ডিএসসিসির ভুলে ভরাট হচ্ছে অবশিষ্ট প্রাকৃতিক জলাধারটিও

আল ফাতাহ মামুন

ছবি: মাসফিকুর সোহান

রাজধানী ঢাকার বেশির ভাগ খাল-জলাশয় এরই মধ্যে দখলে নিয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা। আবাসন-শিল্পায়নের পাশাপাশি নানামুখী উন্নয়নকাজে দখল হয়েছে প্রাকৃতিক এসব জলাধার। এর মধ্যেও যে কয়টি খাল টিকে আছে সেগুলো দখলে-দূষণে বিপর্যস্ত। নগরের সংরক্ষণযোগ্য সর্বশেষ জলাধার অঞ্চলটিও হারাতে বসেছে সেটির প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য। ক্রমেই আবাসিক বাণিজ্যিক অবকাঠামো গড়ে উঠতে শুরু করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৭৫ নম্বর ওয়ার্ডে, যা একসময় নাসিরাবাদ ইউনিয়ন হিসেবে পরিচিত ছিল। অথচ ঢাকা মহানগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপে এলাকাকে কৃষি জলাধার সংরক্ষণ এলাকা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। নগর বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দুই বছর আগে সিটি করপোরেশনের ভুল পরিকল্পনায় নির্মিত সড়কের কারণেই রাজধানীর সংরক্ষণযোগ্য শেষ জলাভূমিটি এখন হুমকির মুখে।

ঢাকা মহানগরের বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনায় (২০২২-২০৩৫) বলা হয়েছে, রাজধানীর পানি নিষ্কাশন এবং জলাধার কৃষিকাজের জন্য সংরক্ষণযোগ্য এলাকা নাসিরাবাদ-ডেমরা অঞ্চল। অঞ্চলের জলাভূমি খালগুলো যেন কোনোভাবেই দখল না হয় সে বিষয়ে এতে একাধিকবার গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। রাজধানীর জলাভূমি হিসেবে উল্লেখ করে এলাকাকে পরিকল্পিতভাবে কৃষি অঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলার সম্ভাবনাও জানানো হয়েছে সর্বশেষ ড্যাপে।

প্রসঙ্গে জানতে চাইলে ড্যাপের প্রকল্প পরিচালক মো. আশরাফুল ইসলাম বলেন, নাসিরাবাদ অঞ্চলটি ঢাকার সংরক্ষণযোগ্য শেষ জলাধার অঞ্চল। বাসযোগ্য ঢাকা নিশ্চিতের জন্য যেকোনোভাবে নাসিরাবাদ এলাকাটি ভরাট হওয়া থেকে রক্ষা করতে হবে।

তিনি বলেন, জলাভূমি এলাকার সড়ক সাধারণ কংক্রিটের সড়কের মতো হয় না। এখানে ভায়াডাক্ট পদ্ধতিতে সড়ক নির্মাণ করতে হয়। পানিপ্রবাহে বাধা সৃষ্টি না করে পদ্ধতিতে সড়ক নির্মাণ করা হয়। অনেকটা উড়াল সেতুর মতো। এছাড়া প্রতি ১০০ মিটার সড়কের পর ১০০ মিটার ব্রিজ নির্মাণ করা যেতে পারে। ফলে আশপাশের জলাভূমিতে আবাসন বা বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণের প্রবণতা দেখা যায় না।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বুড়িগঙ্গার একটি চ্যানেল ধানমন্ডি খালে যুক্ত হয়েছে। এর পানিপ্রবাহ বক্স কালভার্টের মাধ্যমে যাচ্ছে হাতিরঝিলে। এখান থেকে নড়াই নদী হয়ে রাজধানীর পানিপ্রবাহের একাংশ গিয়ে পড়ছে বালু নদীতে। একসময় কারওয়ান বাজার পর্যন্ত প্রবহমান ছিল নড়াই নদী। তখন ব্যবসায়ীরা পণ্যের পসরা নিয়ে কারওয়ান বাজার ঘাটে নামতেন। ক্রমাগত দখলে নড়াই নদী এখন নড়াই খালে পরিণত হয়েছে। নাসিরাবাদে নড়াই খাল ছাড়াও আরো তিনটি বড় খাল রয়েছে। মূলত কৃষিকাজ মাছ শিকার করে এলাকার মানুষের জীবিকার সংস্থান হয়। তবে সম্প্রতি জলাভূমি ভরাটের প্রবণতায় হুমকিতে পড়েছে জীবিকার দুটি উৎস।

ডিএসসিসির ভুল পরিকল্পনায় রাজধানীর শেষ জলাধার অঞ্চলটি দখল হয়ে যাচ্ছে বলে মনে করছেন রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, দুঃখজনক হলেও সরকারি সংস্থাগুলোই ঢাকার জলাধার খাল দখলে বড় ভূমিকা পালন করেছে। নাসিরাবাদ কায়েতপাড়া এলাকায় ভুল সড়ক নির্মাণের ফলে দেদারসে নিচু ভূমি ভরাট চলছে। দুই-পাঁচ বছর পর সেখানে কোনো জলাভূমি থাকবে না। সিটি করপোরেশনকে অবশ্যই ভুল শোধরাতে হবে। নাসিরাবাদ কায়েতপাড়ার নিচু ভূমি ভরাট হয়ে গেলে রাজধানীর জলাবদ্ধতা ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। পাশাপাশি মশাবাহিত রোগের প্রাদুর্ভাবও বাড়বে।

সরেজমিন নাসিরাবাদ, দাশেরকান্দি কায়েতপাড়া এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পুরো অঞ্চলই মূলত জলাভূমি। এর মধ্য দিয়ে বয়ে গিয়েছে একটি কংক্রিটের সড়ক। যোগাযোগের জন্য দীর্ঘকাল ধরে মাটির সড়ক ব্যবহার করে আসছিল বলে জানায় এলাকাবাসী। সম্প্রতি সড়কটি কংক্রিটের আচ্ছাদন দিয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন (ডিএসসিসি) সড়ক নির্মাণের পর থেকেই পুরো এলাকার জলাভূমি একে একে ভরাট হতে শুরু করে। ড্যাপের প্রতিবেদনেও ওই এলাকা ভরাটের বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে।

স্থানীয় সমাজকর্মী মো. সাইফুল ইসলাম বলেন, এলাকায় সড়কটি প্রয়োজন ছিল। দুই বছর হলো সড়কটি নির্মাণ হয়েছে। সড়ক নির্মাণের ফলে এখানকার জমির দাম বেড়ে গেছে। এতে নিচু ভূমি ভরাট করে আবাসন বাণিজ্যিক কার্যক্রম চালুর প্রবণতা বেড়েছে।

নগর বিশেষজ্ঞরা বলেন, সাধারণত কোনো এলাকায় সড়ক নির্মাণের পর পরই সেখানে আবাসন বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণ শুরু হয়। নাসিরাবাদ এলাকাটি আফতাবনগর হাউজিং ঘেঁষা হওয়ায় এখানে আবাসন ব্যবসা জমে উঠতে বেশি সময় লাগবে না। এরই মধ্যে নাসিরাবাদের অনেক জলাভূমিতে আবাসিক প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরুর উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। বিশেষ করে আফতাবনগর হাউজিংয়ের পর থেকেই বেশ কয়েকটি হাউজিং প্রকল্পের সাইনবোর্ড দেখা যায়। স্থানীয়দের অনেকেই ডেভেলপারদের কাছে তাদের জমি বিক্রি করে দিয়েছেন।

নাসিরাবাদে সড়ক নির্মাণের ক্ষেত্রে জলাধার সংরক্ষণের বিষয়টি পরিকল্পনায় ছিল কিনা জানতে চাইলে ডিএসসিসির প্রধান প্রকৌশলী সালেহ আহম্মেদ বণিক বার্তাকে বলেন, ভায়াডাক্ট পদ্ধতিতে সড়ক নির্মাণ বেশ ব্যয়বহুল। এলাকাবাসীর প্রয়োজন বিবেচনায় নিয়ে আমরা দ্রুত সড়কটি নির্মাণ করি। এতে জলাভূমি খাল ভরাট হয়ে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সরকারের নির্দিষ্ট করা কোনো খাল বা জলাশয় কোথাও ভরাট হচ্ছে না। পরিবেশ আইন জলাধার আইন অনুযায়ী জলাভূমি কৃষিভূমি ভরাট করা আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ। নাসিরাবাদ এলাকায় ভুল পদ্ধতিতে সড়ক নির্মাণ করে সিটি করপোরেশন সরাসরি সে অপরাধে সহযোগীর ভূমিকায় ছিল বলে মনে করছেন স্থপতি নগরবিদ ইকবাল হাবিব। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, যেকোনো মূল্যে ঢাকার জলাধার সংরক্ষণের বিষয়ে একনেকের একাধিক বৈঠকে নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সিটি করপোরেশন ভুল পরিকল্পনায় রাস্তা বানানোর ফলে ওই অঞ্চলের সব জলাধার ভরাট হতে শুরু হয়েছে। পানিপ্রবাহ না রেখে রাস্তা নির্মাণ করে সিটি করপোরেশন জলাধার আইন পরিবেশ আইন লঙ্ঘনের পাশাপাশি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেছে। আমাদের দাবি থাকবে, অতি দ্রুত সেখানে পরিকল্পিত সড়ক নির্মাণ করা হোক। নয়তো জলাধারও আর বাঁচানোর উপায় থাকবে না।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন