হালকা প্রকৌশল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা অনুমোদন

যথাযথ বাস্তবায়নেও জোর দিক শিল্প মন্ত্রণালয়

জাতীয় শিল্প নীতির আলোকে হালকা প্রকৌশল শিল্প উন্নয়ন নীতিমালা ২০২২ অনুমোদন দিয়েছে শিল্প মন্ত্রণালয়। হালকা প্রকৌশল শিল্পের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাও। প্রথমবারের মতো সংশ্লিষ্ট শিল্পের জন্য একটি নীতিমালা তৈরি করা হলো। জাতীয় আয়ে শিল্প খাতের অবদান ৩৭ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশে উন্নীত করার লক্ষ্য অর্জনে হালকা প্রকৌশল শিল্প বড় ভূমিকা রাখতে পারে। এর জন্য অবকাঠামো উন্নয়ন, ইউটিলিটি সেবা নিরবচ্ছিন্নভাবে সরবরাহ, শুল্ককর জটিলতা পরিহার শিল্প পার্ক স্থাপনের মতো উদ্যোগের দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। রফতানি বৃদ্ধি, আমদানির বিকল্প পণ্য উৎপাদনে পর্যাপ্ত সহায়তা ব্যবসায়িক যোগাযোগ বৃদ্ধির জন্য প্রযুক্তিগত সহায়তাও দিতে হবে। শিল্পায়নের জন্য অগ্রাধিকার খাত হিসেবে বিশ্বব্যাপী যে কয়টি সেক্টরকে মূল্যায়ন করা হয়, তার মধ্যে অন্যতম হালকা প্রকৌশল শিল্প। এশিয়ার শিল্পোন্নত দেশ যেমনগণচীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, তাইওয়ান, মালয়েশিয়া, ভারত, পাকিস্তানসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোয় ক্ষুদ্র মাঝারি শিল্পের মাধ্যমে অর্জিত সাফল্যের মূল কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে শিল্প গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। হালকা প্রকৌশল শিল্পকে ঘিরে তাই বাংলাদেশের প্রত্যাশাও অনেক। এর বাস্তব রূপায়ণে নীতিমালার পরিপূর্ণ দ্রুত বাস্তবায়নে জোর দিতে হবে। প্রত্যাশা থাকবে, শিল্প মন্ত্রণালয় নীতিমালা বাস্তবায়নেও কার্যকর ভূমিকা রাখবে।

হালকা প্রকৌশল শিল্পকে শিল্পের প্রাণ হিসেবে অভিহিত করা হয়। খাতের সম্ভাবনা থাকলেও পুঁজি, প্রযুক্তি, প্রশিক্ষণ, পরিকল্পিত শিল্প পার্ক নীতি সহায়তার অভাবে বিশ্ববাজারে ভূমিকা রাখতে পারছে না। সাত ট্রিলিয়ন ডলারের বিশ্ববাজারে বাংলাদেশের অংশ শতাংশেরও কম। তবে স্থানীয়ভাবে এখানে বিনিয়োগ হয়েছে হাজার ৫০০ কোটি ডলারের বেশি। মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) এর অবদান প্রায় শতাংশ। সরকার চেষ্টা করছে হালকা প্রকৌশল শিল্প খাতকে চাঙ্গা করতে। কারণে ২০২০ সালকে হালকা প্রকৌশল শিল্প বর্ষও ঘোষণা করা হয়েছিল। কিন্তু এতে তেমন সুফল আসেনি করোনার প্রভাবে। হালকা প্রকৌশল শিল্পের উৎপাদিত পণ্যের মানোন্নয়ন বিদেশী পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতার জন্য কারখানাগুলোর আধুনিকীকরণ, যুগোপযোগী টেকসই প্রযুক্তির ব্যবহার জরুরি। উৎপাদিত যন্ত্র যন্ত্রাংশের মানোন্নয়নে প্রতিটি ক্ষেত্রে টেকসই প্রযুক্তি জ্ঞানকে বাস্তবে রূপ দিতে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। জেলায় জেলায় টেস্টিং ল্যাব না থাকায় কাঁচামালের প্রকৃত মিশ্রণ তৈরি করা যায় না। মিশ্রণ যথাযথ না হলে উৎপাদনের জীবত্কাল পাওয়া যায় না। উৎপাদন মানসম্মত হতে পারে না। বিক্ষিপ্তভাবে সহযোগিতা কোনো কোনো সময় পাওয়া গেলেও তার ধারাবাহিকতা থাকে না বলে অভিযোগ রয়েছে। খাত বিকাশে সবচেয়ে বড় বাধা কর শুল্ক জটিলতা। আমদানিপণ্যের ওপর কম শুল্ককর স্থানীয় পর্যায়ে উৎপাদনে অধিক শুল্ককর পরিশোধের সমস্যাটি অনেক পুরনো, কিন্তু এর সমাধান মিলছে না। পাশাপাশি কারখানাগুলোয় মানসম্মত পণ্য উৎপাদনের জন্য ধারাবাহিকভাবে এখানে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজন।

উল্লেখ্য, বিশ্বখ্যাত অটোমোবাইল কোম্পানিগুলো নিজেরা গাড়ির বেশির ভাগ যন্ত্রাংশ তৈরি না করে সাব-কন্ট্রাক্টিংয়ের মাধ্যমে ছোট ছোট উৎপাদক দিয়ে তৈরি করে নেয়। এরপর এসব যন্ত্রাংশ সংযোজন করে তৈরি হয় পুরো গাড়ি। পদ্ধতিতে একটি বড় উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে জড়িত থাকে বহু ছোট উৎপাদক। বাংলাদেশে বড় বড় শিল্প গড়ে উঠলেও তার সঙ্গে হালকা প্রকৌশল শিল্পের সংযোগ ঘটেনি। দ্রুতই এদের সংযোগ সাধন প্রয়োজন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে গড়ে ওঠা হালকা প্রকৌশল শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো এখন যেকোনো বিদেশী উন্নত মানের যন্ত্রাংশের সঙ্গে পাল্লা দেয়ার সক্ষমতা অর্জন করেছে।

সরকার উদ্যোগ নিলে বান্ডেল পদ্ধতির মাধ্যমে বিশ্ববাজারে বিশেষ করে জাপান দক্ষিণ কোরিয়ার মতো দেশে খুচরা যন্ত্রাংশ তথা অটোপার্টসের বড় বাজার সৃষ্টি করা সম্ভব। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর মতো প্রতিবেশী মিয়ানমারেও বাংলাদেশের হালকা প্রকৌশল পণ্যের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। প্রয়োজন মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে সুবিধাজনক শুল্ক কাঠামোর আওতায় আনুষ্ঠানিক পথে পণ্য রফতানির সুযোগ সৃষ্টি করা এবং বিদেশী বড় কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক তৈরি করে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া। সম্পর্ক স্থাপন করে দিতে পারলেই হালকা প্রকৌশল শিল্প বিশ্ববাজারে শক্তিশালী রফতানি খাত হিসেবে আবির্ভূত হতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু নগদ সহায়তা নয়, প্রয়োজন বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেয়া। বাংলাদেশের রফতানিযোগ্য পণ্যের তালিকা অত্যন্ত সীমিত এবং সরকার রফতানি বহুমুখীকরণে জোর দিচ্ছে। হালকা প্রকৌশল শিল্প এক্ষেত্রে বড় ভূমিকা রাখতে পারে। একটি দেশের উন্নয়ন কর্মসংস্থান বৃদ্ধির বড় সহজ ক্ষেত্রই হচ্ছে খাত। সবচেয়ে দ্রুত বিকাশমান খাতের উন্নয়নের মাধ্যমেই বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। খাত বিকাশে বাধাগুলো এরই মধ্যে চিহ্নিত। বৈদেশিক বৃহৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান থেকে আমদানি করা পণ্যের সঙ্গে প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজার, মানসম্পন্ন কাঁচামালের অভাব, আমদানি পণ্যের মান যাচাই সুবিধার স্বল্পতা, উৎপাদন প্রক্রিয়া সম্পর্কে সীমিত জ্ঞান, উৎপাদিত পণ্যের গুণগত দৃশ্যমান মানের ঘাটতি লক্ষণীয়। এছাড়া রফতানিযোগ্য পণ্যের মান যাচাই করার জন্য স্বীকৃত গবেষণাগারের অভাব, সুস্থ বিনিয়োগের বিপরীতে বাজারদরের অসংগতি রয়েছে। আছে দক্ষতার অভাব, কেন্দ্রীয় গবেষণা উন্নয়ন ঘাটতিও। এসব সমস্যার সমাধানে ব্যবস্থা নিতে হবে। হালকা প্রকৌশল শিল্পের পুঁজির চ্যালেঞ্জই বড়। এজন্য বিদেশী ব্যাংকগুলো উদ্যোক্তাদের ঋণ দিলেও সেই সুদ যাতে সরকার পরিশোধ করে, তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। এছাড়া দক্ষতার ঘাটতি পূরণে বিদেশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে আসতে হবে। সে সঙ্গে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র কুটির শিল্প করপোরেশনে (বিসিক) নতুন শাখা খোলা দরকার। এতে সহজেই সব ব্যবস্থা নেয়া যাবে। পলিসি সাপোর্ট (নীতি সহায়তা) প্রয়োজন। দেশের শিল্প রফতানি বহুমুখী করতে হলে একটি কর্মপরিকল্পনা প্রয়োজন। এছাড়া সরকারকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে রাজস্বসংক্রান্ত জটিলতাও নিরসন জরুরি। প্রয়োজনে ট্যাক্স হলিডে প্রদানের উদ্যোগও নেয়া যেতে পারে।

শিল্পে পুঁজি, প্রশিক্ষণ প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং এলাকার ঐতিহ্য বিবেচনাপূর্বক শিল্পপার্কের সহায়তা দিয়ে দেশের চাহিদা পূরণ করে বিশ্ববাজারে ভূমিকা রাখার সক্ষমতা বাড়ানো প্রয়োজন। সরকারি নীতির কারণে স্ব-উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কারখানাগুলোর সক্ষমতা দিনে দিনে কমছে। একসময় কারখানাগুলো অনেক ক্যাপিটাল মেশিনারিজ তৈরি করত কিন্তু বর্তমানের কর-ভ্যাট আরোপের কারণে শিল্পমালিকরা সে বিষয়ে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। আমাদের দেশে সর্বত্র বিদেশ থেকে পণ্য ক্রয়ে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা বেশি, তারা কষ্ট করে বানানো কোনো জিনিসে বিন্দুমাত্র আগ্রহী নয়। সবাই বিশ্বাস করে ট্রেডিং ব্যবস্থায় লাভ বেশি, কষ্ট কম। তার প্রতিফলন দেখা যায় সর্বত্র। তাছাড়া দেশে তৈরি মূলধনি যন্ত্র আমদানি করা হলে তাতে মূল্য সংযোজন কর দিতে হয় না অথচ আমাদের কারখানায় তা উৎপাদন করলে মোটা অংকের মূসক দিতে হয়। শুল্কও একই পথে চলেছে। এতে করে প্রয়োজনীয় মেশিন আমদানি বাড়ছে, বিপরীতে আমাদের কারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। মানুষ বেকার হচ্ছে, দারিদ্র্য বাড়ছে, সাধারণের জীবিকা নির্বাহ কঠিন হচ্ছে। সরকার সদিচ্ছা নিয়ে হালকা প্রকৌশল শিল্পকে বিবেচনা করলে, বৈষম্যমূলক নীতি কৌশলমুক্ত হলেই একমাত্র শিল্পের দ্রুত বিকাশ সম্ভব।

বাংলাদেশ ২০৪১ সালে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার দৌড়ে আছে। কিন্তু কৃষি-শিল্প কোনো কিছুকে পেছনে রেখেই উন্নয়ন অগ্রগতি রক্ষা করা যাবে না। দেশে দিনে দিনে কৃষি রুগ্ণ হচ্ছে, শিল্পও যে খুব ভালো আছে এমন দাবি করা যাবে না। অথচ বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় শিল্পায়নের বিকাশের কোনো বিকল্প নেই। তাই দেশের শিল্পায়নের স্বার্থেই হালকা প্রকৌশল শিল্প গুরুত্ব পাওয়ার কথা। দেশে হালকা শিল্প আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠত যদি ফিডার শিল্পের ধারণায় শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব হতো। মূল শিল্পের সহায়ক হিসেবে কাজ করার ফলে অনেকের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে, যা উৎপাদনকে মানসম্মত রেখে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে সহায়ক হবে। সমন্বয়ের অভাবে দেশের শিল্পগুলো লোকসানের দায় ঘাড়ে নিয়ে একের পর এক বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। শিল্পকে লোকসানের হাত থেকে রক্ষার জন্য সংযোগ শিল্পের সংস্কৃতি গড়ে তোলার বিকল্প নেই, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে শিল্প গড়ে তোলার ক্ষেত্রে ভাবনা যুক্ত হলে দেশ উপকৃত হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন