রাজনৈতিক কূটচাল

কর্তৃত্ববাদী ও গণতান্ত্রিক শাসন সবই রাজার খেলা

কৌশিক বসু

ভিন্নমতের প্রেতাত্মারা রাশিয়ায় ভুতুড়ে পরিবেশ তৈরি করে ফেলেছে। মস্কো, সেন্ট পিটার্সবার্গসহ রাশিয়ার বিভিন্ন শহরে সামরিক বাহিনীতে যোগদানের বিরোধিতায় ক্ষুদ্র বড় আকারের বিক্ষোভও হয়েছে। হাজার হাজার তরুণ দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছে। দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য তিন লাখ সৈন্য সংগ্রহ করতে চেয়েছেন। এর বিরোধিতা করায় দুই হাজারেরও বেশি রাশিয়ার নাগরিককে আটক করা হয়েছে।

এটা এখনই বলা ঠিক হবে না বা বলার সময়ও হয়নি যে, বর্তমান অস্থিরতা পুতিনকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়ার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখবে। তবে তিনি যদি আসলেই ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান, তাহলে এটি ইউক্রেনের নাগরিক এবং বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে পড়া কোটি কোটি মানুষের জন্য আশীর্বাদ হিসেবে আবির্ভূত হবে। সবচেয়ে বেশি সুফলভোগী হবে রাশিয়ার সাধারণ জনগণ, যাদের জীবন সম্ভাবনা পুতিনের দুর্নীতিপরায়ণ কর্তৃত্ববাদী শাসনে খর্ব হচ্ছে।

রাশিয়ার নাগরিকরা কি পুতিনকে হটিয়ে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধার করতে চায়? আপনি যদি আপনার পরিচিত রাশিয়ান কাউকে জিজ্ঞেস করেন, তাহলে তাদের অধিকাংশই সম্ভবত এটিই বলবে যে বেশির ভাগ জনগণ এখনো তাকে সমর্থন করে। এক্ষেত্রে আমার নিজেরই দ্বিধা আছে। কেননা স্বেচ্ছাচারী শাসক বিদায় নেয়ার আগের দিন পর্যন্ত তার সর্বাধিক জনপ্রিয়তার কথাই বলা হয়। কারণ স্বেচ্ছাচারী শাসকরা সবসময়ই টিকে থাকার কৌশল হিসেবে প্রতারণামূলক সমর্থনকে সামনে আনে। এমন প্রবণতা ২০১১ সালে তিউনিসিয়ার জাইন আল আবেদিন বেন আলী এবং মিসরের হোসনি মোবারকের পতনের আগে দেখেছি। ১৯৫০ সালের শুরুতে যুক্তরাষ্ট্রে ম্যাককার্থির সময়ে জনগণের অধিকাংশের মধ্যে সিনেটর ম্যাককার্থির দমনমূলক দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনকারীই বেশি ছিল।

চরম নৃশংসতার পরও কর্তৃত্ববাদী
শাসকরা চতুরতার সঙ্গে ক্ষমতায় টিকে থাকতে চায়। ২০২০-এর গ্রীষ্মে জনগণের উত্থানের ফলে বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেঙ্কর নিপীড়নমুখী শাসনকাল শেষ হওয়ার হুমকি তৈরি হয়। কিন্তু তিনি টিকে গিয়েছিলেন জনসমর্থনের দোহাই দিয়ে। মিয়ানমারের সামরিক শাসনামলে বিশ্বের সবচেয়ে নির্মম একনায়কত্ব জারি রয়েছে, যা গণতন্ত্রায়নের বিভিন্ন প্রচেষ্টার পরও টিকে আছে।

সব মিলিয়ে গণতন্ত্রের পিছিয়ে পড়ার সময়ে জোর করে কর্তৃত্ববাদী শাসককে টিকিয়ে রাখার একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে জনপ্রিয়তাকে নতুন করে সামনে আনা হচ্ছে। কিছু অত্যাচারী শাসক প্রবল জনবিরোধিতার কারণে ক্ষমতা থেকে সরে যাচ্ছেন। এক্ষেত্রে আমরা উত্তম আইন এবং সংবিধান সাজাতে পারি যেটা নিশ্চিত করতে পারে যে শাসকরা জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে না। ভুলে গেলে চলবে না সংবিধানের ভূমিকা গণতন্ত্রের ভিতকে অতীতে শক্তিশালী করেছিল। উদাহরণস্বরূপ, যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে ২২তম সংশোধনীর মাধ্যমে প্রেসিডেন্টদের দুবার নির্বাচিত হওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা হয়। কর্তৃত্ববাদী শাসন সীমিত করার চেষ্টার মধ্যেও অনেকে বিভিন্ন উপায় খুঁজে বের করছেন অধিক সময় ক্ষমতা আঁকড়ে ধরতে। চীনের মতো দেশেও দেখা যাচ্ছে প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং মাসেই তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকার নজিরবিহীন ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন, বলা যায় তিনি এরই মধ্যে এটি অর্জন করেও ফেলেছেন।

লুকাশেঙ্ক পুতিনের মতো একনায়কদের দীর্ঘ সময় ধরে ক্ষমতায় টিকে থাকার ব্যাখ্যা কী? সম্প্রতি আমি এটি ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। আমি একে কারাবাসের খেলা হিসেবে উল্লেখ করেছি। সেখানে আমি দেখানোর চেষ্টা করেছি কীভাবে বিমূর্ত দার্শনিক যুক্তি ভালো কৌশলকে সরিয়ে দিতে পারে এবং দমনমূলক কৌশল কর্তৃত্ববাদী শক্তিকে ক্ষমতায় ঠিকিয়ে রাখতে সহায়তা করে।

কারাবাসের খেলা একটি সাধারণ চিন্তা পরীক্ষণের স্ফুটনকে নিচে নামিয়ে দিতে পারে। ধরা যাক, ১০০ জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের একটি দেশে প্রতিটি নাগরিকই শাসকের বিরোধিতা করে। এক্ষেত্রে যদি ১০ জন নাগরিকও রাস্তায় নামে, শাসক ক্ষমতা থেকে সরে যাবে। কিন্তু যদি ১০ জনের কম মানুষ প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামে এবং শাসক যদি কর্তৃত্ববাদী হয় তবে শাসক কর্তৃক তাদের জেলে ঢোকানোর সম্ভাবনা অনেক বেড়ে যাবে। কিন্তু যদি দেশের প্রতিটি নাগরিক প্রতিবাদ করতে রাস্তায় নামে তবে তাদের আটক হওয়ার সম্ভাবনা শূন্যে নেমে আসবে এবং শাসকরাও তাদের সামনে দাঁড়ানোর কোনো সুযোগ পাবে না।

কিন্তু চতুর নির্মম শাসকরা জনগণকে ১০টি ভিন্ন গোষ্ঠীতে বিভক্ত করে রাখে। কারণ এতে জনগণ কখনো একত্রিত হয়ে রাস্তায় আন্দোলন করতে পারে না। কর্তৃত্ববাদী শাসকরা বিরোধীদলীয় নেতা, সংবাদপত্রের সম্পাদক, শ্রম ইউনিয়নের কর্মকর্তা ইত্যাদি নানা গ্রুপ তৈরি করে। ধরুন শাসক ঘোষণা করলেন তিনি শুধু বিরোধীদলীয় নেতাদের আটক করবেন, যারা তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে ভূমিকা রেখেছেন। তাহলে অন্যরা এর বিরুদ্ধে কোনো কথাই বলবে না। বিরোধীদলীয় নেতারা যদি বাসায় বসে থাকেন, তাহলে তিনি প্রতিবাদকারী সংবাদপত্রের সম্পাদক বা অন্যদের আটক করবেন; যতক্ষণ পর্যন্ত না বিদ্রোহ শেষ হয়। 

এটা অনুমান করা কঠিন না যে শেষ পর্যন্ত কী ঘটবে। বিরোধী দলের নেতারা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করবেন না। কারণ তারা আটক হওয়ার বিষয়ে নিশ্চিত। এক্ষেত্রে সংবাদপত্রের সম্পাদকরাও যোগ দেবেন না। কারণ তারাও গ্রেফতার হওয়ার ভয়ে থাকবেন। যতক্ষণ পর্যন্ত না বিরোধী দলের নেতা এবং সংবাদপত্রের সম্পাদকরা নিশ্চিত হবেন যে রাস্তায় অবস্থান করলে শ্রমিক ইউনিয়নের নেতারাও তাদের সঙ্গে যোগ দেবেন ততক্ষণ তারা কোনো আন্দোলন করবেন না। কেউ প্রতিবাদ করার ক্ষেত্রে নিরাপদ বোধ না করলে কখনো আন্দোলন জোরালো হবে না। আন্দোলনকারীরাও সমন্বিতভাবে এক হয়ে কখনো আন্দোলনও করতে চাইবেন না। কারণ তাদের মধ্যে বিভক্তি তৈরি করে রাখা হয়েছে। ফলে এক গ্রুপ আন্দোলন করলেও সরকার বলতে পারে যে তাদের জনপ্রিয়তা এখনো বেশি কারণ অন্যরা আন্দোলনে যোগ দিচ্ছে না। কিন্তু এটি সর্বাংশে সত্য নয়। শাসকরা একে তাদের জনপ্রিয়তার প্রতীক হিসেবে উপস্থাপন করে থাকেন। আসলে তাদের ভিত খুবই দুর্বল।

এই অনুমানমূলক অনুশীলন তুলে ধরার মধ্যে আমার মূল উদ্দেশ্য হলো পদ্ধতিগুলো তুলে ধরা যা কর্তৃত্ববাদী শাসকরা রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন করতে ব্যবহার করে থাকে। আমরা যারা গণতান্ত্রিক চর্চা মূল্যবোধ রক্ষা নিয়ে চিন্তিত, তাদের অবশ্যই একটি কার্যকর সাংবিধানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হতে হবে যা কর্তৃত্ববাদীদের এই ধরনের অপকৌশলের মাধ্যমে শাসনক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে বাধা প্রদান করবে। তাদের উত্থান রোধ করতে হলে প্রথমেই তাদের খেলাগুলো বুঝতে হবে।

স্বত্ব:প্রজেক্ট সিন্ডিকেট

 

কৌশিক বসু: বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ; ভারত সরকারের সাবেক প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং ব্রুকিং ইনস্টিটিউশনের অনাবাসিক জ্যেষ্ঠ ফেলো

ভাষান্তর: তৌফিকুল ইসলাম

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন