নদীভাঙন ও বন্যায় অভাব ঘোচে না কুড়িগ্রামের চরবাসীর

বাদশাহ্ সৈকত, কুড়িগ্রাম

দফায় দফায় বন্যা ও নদীভাঙনে নিঃস্ব হচ্ছে কুড়িগ্রামের চরের বাসিন্দারা ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

ছয় মাস আগে কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার যাত্রাপুর ইউনিয়নে ব্রহ্মপুত্র নদের অববাহিকায় নতুন জেগে ওঠা পোড়ার চরে বসতি গড়েছে ৭৫টি পরিবার। একই ইউনিয়নের পাশের চরভগবতীপুরে বাড়ি ছিল এসব পরিবারের। কিন্তু ব্রহ্মপুত্রের অব্যাহত ভাঙনে বসতভিটাসহ আবাদি জমি হারিয়েছে তারা। সব হারিয়ে এসব পরিবার দ্বারস্থ হন প্রশাসনের। পরে সদর উপজেলা প্রশাসন থেকে নতুন জেগে ওঠা পোড়ার চরের খাসজমিতে বসত গড়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে। এরপর নদের ভাঙন থেকে রক্ষা পাওয়া অবশিষ্ট ভাঙাচোরা ঘর আসবাব নিয়ে সেখানে বসবাস করছে এসব পরিবার।

চরের বাসিন্দা ৬৫ বছর বয়সী আব্দুর রশিদ জীবনের বেশির ভাগ সময় ব্রহ্মপুত্রের ভাঙাগড়ায় পার করেছেন। সরেজমিনে পোড়ার চরে কথা হয় আব্দুর রশিদের সঙ্গে। সময় নিজের ভাগ্যের ওপরই দোষ চাপান তিনি। নদীর দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করেন, ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত তাদের বাড়ি ভেঙেছে সাতবার। ছোটবেলায় যখন তার বয়স নয়, তখন প্রথম নদে বাড়ি বিলীন তাদের। আবাদি জমির বেশির ভাগ চলে যায় নদের গভীরে। পরে নতুন জেগে ওঠা চরে বসত গড়েন তার বাবা। সেখানে শুরু হয় নতুন সংগ্রাম, কিন্তু ১০ বছরের বেশি টেকেনি সে চরও। আবারো নতুন ঠিকানা বালু চর। এভাবেই -১০ বছর পরপর ভাঙনের কবলে পড়তে পড়তে এখন নিঃস্ব তারা।

বাস্তবতা শুধু পোড়ার চরের আব্দুর রশিদের নয়, উলিপুর উপজেলার বেগমগঞ্জ ইউনিয়নের মুসার চরের ৭০ বছরের আব্দুল জব্বারেও। তার বাড়ি ভেঙেছে ছয়বার। তিনি জানান, চরের জীবন যাযাবরের মতো। এখানে বসত গড়েছি আট বছর, কিন্তু এরই মধ্যে চরের একদিকে ভাঙন শুরু হয়েছে, হয়তো এক বছরের মধ্যে এখানেও আর থাকা হবে না। তিনি আরো জানান, চরের বালি মাটিতে ভালো ফসলও হয় না। বর্তমানে ঢাকায় শ্রমিকের কাজ ছেলের ওপর নির্ভর করেই ছয় সদস্যের সংসার চলে যাচ্ছে তার।

মুসার চরের বাসিন্দারা অভিযোগ করেন, এখানে দেড় শতাধিক পরিবার বসবাস করলেও তাদের সন্তানদের লেখাপড়ায় নেই কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এমনকি পাশের চরেও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না থাকায় বিদ্যালয়ের গণ্ডিতেই পা রাখা হয়নি চরের শিশুদের।

কুড়িগ্রাম জেলার ওপর দিয়ে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা, দুধকুমার, ফুলকুমার, জিঞ্জিরাম, হলহলিয়া, কালজানিসহ ছোট-বড় ১৬টি নদ-নদী প্রবাহিত হয়েছে। এর মধ্যে ব্রহ্মপুত্র, ধরলা, তিস্তা দুধকুমারের অববাহিকায় সরকারি হিসেবে রয়েছে প্রায় সাড়ে চার শতাধিক ছোট-বড় চর। এসব চরের দৃশ্যপট একই রকমের। চরের বাসিন্দাদের প্রত্যেকেরই বাড়ি ভেঙেছে -১০ বার পর্যন্ত। প্রতিবারই নতুন চরে বসত গড়ে ঘুরে দাঁড়ানোর মুহূর্তেই ভেঙেছে সে চরও।

ভাঙন অব্যাহত থাকায় নদ-নদীর তলদেশ ভরাট হয়ে গিয়েছে। ফলে উজান থেকে নেমে আসা সামান্য পানিতেই বন্যা সৃষ্টি হচ্ছে। আবার স্রোত তীব্র হওয়ায় ভাঙছে নদীর পাড়ও।

শুধু নদীভাঙন নয়, চরাঞ্চলের এসব মানুষকে প্রতি বছর দুই-পাঁচ দফায় বন্যার কবলে পড়তে হয়। সময় ঘরবাড়ির ক্ষতিসহ ফসলহানি হয় চরের বাসিন্দাদের। বন্যা বন্যা-পরবর্তী তিন-চার মাস হাতে কোনো কাজ থাকে না তাদের। সময় জমানো সামান্য খাবার ত্রাণ সহায়তার ওপর নির্ভর করতে হয় এসব পরিবারকে। ভাঙন আর বন্যার ক্ষতির কারণে সারা বছরই খাদ্য সংকটে থাকতে হয় তাদের। 

চরের বাসিন্দারা জানান, বন্যা নদীভাঙন কোনোভাবেই তাদের ভাগ্যের পরিবর্তন আনতে দিচ্ছে না। উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকার জাহাজের আলগা চরের গাজির রহমান (৫৫) জানান, নদীভাঙন বন্ধ করা হলে তাদের নিঃস্ব জীবন-যাপন করতে হতো না।

দীর্ঘদিন চরের বাসিন্দাদের নিয়ে কাজ করা এনজিও কর্মীরা জানান, চরাঞ্চলের এসব মানুষের জীবন-মানোন্নয়নে কয়েক যুগ ধরে শত শত এনজিও কাজ করেও কোনো লাভ হয়নি। এনজিওগুলোর পক্ষ থেকে তাদের স্বাবলম্বী করার চেষ্টা করা হলেও বারবার ভাঙনের কবলে পড়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েন চরের বাসিন্দারা।

স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা সলিডারিটির পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা হারুন-উর-রশিদ লাল জানান, নদীভাঙন আর বন্যার কারণে চরাঞ্চলের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন হচ্ছে না। চরের শিশুরা লেখাপড়া শেখার মৌলিক অধিকার থেকেও বঞ্চিত।

উত্তারাঞ্চলের নদী গবেষক, রিভারাইন পিপলের পরিচালক বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক . তুহিন ওয়াদুদ জানান, নদীগুলোকে প্রাকৃতিকভাবে থাকতে দেয়া হয়নি। সে কারণে নদীগুলোর তলদেশ ভরাট হয়েছে। আবার নদীগুলোর আমরা কোনো পরিচর্যাও করিনি। সে কারণে ভাঙন তীব্র হয়েছে। অল্প পানিতে বেড়েছে বন্যার প্রকোপ। বন্যা ভাঙন দুর্গতদের পাশে সরকার এমন কোনো পরিকল্পনা নিয়ে এসে দাঁড়ায়নি যাতে তারা আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারে।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ রেজাউল করিম জানান, তিস্তায় মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নের কাজ প্রক্রিয়াধীন। মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হলে তিস্তাপাড়ের মানুষ ভাঙন থেকে মুক্তি পাবে। দুধকুমারেও প্রকল্প চলমান। এছাড়া ধরলা ব্রহ্মপুত্রের ভাঙনকবলিত এলাকায় প্রকল্পকাজ চলমান।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন