অবাধ সংকরায়নে হারাতে বসেছে দেশী গরুর জাত

শাহাদাত বিপ্লব

রেড চিটাগাং ক্যাটল (আরসিসি) স্থানীয়ভাবে চট্টগ্রামের লাল গরু নামে পরিচিত। মাংসের পাশাপাশি জাতের গাভীর দুধও বেশ পুষ্টিকর সুস্বাদু। দেখতে সুন্দর দেশী গরুটি প্রতি বছরই প্রজননে সক্ষম। রেড চিটাগাং ক্যাটলের মতো মুন্সীগঞ্জ ক্যাটল বা মীরকাদিম, পাবনা ক্যাটল নর্থ বেঙ্গল গ্রে বা উত্তরবঙ্গের ধূসর গরুও বাংলাদেশের জনপ্রিয় দেশী জাত। দেশজুড়ে স্থানীয় এসব জাতের গরুর প্রচুর চাহিদা থাকলেও নিয়ম না মেনে কৃত্রিম প্রজননে আজ হুমকির মুখে। অথচ হাইব্রিড গরুর লালন-পালন ব্যয় যেমন বেশি, তেমনি রয়েছে অধিক চিকিৎসা খরচ মৃত্যুঝুঁকি। যদিও স্থানীয় জাতের চেয়ে এসব গরু থেকে বেশি দুধ মাংস মেলে। আবার বিনিয়োগ আয় হিসাব করলে সংকর জাতের চেয়ে দেশী গরুতেই লাভবান হওয়ার সম্ভাবনা বেশি বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। তাছাড়া কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে সৃষ্ট জাত বাণিজ্যিক খামারের জন্য উপযোগী হলেও ব্যক্তিপর্যায়ে লালন-পালন বেশ ব্যয়বহুল।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে মোট গরুর সংখ্যা কোটি ৪৭ লাখ। এর মধ্যে প্রায় ৬০ শতাংশ বা দেড় কোটি গরুই সংকর জাতের। ফলে মাংসের বাজারে এরই আধিপত্য। গবেষকরা বলছেন, আবহাওয়াগত প্রতিকূলতার কারণে বিদেশী বা সংকর জাতের গরুর স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে অতিরিক্ত খাবার দিতে হয়। আবার খাদ্যের দাম বেশি হওয়ায় উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় কয়েক গুণ। এর প্রভাব পড়ছে মাংসের বাজারেও। বর্তমানে জনপ্রিয় মাংসের বাজারদর মধ্য নিম্ন মধ্যবিত্তদের নাগালের বাইরে থাকার অন্যতম কারণও এটি। তবে বছরে জবাই হওয়া মোট গরুর প্রায় অর্ধেকই হয় কোরবানিতে। স্বাদ বিবেচনায় বরাবরই সময় দেশী গরুর চাহিদা থাকে কয়েক গুণ বেশি।

স্থানীয় গরুর সংখ্যা নিয়ে যথাযথ কোনো তথ্য নেই সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকের তথ্য থেকে অবশ্য জানা যায়, ২০০০ সালে চট্টগ্রাম জেলায় মোট গরু ছিল লাখ ৯৮ হাজার ৮০০টি। এর মধ্যে রেড চিটাগাং ক্যাটল ১০ হাজার ৪৮৯টি, যা মোট গরুর প্রায় দশমিক শতাংশ। ২০০৬ সালে ক্যারেক্টারাইজেশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন প্যাটার্ন অব রেড চিটাগাং ক্যাটল অব বাংলাদেশ শীর্ষক এক গবেষণায় এসব তথ্য প্রকাশিত হয়। ২০২১ সালে ফ্রন্টিয়ার্স নামের সুইজারল্যান্ডভিত্তিক জার্নালে প্রকাশিত অপর এক গবেষণায় দেখা যায়, ২০০৮ সালে চট্টগ্রামে রেড চিটাগাং ক্যাটলের সংখ্যা ছিল ৪১ হাজার ৭৩০, যা মোট গরুর প্রায় ভাগেরও বেশি। সময় কেবল চট্টগ্রাম অঞ্চলেই গরুটি পাওয়া গেলেও পরে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। এর তথ্যও মেলে বিভিন্ন গবেষণায়।

রেড চিটাগাং ক্যাটল দেশী জাতগুলো নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক . ফজলুল হক ভূঁইয়া। তার দেয়া তথ্যমতে, গবেষণার জন্য নেয়া এক জরিপ অনুযায়ী ২০২১ সালে সারা দেশে আরসিসি গরুর সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৭ হাজার ৬০০টিতে। সরকারি কোনো তথ্য না থাকায় এটিকেই গ্রহণযোগ্যতার কাছাকাছি বলছেন অধ্যাপক। তবে বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, দেশী ক্রস গরুর ক্ষেত্রে সরকারি নির্ভুল তথ্য জানা থাকলে সঠিকভাবে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া যায়।

বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের গবেষকদের জরিপের তথ্যমতে, সারা দেশে আরসিসি গরু রয়েছে প্রায় ৪৫ হাজার। স্থানীয় জাতের গরুর সংখ্যা নিয়ে বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) . এসএম জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, মুন্সীগঞ্জ ক্যাটল বা মীরকাদিমের সংখ্যা আনুমানিক পাঁচ হাজার। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর অবশ্য বলছে, ৫০ হাজারের মতো। তবে পাবনা ক্যাটল নর্থ বেঙ্গল গ্রে গরুর কোনো হিসাব নেই সংস্থাটির কাছে। বিষয়ে যোগাযোগ করা হলে পাবনা জেলার প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মো. আল মামুন হোসেন মন্ডল বলেন, পাবনা ক্যাটলের সংখ্যা ঠিকভাবে জানা নেই। তবে এটা অনেক আগের জাত। কৃত্রিম প্রজননের কারণে জাতটি এখন বিলুপ্তির পথে। গ্রামের কিছু জায়গায় দু-একটা দেখা যায়। আর কয়েকটি প্রতিষ্ঠান এগুলো সংরক্ষণে রেখেছে।

দেশীয় জাতগুলোতে মাংস দুধ উৎপাদন কম হলেও অনুকূল আবহাওয়া, খাদ্য খরচ, প্রজনন স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনায় লালন-পালনের জন্য প্রান্তিক কৃষকদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। অর্থনৈতিক ভারসাম্য গ্রাম্য পরিবেশে এসব গরু পালনেই গুরুত্ব দিয়েছেন গবেষকরা। ২০২১ সালে প্রকাশিত ইকোনমিক অ্যান্ড জেনেটিক ইভ্যালুয়েশন অব ডিফারেন্ট ডেইরি ক্যাটল ব্রিডস আন্ডার রুরাল কন্ডিশন ইন বাংলাদেশ শীর্ষক গবেষণায় দেখা যায়, অর্থনৈতিক বিশ্লেষণে রেড চিটাগং ক্যাটলের সঙ্গে হোলিস্টিন দেশীয় জাতের কৃত্রিম প্রজননকৃত গরুর মধ্যে তুলনামূলকভাবে আরসিসি লাভজনক। ২০০৮-১০ সাল পর্যন্ত ৩০০টি খামারে ৩৬০টি আরসিসি, ১৫০টি স্থানীয় ১০০টি হোলিস্টিন এবং দেশীয় জাতের কৃত্রিম প্রজননকৃত গরু নিয়ে গবেষণা পরিচালনা করা হয়। সেই গবেষক দলের সদস্য এবং চট্টগ্রাম ভেটেরিনারি অ্যানিমেল সায়েন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক্স অ্যান্ড অ্যানিমেল ব্রিডিং বিভাগের অধ্যাপক . মো. কবিরুল ইসলাম খান বণিক বার্তাকে বলেন, আমরা খাদ্য আনুষঙ্গিক খরচ বিবেচনায় নিয়ে গবেষণাটি করি। এতে দেখা যায়, একটি হোলিস্টিন গরু তার পুরো জীবনে তিনবার বাচ্চা দেয়। এরপর দুধের পরিমাণ কমে যায়। আবার আরসিসি ছয়-সাতবার বাচ্চা দিতে পারে। ফলে এক বছরের হিসাবে হোলিস্টিন লাভজনক হলেও পুরো জীবনকালে দেশী আরসিসিই বেশি লাভজনক।

কৃত্রিম প্রজননকে খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের অনুরোধ জানিয়ে অধ্যাপক বলেন, অনিয়ন্ত্রিত সংকরায়ন ঠেকানো না গেলে দেশীয় জাতগুলো একদিন হারিয়ে যাবে। এতে গ্রামের মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ বিদেশী জাতের গরু উৎপাদন খরচ বেশি রোগবালাই বেশি হয়। দেশী জাতের গরুগুলো প্রাকৃতিকভাবে মাঠে চরে বড় হয়, রোগবালাইও তেমন হয় না। বাণিজ্যিকভাবে পালনের জন্য বিদেশী জাত উপযোগী হলেও গ্রামের মানুষের জন্য দেশী গরুর বিকল্প নেই। তাই দেশীয় জাতগুলোকেই আরো কীভাবে উন্নত করা যায়, সেটা নিয়ে ভাবতে হবে।

অধ্যাপক . ফজলুল হক ভূঁইয়াও একই কথা বলেনঅর্থনৈতিক প্রতিযোগিতায় মনে হতে পারে যে, দেশী জাতের গরু উৎপাদনে লাভ কম। আসলে চিত্র পুরোপুরি ভিন্ন। ইনপুট আউটপুট হিসেবে চিন্তা করলে উচ্চ মধ্যবিত্ত, মধ্যবিত্ত নিম্ন মধ্যবিত্তদের ক্ষেত্রে অর্থনৈতিকভাবে উপযোগী দেশীয় জাতের গরু। কোরবানির ক্ষেত্রেও দেখা যাবে দেশী গরুতে যে লাভ খামারিরা পায়, বিদেশীর ক্ষেত্রে কিন্তু তা আসে না। যদি দেশী জাতের গরু তিন-চার জেনারেশন প্রজননের মাধ্যমে জাত উন্নয়ন করা যায় তাহলে দেখা যাবে, তাদের দুধ মাংসের হারও অনেক বেড়ে যাবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশে কৃত্রিম প্রজননের ফলে বিদেশী সিমেন দিয়ে অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দেশীয় জাতগুলো নষ্ট করা হচ্ছে। সরকারি প্রজনন নির্দেশিকা না মেনে বিশেষ করে কৃত্রিম প্রজননকর্মীরা বেশি পয়সা পাওয়ার জন্য রেড চিটাগাংয়ের মধ্যেও শাহীওয়াল বা অন্য গরুর জাতের সিমেন দিয়ে দেয়। মাঠপর্যায়ের তদারকির অভাবে এসব কর্মকাণ্ড চলছে অবাধেই। নিয়ে কমিটি হয়েছে, তবুও সক্ষমতার অভাবে নীতিমালা বাস্তবায়নে সময় লাগছে। জাতীয় প্রজনন নীতিমালায় দেশী জাতকে দেশী জাত দিয়েই উন্নত করার নির্দেশনা দেয়া আছে। আবার যারা বাণিজ্যিক খামার করবে, তাদের জন্য দেশী ৫০ ভাগ বিদেশী ৫০ ভাগ দিয়ে কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে উন্নত করার কথা বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারকেই দায়িত্ব নিতে হবে।

সংকরায়ন দেশীয় জাতের জন্য বড় হুমকি উল্লেখ করে অধ্যাপক বলেন, প্রচারণার কারণে বিদেশী জাতের গরু মানুষ না বুঝেই গ্রহণ করে। এর ফলে দেশীয় জাত হারিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া সরকারি বেসরকারিভাবে নিয়ম-নীতিবহির্ভূতভাবে যে সংকরায়ন হচ্ছে, সেটা দেশীয় জাত হারিয়ে যাওয়ার পেছনে সবচেয়ে বড় কারণ। ২০১৯ সালে কৃত্রিম প্রজনন নির্দেশিকা রয়েছে এবং ২০০৭ সালের প্রজনন নীতিমালা রয়েছেএগুলো মানলেই হবে।

উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, ১৯৯০ সালের পর থেকে ভারত পাকিস্তান তাদের দেশীয় গরু বিশেষ করে শাহীওয়ালের জাত উন্নয়নে শত শত কোটি টাকা খরচ করছে। জাত উন্নয়ন করে এখন ৩৯ লিটার দুধ দেয় এমন গাভীও দেশ দুটির খামারিদের হাতে আছে। আমাদের জাতগুলোকেও উন্নত করা যাবে। একটি গাভীকে দেশী সংকর দুই জাতের বাচ্চা দেয়ানো সম্ভব। এর জন্য প্রয়োজন সত্যিকারের পরামর্শ।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, গ্রামের খামারি পর্যায়ে অজ্ঞতার কারণে বিদেশী গরু অসুস্থ হলে অ্যান্টিবায়োটিক বা বিভিন্ন ওষুধের যথেচ্ছ ব্যবহারের প্রবণতা দেখা যায়। এর ফলে ঝুঁকি রয়েছে মানবদেহে প্রবেশেরও। বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. এমএ ফয়েজ বণিক বার্তাকে বলেন, অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহারে সরকারের কঠোর নির্দেশনা রয়েছে। তবে গ্রামীণ পর্যায়ে কতটুকু মানা হয় তা আমার জানা নেই। গরুতে যদি অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার করা হয় সে ক্ষেত্রে মানবদেহের স্বাস্থ্যঝুঁকির শঙ্কা রয়েছে।

কোরবানিতে রেড চিটাগাং ক্যাটল সরবরাহ করে চট্টগ্রামের মেসার্স সারাহ এগ্রো। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী আরিফ চৌধুরী বণিক বার্তাকে বলেন, আমাদের খামারে রেড চিটাগাং ক্যাটল, শাহীওয়াল, ব্রাহ্মাসহ বিভিন্ন দেশীয় সংকর জাতের দুই শতাধিক গরু রয়েছে। বিয়ে, মেজবান, কোরবানিতে সাধারণত দেশীয় জাতের চাহিদা থাকে বেশি। যারা তিন-পাঁচ মণ বা লাখ টাকার নিচে গরু চান তারা দেশীয় গরুই নেন। কারণ অধিকাংশ মানুষই তো মধ্যবিত্ত বা নিম্ন মধ্যবিত্ত। তিনি বলেন, দেশী গরু উৎপাদন খরচ অনেক কম। প্রাকৃতিকভাবেই বড় হয়। কিন্তু বিদেশী জাতের গরুতে উৎপাদন খরচ বেশি। কিনতেও হয় অনেক বেশি দামে। অবশ্য বাণিজ্যিক খামারের জন্য বিদেশী জাতের বিকল্প নেই। তবে যারা বাড়িতে গরু রাখেন তাদের জন্য দেশীটাই উপযোগী।

প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) . এসএম জাহাঙ্গীর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, আরসিসি মুন্সীগঞ্জ ক্যাটল যেন বিলুপ্ত না হয় তার উদ্যোগ আমরা নিয়েছি। পাবনা ক্যাটল ক্রস হতে হতে এখন কোথায় আছে তারও ঠিক নেই। ইনব্রিডিংয়ের কারণে এসব জাত টিকিয়ে রাখতে সংকট তৈরি হয়েছে। আরসিসি, মুন্সীগঞ্জ ক্যাটল, পাবনা ক্যাটল নর্থ বেঙ্গল গ্রেএগুলো দেশী জাতের মধ্যে উন্নত জাত। আর দেশী জাতগুলো নিয়ে আমাদের গবেষণা চলমান রয়েছে। এগুলো সংরক্ষণে নানা নির্দেশনাও রয়েছে। মধ্যবিত্ত যারা আমরা তাদের পরামর্শ দিচ্ছি দুটো দেশী গরু পালন করতে। এগুলোর খাবার খরচও কম। রোগ-বালাই হয় না। জীবনে ১২-১৫টি পর্যন্ত বাচ্চা দিতে পারে। প্রতি বছরই বাচ্চা দেয়। রঙ সুন্দর হওয়ায় দামও বেশি পাওয়া যায়।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন