দশ মাসে ১৭ হাজারের বেশি প্রতিবেদন দিয়েছেন ৫০ নিরীক্ষক!

মেহেদী হাসান রাহাত

গত বছরের নভেম্বর থেকে চলতি বছরের আগস্ট পর্যন্ত ৪৩টি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান ১৭ হাজার ৪১টি প্রতিবেদন দিয়েছে। ১০ মাসে এসব নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করেছেন মাত্র ৫০ জন নিরীক্ষক। ফাইন্যান্সিয়াল রিপোর্টিং কাউন্সিলের (এফআরসি) এক পর্যবেক্ষণে তথ্য উঠে এসেছে। গুণগত মান বজায় রেখে উল্লিখিত সময়ে এত বেশিসংখ্যক নিরীক্ষা করা সম্ভব নয় বলে মনে করছে সংস্থাটি। এর পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লিষ্ট নিরীক্ষকদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে দি ইনস্টিটিউট অব চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস অব বাংলাদেশের (আইসিএবি) কাছে চিঠি দিয়েছে এফআরসি।

এফআরসির নির্বাহী পরিচালক মো. সাঈদ আহমেদ স্বাক্ষরিত -সংক্রান্ত চিঠি দেয়া হয়েছে আইসিএবি প্রেসিডেন্টের কাছে। ২২ সেপ্টেম্বর দেয়া চিঠিটির অনুলিপি পাঠানো হয়েছে মহাহিসাব নিরীক্ষক নিয়ন্ত্রক, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগের সিনিয়র সচিব, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব, আইসিএবির কোয়ালিটি অ্যাসুরেন্স বোর্ড (কিউএবি) ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড ডিসিপ্লিনারি কমিটির (আইডিসি) চেয়ারম্যানের কাছেও। চিঠিতে বলা হয়, এফআরসির পক্ষ থেকে নিয়মিতভাবে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর নিরীক্ষা কাজের গুণগত মান পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। গত বছরের ২১ নভেম্বর থেকে পর্যন্ত পর্যবেক্ষণের ভিত্তিতে বিভিন্ন নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের কাজের গুণগত মান প্রশ্নবিদ্ধ বলে এফআরসির কাছে মনে হয়েছে। বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আইসিএবির কাছে ৩৫টি চিঠি পাঠানো হয়। এসব চিঠিতে ৪৩টি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৫০ জন নিরীক্ষকের কাজের গুণগত মান তদন্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করা হয়েছে। পাশাপাশি তদন্ত প্রতিবেদনের অনুলিপি এফআরসির কাছে পাঠানোর অনুরোধ করা হয়।

এর আগে গত ২৯ মে এফআরসিকে দেয়া এক চিঠিতে ৩৯টি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের ৪৫ জন নিরীক্ষকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে অবহিত করে আইসিএবি। ওই সময় পর্যন্ত ৩২টি চিঠি পাওয়ার কথা উল্লেখ করে আইসিএবি জানায়, এর মধ্যে ছয়টি প্রতিষ্ঠানের নয়জন নিরীক্ষকের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ, ২৭ জন নিরীক্ষকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত সম্পন্ন বাকিদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগের তদন্ত চলমান রয়েছে।

বিষয়ে এফআরসি বলছে, বাকি ২৩ জন নিরীক্ষকের বিরুদ্ধে তদন্ত সম্পন্ন হয়েছে কিনা দায়ী নিরীক্ষকদের বিরুদ্ধে কী ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা এখনো জানানো হয়নি। তাছাড়া সংস্থাটির পক্ষ থেকে প্রতিটি তদন্ত প্রতিবেদনের অনুলিপি পাঠানোর অনুরোধ করা হলেও তা দেয়া হয়নি। এতে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর কাজের গুণগত মান -সংক্রান্ত অভিযোগের নিষ্পত্তি সম্পর্কিত তথ্য এফআরসির কাউন্সিলের সভায় উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। অভিযুক্ত নিরীক্ষকদের বিরুদ্ধে অভিযোগের তদন্ত পরিচালনা দায়ী নিরীক্ষকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে কালক্ষেপণের কারণে অন্য নিরীক্ষকরাও একই ধরনের বেআইনি অনৈতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হচ্ছেন বলে এফআরসির কাছে তথ্য রয়েছে।

এফআরসির চিঠিতে আরো বলা হয়েছে, আইসিএবির তৈরি ডকুমেন্ট ভেরিফিকেশন সিস্টেমের (ডিভিএস) তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, এফআরসির পক্ষ থেকে যে ৫০ জন নিরীক্ষকের নিরীক্ষা কাজের ব্যাপারে তদন্ত করার অনুরোধ করা হয়েছিল তারা সম্মিলিতভাবে পর্যন্ত ১৭ হাজার ৪১টি নিরীক্ষা প্রতিবেদন দিয়েছেন। এসব প্রতিবেদনের অধিকাংশই কোনো রকম নিরীক্ষা কাজ না করেই কোম্পানিগুলোর তৈরি করা আর্থিক বিবরণীকে স্বচ্ছ সঠিক বলে প্রত্যয়ন করেছেন নিরীক্ষক। বছরের ৩১ আগস্ট পর্যন্ত ডিবিএসে ৪১ হাজার ৮২টি নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা পড়েছে। প্রায় ৪০০ জন নিরীক্ষক এগুলো নিরীক্ষা করেছেন। এর মধ্যে আলোচ্য ৫০ জন নিরীক্ষক মিলে নিরীক্ষা করেছেন ১৭ হাজার ৪১টি প্রতিবেদন। মোট জমা হওয়া নিরীক্ষা প্রতিবেদনের ৪১ দশমিক ৪৮ শতাংশ নিরীক্ষা করেছেন আলোচ্য ৫০ নিরীক্ষক। অন্যদিকে বাকি ৩৫০ জন নিরীক্ষক মিলে করেছেন ৫৮ দশমিক ৫২ শতাংশ নিরীক্ষা।

গুণগত মানের ব্যত্যয় ঘটিয়ে সম্পন্ন হওয়া এসব নিরীক্ষা প্রতিবেদনের কারণে সরকারের রাজস্ব আহরণ, ব্যাংকের ঋণ ব্যবস্থাপনা, পুঁজিবাজারের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়ার পাশাপাশি পেশাদার নিরীক্ষকদের সুনামও ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মনে করছে এফআরসি। আলোচ্য ৫০ জন নিরীক্ষকের বিষয়ে এফআরসির পক্ষ থেকে যখন আইসিএবির কাছে চিঠি পাঠানো হয়েছিল তখন পর্যন্ত তারা নয় হাজার নিরীক্ষা প্রতিবেদন জমা দিয়েছিলেন। তবে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করে দায়ী নিরীক্ষকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে বিলম্বের কারণে ৫০ জন নিরীক্ষক সময়ে আরো হাজার ৮২০টি নিরীক্ষা প্রতিবেদন প্রদানের সুযোগ পেয়েছেন। এখনো তাদের অনেকেই কোনো ধরনের নিরীক্ষা ছাড়াই প্রতিবেদন দেয়ার কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছেন, যা উদ্বেগজনক বলে মনে করছে এফআরসি। অবস্থায় আলোচ্য ৫০ জন নিরীক্ষকের কাজের গুণগত মানের তদন্ত করে দায়ী নিরীক্ষকদের বিরুদ্ধে আইনানুগ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ এফআরসির কাউন্সিল সভায় উত্থাপনের জন্য তদন্ত প্রতিবেদনের অনুলিপি পাঠাতে আইসিএবিকে অনুরোধ জানিয়েছে সংস্থাটি।

বিষয়ে জানতে চাইলে আইসিএবির প্রেসিডেন্ট মো. শাহাদাত হোসেন বণিক বার্তাকে বলেন, এফআরসির কাছ থেকে যেসব নিরীক্ষকের বিষয়ে চিঠি পাঠানো হয়েছিল, সেগুলোর মধ্যে কিছু তদন্ত করে শাস্তি দেয়া হয়েছে। এছাড়া কিছু অভিযোগের তদন্ত শেষ হয়েছে, আবার কিছু তদন্ত চলমান রয়েছে। আইসিএবি স্বপ্রণোদিত হয়েও সময়ে সময়ে তদন্ত পরিচালনা করে অনেক নিরীক্ষককে শাস্তি দিয়েছে। একটি অভিযোগ এলে সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করে তদন্ত শেষ করে শাস্তি প্রদানে কিছুটা সময় তো লাগবেই।

এফআরসির পক্ষ থেকে যে ৪৩টি নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে হুদা হুসাইন অ্যান্ড কোম্পানি হাজার ৩৪৪টি, মতিন অ্যান্ড কোম্পানি হাজার ২১০টি এবং আনিসুর রহমান অ্যান্ড কোম্পানি হাজার ১১৪টি আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করেছে।

তালিকায় থাকা অন্য নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে মোস্তফা কামাল অ্যান্ড কোম্পানি, হক অ্যান্ড কোম্পানি, শফিক মিজান রহমান অ্যান্ড অগাস্টিন, অমল অ্যান্ড লীনা, কে দেব অ্যান্ড কোম্পানি, আহমেদ জাকের অ্যান্ড কোম্পানি, মোহাম্মদ আতা করিম অ্যান্ড কোম্পানি, সিরাজ খান বসাক অ্যান্ড কোম্পানি, হোসেন দেলোয়ার অ্যান্ড কোম্পানি, রহমান মোস্তাফিজ হক অ্যান্ড কোম্পানি, জি বিশ্বাস অ্যান্ড কোম্পানি, সাহা অ্যান্ড কোম্পানি, মান্নান অ্যান্ড কোম্পানি, টি তালুকদার অ্যান্ড কোম্পানি, মাসুদ আলতাফ অ্যান্ড কোম্পানি, এসএম জাকারিয়া অ্যান্ড কোম্পানি, জি নবী অ্যান্ড কোম্পানি, হাবিব সারোয়ার ভূইয়া অ্যান্ড কোম্পানি, এমআই চৌধুরী অ্যান্ড কোম্পানি, জোহা জামান কবির রশিদ অ্যান্ড কোম্পানি, কাজী জহির খান অ্যান্ড কোম্পানি, এসএইচ খান অ্যান্ড কোম্পানি, রহমান ঠাকুর অ্যান্ড কোম্পানি, এইচএম এনাম অ্যান্ড কোম্পানি, নাসির মোহাম্মদ অ্যান্ড কোম্পানি, এস জাবেদ অ্যান্ড কোম্পানি, শফিক বসাক অ্যান্ড কোম্পানি, এমএআরএইচকে অ্যান্ড কোম্পানি, সাজ্জাদ অ্যান্ড কোম্পানি, রহমান মোস্তাফিজ অ্যান্ড কোম্পানি, এমএন ইসলাম অ্যান্ড কোম্পানি, এন কে রায় অ্যান্ড কোম্পানি, আতিক খালেদ চৌধুরী, টি হোসাইন অ্যান্ড কোম্পানি, সালমা অ্যান্ড কোম্পানি, সাজ্জাদ অ্যান্ড কোম্পানি, আতা খান অ্যান্ড কোম্পানি, আর্টিসান, আশরাফ উদ্দিন অ্যান্ড কোম্পানি এসআর ইসলাম অ্যান্ড কোম্পানি।

বণিক বার্তার অনুসন্ধানে দেখা গিয়েছে, নিরীক্ষা না করেই প্রতিবেদন জমা দেয়ার যে অভিযোগ উঠেছে, সেখানে পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তসহ বেশকিছু বড় গ্রুপ অব কোম্পানিজের আর্থিক প্রতিবেদনও রয়েছে। এর মধ্যে সিটি গ্রুপের প্রতিষ্ঠান সিটি অটো রাইস অ্যান্ড ডাল মিলস লিমিটেডের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করেছেন হুদা হোসাইন অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস। এছাড়া পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রহিমা ফুডসের আর্থিক প্রতিবেদন নিরীক্ষা করেছেন কাজী জহির খান অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস।

নোমান গ্রুপের প্রতিষ্ঠান নোমান হোম টেক্সটাইল মিলস লিমিটেডের আর্থিক প্রতিবেদন মাসুদ আলতাফ অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টস নিরীক্ষা করেছেন। এদিকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কোম্পানির নিরীক্ষা প্রতিবেদন তৈরি করে বিজ্ঞাপন দেয়ার অভিযোগ উঠেছে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। আতা খান অ্যান্ড কোম্পানি চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্টসের কর্মী রাসেল আহমেদ ফেসবুকে কোম্পানি অডিট রিপোর্টের জন্য কল করুন শিরোনামে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন। নিয়েও সংশ্লিষ্টদের মধ্যে আলোচনা-সমালোচনা চলছে।

দেশে পেশাদার নিরীক্ষকদের নিরীক্ষা কাজ পরিচালনার নিরীক্ষা চর্চা সনদ (সিওপি) দিয়ে থাকে আইসিএবি। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রশাসনিক আওতাধীন প্রতিষ্ঠান হিসেবে আইসিএবি কার্যক্রম পরিচালনা করছে। আলোচ্য নিরীক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে আইসিএবিকে পাঠানো চিঠির একটি অনুলিপি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়েও পাঠিয়েছে এফআরসি। বিষয়ে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব তপন কান্তি ঘোষ বণিক বার্তাকে বলেন, এক বছরের নিরীক্ষা প্রতিবেদন হুবহু নকল করে আরেক বছরের প্রতিবেদন বলে চালিয়ে দেয়া, একাধিক আর্থিক প্রতিবেদন তৈরি করা ধরনের অনেক অভিযোগই রয়েছে। বিষয়ে আইসিএবি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেবে। এখন এফআরসি রয়েছে, তারাও বিষয়গুলো দেখবে। সব সংস্থা মিলে ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে কাজ করলে এগুলো অনেকাংশে কমে আসবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন