্ছি। জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে এক হাজার মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ পাব। আরো এক হাজার মেগাওয়াট সোলার প্যানেলের মাধ্যমে উৎপাদন করব। তখন সমস্যার সমাধান অনেকটাই করতে পারব। যদি বিদ্যুৎ কম সরবরাহ করি তাহলে লোডশেডিং বাড়বে। তখন আপনারা বলবেন, কেন লোডশেডিং হচ্ছে? কিন্তু সবাই মিলে যদি একটু কম ব্যবহারের চেষ্টা করি, তাহলে কিন্তু সম্ভব। শিল্পের স্বার্থে যদি আমরা এসি বন্ধ রাখতে পারি, তাহলে কিন্তু ছয়-সাত হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ সাশ্রয় হতে পারে। সবই আপনাদের স্বার্থে। ফলে সবাইকে বিষয়টি সহযোগিতা করতে হবে। যুদ্ধের (মুক্তিযুদ্ধ) সময় তো আমাদের কিছুই ছিল না। তখনো আমরা চলেছি। এখনো পারব। আমরা শপথ নেব, দরকার হলে দিনের বেলা কোনো বিদ্যুৎ ব্যবহার করব না।

বাংলাদেশ চেম্বার অব ইন্ডাস্ট্রিজ (বিসিআই) আয়োজিত আলোচনা সভায় দেশের বর্তমান গ্যাস বিদ্যুতের সার্বিক অবস্থা নিয়ে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক . ইজাজ হোসাইন। উপস্থাপিত প্রবন্ধে বিশ্ববাজারে গ্যাসের দাম পরিস্থিতি বিবেচনায় অন্তত ২০০ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যেতে পারে বলে পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞ। সেমিনারে এফবিসিসিআই সভাপতি মো. জসিম উদ্দিন জানান, শিল্প খাতে গ্যাস সরবরাহ বাড়তে প্রয়োজনে আবাসিকে গ্যাস রেশনিং করা যেতে পারে। বিভিন্ন খাত থেকে কিছু কমিয়ে যদি শিল্প খাতে কিছুটা হলেও গ্যাস সরবরাহ বাড়ানো যায়, তাহলে সেখানে কারখানাগুলো বাঁচবে।

এফবিসিসিআই বিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি এবং হা-মীম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কে আজাদ জানান, গ্যাসের অভাবে আমাদের স্পিনিং মিলগুলো রাতে চালানো যায় না। আবাসিক থেকে শতাংশ গ্যাস যদি শিল্পে দেয়া যায় তাহলে স্পিনিং মিলগুলোতে নাইট শিফট চালু করা যাবে। সময় তিনি কারখানা চালু রাখতে কিছু গ্যাস আমদানিরও পরামর্শ দেন।

বাংলাদেশ টেক্সটাইল মিলস অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএমএ) সভাপতি মোহাম্মদ আলী খোকন জানান, আমাদের শিল্প-কারখানাগুলো এখন গ্যাস সংকটে ভুগছে। মুহূর্তে আমাদের কারখানাগুলো ভালোভাবে সচল রাখতে জাতীয় গ্রিডে অন্তত দৈনিক তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাসের প্রয়োজন।

বিকেএমইএর ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. আক্তার হোসাইন অপূর্ব বলেন, আমাদের শিল্প-কারখানাগুলোর ৪০ শতাংশ উৎপাদন কমে গিয়েছে। ঠিকমতো গ্যাস-বিদ্যুৎ না পেয়ে বন্ধ হয়ে গিয়েছে অনেক ফ্যাক্টরি। অবস্থায় অনেকেই অর্ডার ক্যানসেল করে দিচ্ছেন।

সময় আরো উপস্থিত ছিলেন বিসিআই সভাপতি আনোয়ার-উল আলম চৌধুরী পারভেজ, বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক . বিনায়ক সেন প্রমুখ।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন