এক বছরে ৩৭ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য বৃদ্ধি রহস্যময়ই থেকে যাচ্ছে

হাছান আদনান

বাংলাদেশ গত অর্থবছরে রেকর্ড ১৪ হাজার ১২৪ কোটি বা ১৪১ বিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক বাণিজ্য করেছে। ২০২০-২১ অর্থবছরের চেয়ে যা প্রায় ৩৭ বিলিয়ন ডলার বেশি। প্রবৃদ্ধি ছাড়িয়ে যায় ৩৫ শতাংশ। রেকর্ড বাণিজ্যকে রহস্যময় আখ্যায়িত করে এর যথার্থতা নিয়ে অর্থনীতিবিদরা প্রশ্নও তুলেছিলেন।

অর্থনীতিবিদদের তোলা প্রশ্নের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য। দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য তথা পণ্য আমদানি-রফতানির প্রায় ৯০ শতাংশই হয় চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দর দিয়ে। সংস্থাটির তথ্যে দেখা যায়, অর্থের দিক দিয়ে বৈদেশিক বাণিজ্যে রেকর্ড প্রবৃদ্ধি হলেও পণ্যে খুব বেশি পরিবর্তন হয়নি। গত অর্থবছরে পণ্য আমদানি রফতানি বেড়েছে শতাংশেরও কম।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের দেয়া তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বন্দরটির মাধ্যমে ১০ কোটি ৭৮ লাখ ৭২ হাজার টন পণ্য আমদানি রফতানি হয়েছে। এর আগের অর্থবছরে হয়েছিল ১০ কোটি ৩৯ লাখ ৫৬ হাজার টন। সে হিসাবে গত অর্থবছরে বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধির হার মাত্র দশমিক ৭৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের মোট আমদানি ব্যয় ছিল ৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারের। আগের অর্থবছরে ছিল ৬৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলার। হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে আমদানি ব্যয় বাড়ে ২৩ দশমিক ৫৭ বিলিয়ন ডলার বা ৩৪ দশমিক ৩৮ শতাংশ। যদিও চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, সময়ে পণ্য আমদানিতে মাত্র দশমিক ৪৩ শতাংশ প্রবৃদ্ধি হয়েছে।

অর্থের পরিমাপে বৈদেশিক বাণিজ্যের রেকর্ড প্রবৃদ্ধি আর পণ্যের পরিমাণ বৃদ্ধির বড় ধরনের অসামঞ্জস্যতা দেশ থেকে অর্থ পাচারের ইঙ্গিত বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, করোনাভাইরাস পরবর্তী বৈশ্বিক অর্থনীতি পুনরুদ্ধার এবং ইউক্রেন যুদ্ধকে ঘিরে বিশ্ববাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। একই সঙ্গে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে পণ্য পরিবহন ব্যয়। তবে পণ্যের দাম পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধিজনিত মূল্যস্ফীতির হারের সঙ্গে বাংলাদেশের বৈদেশিক বাণিজ্যের পরিসংখ্যানে সামঞ্জস্য নেই। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতির গড় ১০ শতাংশের বেশি হয়নি। কিন্তু বাংলাদেশের পণ্য আমদানি-রফতানি প্রবৃদ্ধির হার শতাংশের কম হলেও অর্থের পরিমাপে ওই পণ্যের দাম ৩৫ শতাংশের বেশি বাড়া অস্বাভাবিক। বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বড় অংকের অর্থ পাচারের যে আশঙ্কা করা হচ্ছিল, এটি সেটিরই সাক্ষ্য দিচ্ছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশের মোট আমদানির পরিমাণ ছিল ৬৫ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারের। মূল্যের হিসাবে ওই বছরে আমদানির প্রবৃদ্ধি ছিল ১৯ দশমিক ৭৩ শতাংশ। অন্যদিকে পণ্যের পরিমাণের দিক থেকে ২০২০-২১ অর্থবছরে আমদানি হয়েছে কোটি ৬৫ লাখ ৮৮ হাজার টন। এক্ষেত্রে প্রবৃদ্ধি ছিল ১০ দশমিক ৬৭ শতাংশ। ২০২১-২২ অর্থবছরে পণ্য আমদানি বেড়ে কোটি ৯৯ লাখ হাজার টনে দাঁড়ায়। হিসাবে আগের অর্থবছরের তুলনায় পণ্য আমদানি বাড়ে ৩৩ লাখ ১৫ হাজার টন, প্রবৃদ্ধির হার দশমিক ৭৭ শতাংশ। কিন্তু অর্থের পরিমাপে ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮৯ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছে। সে হিসাবে আমদানি ব্যয় বাড়ে ২৩ দশমিক ৫৬ বিলিয়ন ডলার, প্রবৃদ্ধির হার ৩৫ দশমিক ৯৩ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়। আমদানীকৃত পণ্যের দাম আর পরিমাণের বড় ধরনের অসামঞ্জস্যতা জন্ম দিচ্ছে নানা প্রশ্নের।

অর্থনীতিবিদ . খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মনে করেন, বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল খাদ্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি এবং পরিবহন ব্যয় বেড়ে যাওয়ার বিরূপ প্রভাব দেশের আমদানির ওপর পড়েছে। এক্ষেত্রে কোন পণ্যের দাম বিশ্ববাজারে কত শতাংশ বেড়েছে, সেটি ধরে হিসাব করা যেতে পারে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক বলেনআমদানির ক্ষেত্রে পণ্যের দাম বেশি ধরে দেশ থেকে অর্থ পাচার করা হয়েছে কিনা, সেটিও খতিয়ে দেখা দরকার। বাংলাদেশ ব্যাংকসহ সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষ মিলে বিষয়ে অনুসন্ধান করতে হবে। অর্থের পরিমাণে রফতানি প্রবৃদ্ধি আর রফতানীকৃত পণ্যের মধ্যে যে অসামঞ্জস্য দেখা যাচ্ছে, সেটিও সাংঘর্ষিক। কেননা ব্যবসায়ীরা বলছেন, পণ্য রফতানি করে প্রত্যাশিত দাম পাওয়া যাচ্ছে না।

গত অর্থবছরের প্রথম দুই মাসেও প্রভাব ছিল করোনাভাইরাসের তৃতীয় ঢেউয়ের। সময়ে জনসাধারণের চলাচলে বিধিনিষেধ দিয়েছিল সরকার। ফলে চাপে ছিল দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যও। এর পরও অর্থবছরটিতে আমদানি ইতিহাসের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে যায়, যা দেশের অর্থনীতিতে ৩৩ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি তৈরি করে। অর্থবছর শেষে সরকারের চলতি হিসাবের ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৬৯ বিলিয়ন ডলার। দেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টের (বিওপি) ঘাটতিও দশমিক ৩৮ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে ঠেকে। যদিও ২০২০-২১ অর্থবছর দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার উদ্বৃত্ত ছিল বাংলাদেশের বিওপি। যদিও বিশ্ববাজারে অস্বাভাবিক দর বেড়ে যাওয়া পণ্যগুলো দেশের বিওপিতে ঘাটতি তৈরিতে সামান্যই অবদান রেখেছিল।

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের তথ্য বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বন্দর দিয়ে মোট পণ্য রফতানি হয়েছে ৭৯ লাখ ৬৯ হাজার টন। এক্ষেত্রে রফতানি প্রবৃদ্ধি ছিল দশমিক ১৬ শতাংশ। এর আগের অর্থবছরে মোট ৭৩ লাখ ৬৮ হাজার টন পণ্য রফতানি হয়েছিল। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৪ শতাংশেরও বেশি। অর্থের হিসাবে সময়ে রফতানি হয়েছে ৫২ দশমিক শূন্য বিলিয়ন ডলারের পণ্য। তার আগের অর্থবছরে পণ্য রফতানি হয়েছিল ৩৮ দশমিক ৭৫ বিলিয়ন ডলারের। অর্থাৎ গত অর্থবছরে পণ্য রফতানি লাখ হাজার টন বাড়লেও অর্থ বেড়েছে ১৩ দশমিক ৩২ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি।

দেশের রফতানি বাণিজ্যের ৮২ শতাংশই তৈরি পোশাক খাতের। যন্ত্রপাতি, কাপড়, সুতাসহ খাতের কাঁচামালের বৃহৎ অংশ বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়। সে হিসাবে তৈরি পোশাক খাতের রফতানিকারকদের সবাই বড় মাপের আমদানিকারকও। খাতের ব্যবসায়ীরা বলছেন, এক বছরের বেশি সময় ধরে বিশ্ববাজারে তৈরি পোশাক খাতে প্রতিটি কাঁচামালের দাম বেড়েছে। জাহাজ কনটেইনার সংকটে পণ্যে পরিবহন ব্যয় বেড়েছে তার চেয়েও বেশি। স্বাভাবিক সময়ে তৈরি পোশাক ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ শতাংশ মার্জিন পান। এখন মার্জিন ছাড়াই অনেক পণ্য রফতানি করতে হচ্ছে। গ্রাহক ধরে রাখতে অনেক ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীদের লোকসানও গুনতে হচ্ছে।

বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ পোশাক প্রস্তুতকারক রফতানিকারক সমিতির (বিজিএমইএ) সভাপতি ফারুক হাসান বণিক বার্তাকে বলেন, বিশ্ববাজারে পোশাক খাতের কাঁচামালের দাম ১৫ থেকে ২০ শতাংশ বেড়েছে। পণ্য পরিবহন ব্যয়ও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। কারণে পণ্য উৎপাদন খরচ বেড়ে গিয়েছে। তবে সে হারে রফতানি পণ্যের দাম বাড়েনি। গত অর্থবছরে রফতানি পণ্যের পরিমাণ ১৫ শতাংশের মতো প্রবৃদ্ধি হয়েছে বলে তিনি দাবি করেছেন।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা যদিও বলছেন, গত অর্থবছর দেশে যে পরিমাণ আমদানি এলসি খোলা হয়েছে, সেটি অস্বাভাবিক। অর্থ পাচার বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক বাণিজ্য রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছায় বলে মনে করছেন তারা। তবে নিজেদের নাম উদ্ধৃত করে বিষয়ে কোনো কর্মকর্তাই বক্তব্য দিতে রাজি হননি।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ . মো. হাবিবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, রেকর্ড বৈদেশিক বাণিজ্যের ক্ষেত্রে মূল্যস্ফীতি ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রত্যক্ষ প্রভাব রয়েছে। বিশ্ববাজারে প্রায় প্রতিটি পণ্যের দাম বেড়েছে। তবে সত্যিকার অর্থেই প্রভাব কতটুকু, সেটি গবেষণা করে বের করার উদ্যোগ নিয়েছি। বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে অর্থ পাচার বেড়ে গিয়েছে কিনা, সেটি অবশ্য তথ্যপ্রমাণ ছাড়া বলা সম্ভব নয়। 

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের সদস্য (পরিকল্পনা প্রশাসন) মো. জাফর আলম বলেন, পণ্য আমদানি-রফতানিতে মূল্য কম-বেশি দেখানোর বিষয়টি দেখভালের দায়িত্ব বাংলাদেশ ব্যাংকের। এক্ষেত্রে বন্দর কর্তৃপক্ষের তেমন কিছু করার নেই। আমরা কেবল আমদানি-রফতানি পণ্যের ওজনের হিসাব রাখি। তিনি আরো বলেন, ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বন্দরে পণ্য খালাসের দীর্ঘসূত্রতায় দাম বেড়ে যাওয়ার অভিযোগ করা হয়। বর্তমানে ধরনের কোনো অভিযোগ নেই। যথাসময়ে জাহাজ থেকে পণ্য খালাস কিংবা জাহাজীকরণ করা হচ্ছে। তবে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে বৈশ্বিকভাবে পণ্য পরিবহন ব্যয় বেড়েছে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন