অভিমত

সাফ বিজয়: পুরস্কারের সঙ্গে দরকার অবকাঠামোগত উন্নয়ন

মো. তায়্যিব-উল-ইসলাম সৌরভ

আমাদের মেয়েরা সাফ জয় করেছে তাদের পায়ের জাদুতে। মন্ত্রমুগ্ধের মতো দেখেছে দক্ষিণ এশিয়ার লোক। এয়ারপোর্ট থেকে ছাদখোলা বাসে ফুলের বৃষ্টিস্নাত হয়ে তারা পৌঁছেছিলেন বাফুফে কার্যালয়ে। দেশজুড়ে হইহহুল্লোড় হয়েছে বিস্তর। আনন্দের ফাঁকে অনেকে তুলে এনেছেন নারী ফুটবলারদের বেতন বৈষম্য, তাদের প্রতি সমাজের একশ্রেণীর মানুষের কটু দৃষ্টি আর অবহেলার কথা। যোগ্যতা এবং মেধা থাকা সত্ত্বেও হারিয়ে যাওয়া নারী ফুটবলারদের কথাও উঠে এসেছে। সাফ বিজয়ের ফলেই যে এসব কথা, তা সহজবোধ্য। আমাদের নারী ক্রিকেট দলও এশিয়া কাপ জিতে ছিল ২০১৮ সালে। তখনো পুরুষ আর নারী ক্রিকেট দলের বেতন বৈষম্যের কথা উঠে এসেছিল, এসেছিল নানা প্রতিবন্ধকতার কথা। তবে শেষ কথা, সব প্রতিবন্ধকতা জয় করেই আমাদের নারীরা শিরোপা নিয়ে ঘরে ফিরেছেন।

এসব আলোচনা সবসময়ই স্বাস্থ্যকর, আলোচনার হাত ধরেই আসবে সমতা। তবে বেতন বৈষম্য ক্রীড়াঙ্গনে বৈশ্বিক সমস্যা এবং এটা নতুন নয়। বৈশ্বিক বৈষম্যের অনেক কারণ-ব্যাখ্যা যদিও অনেকে দিয়ে থাকেন, কিন্তু সেসব আসলে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার মতোই। বৈষম্যকে কোনো যুক্তিই বৈধতা দিতে পারে না। 

আমাদের সাফ চ্যাম্পিয়নরা দেশে ফিরেছেন বেশকিছু দিন হয়েছে। বিসিবি, বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট তাদের জন্য পুরস্কারের আয়োজন করেছে। বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও পুরস্কার ঘোষণা করেছে। প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনমাফিক ফুটবলারদের ঘরবাড়ি তৈরি করে দেয়ার নির্দেশ দিয়েছেন, তার পক্ষ থেকেও বড় পুরস্কার আসবে, বলাইবাহুল্য। পুরস্কার সবসময়ই প্রেরণাদায়ক।

পুরস্কার আর উদযাপনে ফুটবলারদের আনন্দেই দিন কাটছে। তবে এখন বোধহয় সময় এসেছে পুরস্কারের গণ্ডি পেরিয়ে আরো বড় পরিসরে কিছু ভাবার। আমাদের ভাবতে হবে ভবিষ্যতের সময় নিয়ে, কীভাবে আরো ভালো করা যায় বা নিদেনপক্ষে কীভাবে সফলতার ধারাবাহিকতা ধরে রাখা যায়। শুধু পুরস্কার দিলেই যে আমরা ভবিষ্যতের ভালো ফুটবলার বা নারী ক্রীড়াবিদ পেয়ে যাব, এমন ভাবার আর জো নেই। পুরস্কার ক্ষণস্থায়ী কিংবা হয়তো যাদের দেয়া হচ্ছে শুধু তাদের জন্যই কাজে লাগছে। কিন্তু এতে করে কি দীর্ঘমেয়াদে আমাদের খুব উপকার হবে? শুধু বেতনের বৈষম্য বা ব্যক্তিগত পুরস্কারের অংক বৃদ্ধিতেই কি আমাদের নারীরা এগিয়ে যেতে পারবে বিশ্বমঞ্চে?

গত ১৫ বছর আগেও যদি কোনো নারী ক্রীড়াবিদের নাম নিতে বলা হতো, বেশির ভাগ লোকই হয়তো কোনো নারী টেনিস খেলোয়াড়ের নাম নিতেন। স্টেফি গ্রাফ, মার্টিনা হিঙ্গিস, সেরেনা উইলিয়ামস, মারিয়া সারাপোভা, এমনকি আমাদের পাশের দেশের সানিয়া মির্জার নামও নিতেন অনেকে। কিন্তু অন্য কোন খেলায়? ১৫ বছর আগের কোনো নারী ফুটবল দলের দুজন সদস্যের নাম বলতে পারেন, এমন লোক হাজারে একটাও পাওয়া যাওয়ার কথা নয়। কিন্তু এর কারণ কী? কারণটা সোজাটেনিস খেলোয়াড়রা নারী-পুরুষভেদে প্রায় সমান গুরুত্ব পেতেন। পত্রিকার পাতায় বড় ছবি আসত আর দুনিয়ার সব সংবাদমাধ্যমে ব্যাপক সংবাদ পরিবেশিত হতো। কিন্তু কেন শুধু টেনিসের ক্ষেত্রেই এতটা গুরুত্ব দেয়া?

সে ১৯৭৩ সাল থেকেই ইউএস ওপেনে পুরুষ আর নারী চ্যাম্পিয়নরা সমান প্রাইজমানি পান। অর্থাৎ তারা ট্রফি আর পুরস্কার পান সমান অর্থমূল্যের। ২০০৭ সালের পর থেকে টেনিসের বড় চারটি ইনভেন্টেই (উইম্বলডন, অস্ট্রেলিয়ান ওপেন, ফ্রেঞ্চ ওপেন এবং ইউএস ওপেন) সমান পরিমাণ প্রাইজমানি পান পুরুষ নারী চ্যাম্পিয়নরা। অন্যদিকে যদিও ব্রাজিল, নরওয়ে বা স্পেনের মতো কিছু দেশ তাদের পুরুষ আর নারী ফুটবল দলের বেতনের পার্থক্য কমিয়ে এনেছে বা সমান করেছে, কিন্তু ফুটবল বিশ্বকাপের জয়ী নারী আর পুরুষের জন্য নির্ধারিত অর্থিক পুরস্কারের পরিমাণটা দুনিয়ার সবচেয়ে বড় আর্থিক বৈষম্যের একটা। কাতার বিশ্বকাপে পুরুষের জন্য বরাদ্দ আছে প্রায় ৪৪০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার কিন্তু ২০২৩ সালে হতে যাওয়া নারীদের ফুটবল বিশ্বকাপের জন্য কুল্লে ৬০ মিলিয়ন। ফারাকটা ৩৮০ মিলিয়নের। তবে ফিফা সেটা কমানোর চেষ্টা করছে, হয়তো আরো ১০-১৫টি বিশ্বকাপের পর তা সমতার জায়গায় পৌঁছাবে। হয়তো!

ফুটবলের ব্যাপক বৈষম্যের প্রচুর সমালচনা হয়েছে, হচ্ছে। সমালোচনার জবাবে অনেকে বলেন, পুরুষের খেলা থেকে আয় বেশি হয়। তবে ভাবনাটা বদলের সময় আমাদের হয়ে গিয়েছে। শুধু আমাদের মেয়েরা জিতেছে সে কারণেই নয়; বরং এখন আমাদের নারীরা সব কাজেই সমানতালে এগিয়ে যাচ্ছেন। মুশকিল হলো নারীরা যে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছেন, সমাজের ভাবনাটা সেই তালে এগুচ্ছে না, ফলে প্রায়ই  নারীদের আগানোর গতি বাধার সম্মুখীন হয়, হচ্ছে। কিন্তু সচেতন নাগরিক হিসেবে, সালমা-সাবিনাদের দেশে, নারী প্রধানমন্ত্রী-স্পিকারের দেশে, নারীদের শেকলবন্দী করার প্রয়াস সফল হতে দেয়া যায় না।  আর এর জন্য প্রয়োজন স্থায়ী এবং টেকসই অবকাঠামো।

ঢাকা শহরে মাঠের সংখ্যা এমনিতেই অনেক কম, তাও যে কয়টা রয়েছে, সবই ছেলে বা পুরুষদের দখলে। সেখানে মেয়ে বা নারীরা খেলাধুলা করবে, এমন ব্যবস্থা নেই বা অপ্রতুল। এমন মাঠ কোথায় যেখানে কোনো বাবা-মা তাদের মেয়েকে খেলতে পাঠাবেন নিশ্চিন্তে? এমন প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা বা সহযোগিতা কী রয়েছে যাতে করে শুধু খেলাধুলার আয়েই একজন নারী সংসার চালাতে পারবেন? এমন নিশ্চয়তা কোথায় যে অবসরের পর তারা নির্ঝঞ্ঝাট জীবন পাবেন? একেবারেই মৌলিক বিষয়গুলোর নিশ্চিত না করে আমরা কতদূর এগুতে পারব?

তাই আমাদের এখন অবকাঠামোগত উন্নয়ন দরকার এবং এখনই সেই সঠিক সময় অবকাঠামোগত উন্নতির কথা ভাবার। যাদের জন্য আমরা ট্রফি ছুঁয়ে দেখতে পারছি, সেই জয়ীদের পুরস্কারের পাশাপাশি ভবিষ্যতের কাণ্ডারি তৈরিতে দিতে হবে উপযুক্ত খেলার পরিবেশ। তাদের যোগ্য করে গড়ে তুলতে মূল্যায়ন করতে হবে গোলাম রব্বানীর মতো কোচদের। খেলাধুলায় আগ্রহ জোগাতে এবং জাগাতে সুষ্ঠু বেতন কাঠামো আর সুন্দর ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা দিতে হবে। আর অবকাঠামোগত এসব উন্নয়ন শুধু সরকারের কাঁধে না চাপিয়ে এগিয়ে আসতে হবে বেসরকারি বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকেও।

টেকসই অবকাঠামোগত উন্নয়নের আর সঠিক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার অভাবে মেধাবী আর যোগ্যদের অতলে হারিয়ে যাওয়ার গল্প তো আমরা কম জানি না।

 

মো. তায়্যিব-উল-ইসলাম সৌরভ: বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন