বয়কটের ডাকে ক্ষতিগ্রস্ত বলিউড

ফিচার ডেস্ক

নয়া দিল্লির ডিলাইট সিনেমা হলে ‘লাল সিং চাড্ডা’

লম্বা দাড়ি, চোখে সুরমা, মুখে খলনায়কের হাসিওম রাউত পরিচালিত আদিপুরুষ সিনেমার টিজারে এমনই দেখা গেল রাবণরূপী সাইফ আলী খানকে। রামায়ণ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমায় ঠিক কী কারণে রাবণের রূপ তা ওম জানাননি। কিন্তু টুইটারে দেখা যাচ্ছে দর্শকরা বিষয়টি লক্ষ করে প্রশ্ন তুলেছেন, রাবণ দেখতে মুসলিমদের মতো কেন হবে? এমনকি হনুমান বা লক্ষ্মণের লুকও রামায়ণের সনাতনী ধারার মতো না। নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন হিন্দুরাই। আলোচনা-সমালোচনার মাধ্যমে তৈরি হচ্ছে ঘৃণা। কয়েক বছর ধরে বিজেপির তৈরি করা জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় রাজনৈতিক অস্থিরতা বলিউডের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়ার এটি আরেকটি উদাহরণ। এমন উদাহরণ আছে আরো।

চলতি বছরের আগস্টে মুক্তি পায় ফরেস্ট গাম্পের হিন্দি রিমেক লাল সিং চাড্ডা। সিনেমাটি মুক্তির এক সপ্তাহ পরে লাখ ৮০ হাজার ফলোয়ারের একটি টুইটার অ্যাকাউন্ট থেকে টুইট করা হয়। হ্যাশট্যাগ দিয়ে টুইটে লেখা ছিল, উর্দুউড ছড়িয়ে পড়ছে। যারা দেশবিরোধী, হিন্দু বিরোধিতাকে সঠিকভাবে সংজ্ঞায়িত করার জন্য এই শব্দটি গ্রহণ করেছেন, তাদের ধন্যবাদ। এখানে আপনাকে ধ্বংস করার জন্য আপনার টাকাই নেয়া হয়। টুইটটি হাজার ৭০০ বারেরও বেশি রিটুইট হয়, লাইক আসে হাজার ৮০০টি।

যারা উর্দুউড শব্দটির সঙ্গে পরিচিত নয়, তাদের জন্য বলে রাখা ভালো, এটি অতিডানপন্থী রাজনীতিবিদ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতিবাচকভাবে জনপ্রিয় শব্দ। বৃহত্তর অর্থে ভারতীয় হলেও পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দু। ফলে এটি মুসলিমদের সঙ্গে সম্পৃক্ত, পাশাপাশি সিনেমাজগেক হিন্দুফোবিক বলে অভিযোগ তুলতে ব্যবহার করা হচ্ছে শব্দটি। বহু বছর ধরেই বলিউড একটি ব্র্যান্ড। ভারতীয়দের পাশাপাশি বহির্বিশ্বেও বলিউডের সিনেমার রয়েছে বিস্তৃত বাজার। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন ভারতীয় জনতা পার্টির অধীনে হিন্দু জাতীয়তাবাদকে বেশি শক্তিশালী করে তোলার প্রচেষ্টার জন্য একটা সাংস্কৃতিক পরিবর্তন করছে দলটি। সে উদ্দেশ্যে প্রভাবিত করা হচ্ছে বলিউডকেও। আশানুরূপ ব্যবসা করতে পারেনি বহু সিনেমা।

সিনেমায় প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের পাশাপাশি প্রযোজনাও করেছেন আমির খান। সিনেমাটি মুক্তির আগেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এর বয়কট চেয়ে দাবির ঢেউ ওঠে। ২০১৫ সালে ভারতে অসহনশীলতা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছিল। সে সময়ে আমির খানের করা একটি মন্তব্য পুনরায় সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঘুরে বেড়াতে দেখা যায়। সেই সঙ্গে পিকে সিনেমার কিছু দৃশ্যও ছড়িয়ে পড়ে সবার হাতে হাতে (যেখানে অন্ধ বিশ্বাসের প্রবল সমালোচনা করা হয়) দুটি মিলিয়ে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিছু টুইট ছড়াতে দেখা যায় ইন্টারনেট দুনিয়ায়। বক্স অফিসে লাল সিং চাড্ডা মুখ থুবড়ে পড়ে।

কেননা এর পরও বয়কটের আহ্বান থেমে যায়নি। বিক্রম ভেদা, দোবারা, শমসেরা, ব্রহ্মাস্ত্রও বয়কটের মুখে পড়ার তালিকায় রয়েছে।

বিজেপির প্রপাগান্ডা হিন্দুত্ববাদ ছড়ানো ইত্যাদি বিষয়ের বিরুদ্ধে অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী সরব। অভিনেত্রী স্বরা ভাস্করের মতে, বলিউড এমন একটি ইন্ডাস্ট্রি, যেখানে মুসলিমদের প্রতিনিধিত্ব সাফল্য রয়েছে। সেটাই মূলত হিন্দুপন্থীদের বিরক্ত করছে। স্বরা নিজেও বারবার ডানপন্থীদের ক্রোধের মুখে পড়েছেন, এমনকি পেয়েছেন হত্যার হুমকিও। তার মতো আরো অনেক অভিনেতা-অভিনেত্রী ক্রমাগত হুমকি পেয়ে যাচ্ছেন।

এছাড়া বিভিন্ন সিনেমা স্ট্রিমিং সিরিজের বিরুদ্ধে পরিকল্পিত ট্রলিং হতেও দেখা যাচ্ছে অনেক সময়। যেমনটি দেখা গিয়েছিল থাপ্পড়, সুইটেবল বয় বা বম্বে বেগমের বিরুদ্ধে। বিশেষ করে শেষের দুটিতে দুই ধর্মের মানুষের রোমান্টিকতা দেখানোয় তা ক্ষোভের মুখে পড়ে। আবার ক্ষমতাসীন বিজেপির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত রাজনীতিবিদ বিশেষ করে নেতা সংসদ সদস্যরা বলিউডের ইকোসিস্টেমকে আরো বেশি বিশ্লেষণ ভেঙে ফেলার আহ্বান জানিয়ে আসছেন। কেউ কেউ তো অভিযোগ তুলছেন আমির খান অর্থ জালিয়াতির সঙ্গে জড়িত এবং লাল সিং চাড্ডা সন্ত্রাসবাদকে মহিমান্বিত করে।

স্ক্রিনরাইটার হুসেইন হায়দরী মনে করেন, এসব প্রচারণা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে মুসলিমবিরোধী অনুভূতিকে হিন্দু নিপীড়ন কমপ্লেক্সকে পূর্ণ করে তুলেছে। ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর জয়জিৎ পাল গবেষক শেরিল আগারওয়ালের একটি গবেষণা বলছে, হ্যাশট্যাগে বয়কট বলিউড দিয়ে যেসব টুইট ছড়িয়ে পড়ছে সেগুলো খুবই পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হচ্ছে। বেশকিছু অজ্ঞাত অ্যাকাউন্ট এসব ঘৃণা, ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে এবং তারাই দক্ষিণ ভারতীয় সিনেমাগুলোকে আরো বেশি ঐতিহ্যবাহী হিসেবে প্রকাশ করছে। আর বলিউডের সিনেমাগুলোকে অধঃপতিত সাংস্কৃতিকভাবে নির্লিপ্ত হিসেবেও উল্লেখ করা হয় এসব টুইটে। লাখ ৬৭ হাজার ৯৯০টি অ্যাকাউন্ট থেকে বলিউডবিরোধী বার্তা ছড়ানো হয়, তার মধ্যে ১২ হাজার ৮৮৯টি অ্যাকাউন্টের কোনো ফলোয়ার নেই। এসব অ্যাকাউন্টের বেশির ভাগই গত বছর খোলা এবং সংঘবদ্ধ আচরণ লক্ষ করা গিয়েছে।

তবে বয়কটের চল ঠিক কতটা কার্যকর হয়েছে তা পরিষ্কার বোঝা যায়নি। ২০২২ সালে এখন পর্যন্ত মুক্তি পাওয়া ২৬টি সিনেমার মধ্যে ২০টিই (৭৭ শতাংশ) ফ্লপ হয়েছে। এসব সিনেমায় বিনিয়োগের অর্ধেক বা তারও বেশি ক্ষতির মুখে পড়েছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বক্স অফিস সংগ্রহের পেছনে কভিড-পরবর্তী সময়ে দর্শকদের অনিচ্ছার চিত্র দেখেন, সময়ে ভারতীয়রা স্ট্রিমিং প্লাটফর্মে বাড়তি আয় নিয়ে গিয়েছেন।

সিনেমা সমালোচক বাণিজ্য বিশ্লেষক তরণ আদর্শ গার্ডিয়ানকে জানান, চলচ্চিত্র প্রদর্শকরা মনে করেন, লাল সিং চাড্ডার ওপর বয়কট প্রচারণার বেশ প্রভাব পড়েছে। কিন্তু তিনি অন্যান্য বিষয় নিয়েও বেশ হতাশা প্রকাশ করেছেন। তার মধ্যে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত লকডাউনের সময়ে বিভিন্ন অনলাইন স্ট্রিমিং প্লাটফর্ম বেড়ে ওঠা একটি কারণ। এর কারণে হলে বসে টাকা দিয়ে সিনেমা দেখার প্রবণতা অনেক কমে গিয়েছে। তাই এখন বড় পর্দার এন্টারটেইনারদের উচিত দর্শকদের আবার সিনেমা হলে ফিরিয়ে আনার জন্য কাজ করা।

 

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন