জাতীয় গ্রিড বিপর্যয়

বিতরণ ও লোড ব্যবস্থাপনা উন্নত করা হোক

বিদ্যুৎ সরবরাহের জাতীয় গ্রিডে বিপর্যয়ের কারণে মঙ্গলবার দেশের প্রায় ৬০ শতাংশ এলাকা বিদ্যুৎহীন হয়ে পড়ে। অবস্থা স্বাভাবিক হতে ১০ ঘণ্টারও বেশি সময় লেগেছে। এতে মানুষের ভোগান্তি, দুর্ভোগের পাশাপাশি ব্যবসা উৎপাদনে মারাত্মক প্রভাব পড়ে। এক মাসের ব্যবধানে এটি দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় গ্রিডে বিদ্যুৎ বিপর্যয়ের ঘটনা। এর আগে গত সেপ্টেম্বর গ্রিড বিপর্যয় হয়েছিল। তখন কুষ্টিয়া, যশোরসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জেলাগুলো প্রায় দেড় ঘণ্টা ছিল বিদ্যুৎহীন। জাতীয় গ্রিডে এমন বিপর্যয় দেশে নতুন নয়, প্রায়ই এমন ঘটছে কিছু সামনে আসছে কিছু আসছে না। বিশেষজ্ঞরা এর জন্য প্রযুক্তিগত অবকাঠামোগত দুর্বলতার পাশাপাশি ব্যবস্থাপনাগত ত্রুটির কথা বলছেন। অভিযোগ রয়েছে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যতটা জোর দেয়া হয়েছে ঠিক ততটা গুরুত্ব দিয়ে বিতরণ ব্যবস্থা উন্নত করা হয়নি। সঞ্চালন লাইন দুর্বল, লোড ব্যবস্থাপনাও উন্নত নয়। ফলে বারবার গ্রিড বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। ২০১৪, ২০১৭ বা ২০২২ সালের ঘটনা দেশের বিদ্যুৎ খাতের জন্য একটি সতর্ক বার্তা, যা আমলে নিয়ে দ্রুতই খাতে প্রয়োজনীয় সংস্কার আনা প্রয়োজন। বিতরণ লোড ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন করতে হবে দ্রুত।

সঞ্চালন লাইনের ফ্রিকোয়েন্সির ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেলে মূলত বিদ্যুতের বিপর্যয় ঘটে। এটি হতে পারে হঠাৎ কোনো এলাকায় চাহিদা খুব বেশি বেড়ে বা কমে গেলে। এছাড়া অন্য কারিগরি কারণেও ফ্রিকোয়েন্সির ভারসাম্য নষ্ট হওয়ার উদাহরণ রয়েছে। গ্রিডে অধিক বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হলে বা হঠাৎ করে জোগানের বিপুল সংকট হলেও জাতীয় গ্রিড বিপর্যয় হতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে ওই গ্রিডে সংযুক্ত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো হঠাৎ করে পরিবর্তিত চাহিদা অনুসারে বিদ্যুৎ সরবরাহে ব্যর্থ হয়ে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যায়। অভিযোগ রয়েছে দেশে বেসরকারি পর্যায়ে স্থাপিত রেন্টাল, কুইক রেন্টাল দীর্ঘমেয়াদের কিছু আইপিপি কেন্দ্রের যন্ত্রপাতি, বিশেষ করে জেনারেটরগুলো মানসম্পন্ন নয়। এছাড়া রেন্টাল, কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো বেজ লোডকেন্দ্র হিসেবে স্থাপন করা হয়নি। এসব কেন্দ্রের কারণেও গ্রিড ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ছে। চাহিদার সঠিক পরিমাণ না জানা থাকায়ও গ্রিড বিপর্যয় ঘটতে পারে। এক্ষেত্রে শুধু সমস্যা চিহ্নিত করার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলে চলবে না, সমস্যা সমাধানেও জোর দিতে হবে। সরকার ডিজিটালাইজেশনের ওপর জোর দিয়ে কর্মপরিকল্পনা সাজিয়েছে। একের পর এক অফিস ডিজিটালাইজেশনের আওতায় আসছে বলে প্রচারও করা হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যুৎ খাতের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে এখনো ম্যানুয়ালি পরিচালিত হওয়া কাম্য নয়। দেশের বিদ্যুতের চাহিদা, উৎপাদন, সঞ্চালন পর্যবেক্ষণ নিয়ন্ত্রণ করে জাতীয় লোড ডেসপাস সেন্টার (এনএলডিসি) প্রতিটি বিদ্যুৎকেন্দ্র দিন-রাত কত ঘণ্টা সচল থাকবে, কখন কত মেগাওয়াট উৎপাদন করবে তাও নির্ধারণ করে এনএলডিসি। আধুনিক সঞ্চালন ব্যবস্থায় এনএলডিসি স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে এসব কাজ করে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে পিছিয়ে।

গ্রিড বিপর্যয়ের কারণ চিহ্নিত করতে তিনটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। হয়তো দ্রুতই তারা একটি প্রতিবেদন জমা দেবে। কিন্তু সেটি কতটা গুরুত্বসহকারে গ্রহণ করা হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে। জাতীয় গ্রিডে মঙ্গলবারের বিপর্যয় ২০১৪ সালের নভেম্বরের মহাবিপর্যয়ের কথা (ব্ল্যাকআউটের ঘটনা) নতুন করে স্মরণ করিয়ে দেয়। সে ঘটনার পরও তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটি বেশকিছু সুপারিশও জমা দিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এর পরও ঝুঁকিমুক্ত হয়নি বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থা। কারিগরি ত্রুটি, দায়িত্ব পালনে সীমাবদ্ধতা এবং নির্দেশ পালনে অবহেলাকে মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেছিল সরকারি তদন্ত কমিটি। প্রতিবেদনে বিদ্যুৎ সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়ন ডিজিটাল করা, কারিগরি সব ব্যবস্থার উন্নয়নসহ ২০ দফা সুপারিশও করা হয়েছিল। তবে আট বছরেও সেসব সুপারিশ কার্যকর হয়নি পুরোপুরি। বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো গুরুত্ব পায়নি সঞ্চালন ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন। এছাড়া অ্যানালগ পদ্ধতিতে লোড ব্যবস্থাপনা ঝুঁকিপূর্ণ করছে জাতীয় গ্রিডকে। ২০১৪ সালের মহাবিপর্যয় থেকে শিক্ষা নেয়নি বিদ্যুৎ বিভাগ। যে কারণে উপেক্ষিতই থেকে গিয়েছে উৎপাদন বিতরণ ব্যবস্থা ঘিরে ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টারের (এনএলডিসি) কারিগরি সমন্বয়ের বিষয়টি।

বিদ্যুৎ ব্যবস্থায় গ্রিড অত্যন্ত স্পর্শকাতর একটি ক্ষেত্র। অতি পুরনো জরাজীর্ণ সঞ্চালন লাইনে যদি তার ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত বিদ্যুৎ সঞ্চালন করা হয়, তাহলে গ্রিডের সার্কিট পুড়ে বিপর্যয় ঘটতে পারে। সঞ্চালন লাইনে যদি ছিদ্র দেখা দেয়, তা থেকে স্পার্ক করে গ্রিড বন্ধ হতে পারে। বিদ্যুৎ সঞ্চালনের ফ্রিকোয়েন্সিতে হেরফের হলেও গ্রিড বন্ধ হতে পারে। এমনকি চালু অবস্থায় সঞ্চালন লাইনে কোনো পাখি বসলে কিংবা গাছ বা গাছের ডালপালা ভেঙে পড়লে অথবা বর্জ্রপাত হলেও গ্রিড বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তবে যেকোনো দেশের জাতীয় গ্রিডের একটি প্রধান অংশ থাকে। তার সঙ্গে যুক্ত থাকে একাধিক আঞ্চলিক গ্রিড। সে বিভক্তিগুলো আবার এক সুতায় গাঁথা থাকে। এর মধ্যে এমন কারিগরি ব্যবস্থা রয়েছে, যাতে জাতীয় গ্রিডের কোনো আঞ্চলিক অংশে উল্লিখিত যেকোনো কারণে কোনো ত্রুটি দেখা দিলে বা বন্ধ হয়ে গেলে সম্পূর্ণ গ্রিড বন্ধ হয় না। বাংলাদেশে এটি কাজ করছে না সমন্বয়হীনতার কারণে।

স্থিতিশীল গ্রিডের জন্য অটোমেশনের কোনো বিকল্প নেই। নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে মানুষের বদলে যত বেশি যান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হবে, গ্রিড ততই স্থিতিশীল হবে। তবে এর জন্য বিপুল পরিমাণ বিনিয়োগ প্রয়োজন। বিদ্যুতের উৎপাদন থেকে সঞ্চালন বিতরণ তিন জায়গাতেই সমান গুরুত্ব দেয়ার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে। দেশে এখন বড় বড় বিদ্যুৎ কেন্দ্র আসছে। পায়রা, রামপাল, মাতারবাড়ী, রূপপুরের সব ইউনিট ২০২৪ ২০২৫ সালের মধ্যে উৎপাদনে চলে আসবে। এর মধ্যেই গ্রিড স্থিতিশীল না করতে পারলে বিপর্যয় আরো বড় হয়ে উঠতে পারে। কোনো কারণে একটি এক হাজার মেগাওয়াটের বিদ্যুৎকেন্দ্র আকস্মিক বন্ধ হয়ে গেলে গ্রিড সংকটে পড়তে পারে দেশ। বিদ্যুতের উৎপাদন থেকে গ্রিড সাবস্টেশনের পৌঁছানো এবং সঞ্চালনের মাধ্যমে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় পৌঁছে দেয়ার সময় সমস্যা সৃষ্টি হয়। উৎপাদন সঞ্চালন ব্যবস্থার গ্রিডের অংশটুকু নিয়ন্ত্রণ করে ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার বা এনএলডিসি। ন্যাশনাল লোড ডেসপাস সেন্টার বিদ্যুতের চাহিদা দেখে কেন্দ্র চালানোর নির্দেশ দেয়। এমনকি কোন কেন্দ্র কত বিদ্যুৎ উৎপাদন করবে তাও ঠিক করে দেয় এনএলডিসি। কাজ স্বয়ংক্রিয় পন্থায় হওয়ার কথা। অভিযোগ রয়েছে, এখানে সেটি অনেক ক্ষেত্রে হয় না। অর্থাৎ এনএলডিসি তাদের কার্যালয়ে বসেই সব বিদ্যুৎকেন্দ্র যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। তারা টেলিফোনে কেন্দ্রগুলোকে কত লোডে চালাতে হবে তা জানায়। আবার কোনো কেন্দ্র বন্ধ করতে হলেও তারা এনএলডিসি থেকে বন্ধ করতে পারে না। কেন্দ্রগুলো বন্ধ করতে হলেও আবার সেই টেলিফোনের ওপারের মানুষের ওপর ভরসা করতে হয়। গ্রিড সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হলে গ্রিডের কোনো একটা লাইন যদি আকস্মিক বন্ধ হয়ে যায় তাহলে সেই পরিমাণ সরবরাহ যেন সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি করা যায়, তার নিশ্চয়তা থাকতে হবে। দেশের বিদ্যুৎ খাত যত দ্রুত স্মার্ট গ্রিডের দিকে যাব ততই সমস্যার সমাধান হবে।

উন্নত বিশ্বেও গ্রিড বিপর্যয় দেখা দেয়। কয়েক দিন আগে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও গ্রিড বিপর্যয় হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে তারা স্বল্প সময়ে সিস্টেম পুনরুদ্ধার করতে পারে। উন্নত বিশ্বে গ্রিডে সমস্যা হলে তার তীব্রতা নিয়ন্ত্রণের প্রযুক্তি রয়েছে। বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে গ্রিডের সঙ্গে এমনভাবে যুক্ত করা হয়, যাতে গ্রিড বন্ধ হলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি গ্রিড থেকে বিযুক্ত হয়ে যাবে। ফলে গ্রিড বন্ধ হলেও কেন্দ্রটি বন্ধ হবে না। গ্রিড মেরামতের সঙ্গে কেন্দ্রটি আবার গ্রিডের সঙ্গে যুক্ত করা যাবে। ব্যবস্থায় প্রাথমিক ব্যয় বেশি। কিন্তু গ্রিডে সমস্যার কারণে বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধ হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থাকে না। বাংলাদেশে ব্যবস্থা নেই। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের গ্রিড ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন প্রয়োজন। একটি ত্রুটির কারণে দেশের বড় অংশ যেন বিদ্যুৎহীন হয়ে না পড়ে, সেটি প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে উৎপাদন, বিতরণ ব্যবহার পর্যায়ে নিবিড় সমন্বয় প্রয়োজন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন