ডিপো ও রাসায়নিক কারখানার ব্যবস্থাপনা নিয়ে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের উদ্যোগ

বিধিবিধান বাস্তবায়নেও পরিবেশ অধিদপ্তরকে সক্রিয় হতে হবে

বাংলাদেশে শিল্প খাতে ব্যবহূত বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যাল বা রাসায়নিক দ্রব্য উৎপাদন, পরিবহন গুদামজাতকরণের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিবিধান না থাকায় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান তাদের নিজেদের মতো করে নিরাপত্তাপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করে থাকে। কোন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য কীভাবে ব্যবস্থাপনা করতে হবে কিংবা কোথায় কীভাবে সংরক্ষণ করতে হবে, সে সম্পর্কিত সুনির্দিষ্ট কোনো বিধিবিধান না থাকায় প্রায়ই ছোট-বড় দুর্ঘটনা ঘটছে। চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের একটি কনটেইনার ডিপোয় ভয়াবহ বিস্ফোরণে প্রায় অর্ধশত মানুষ নিহত হওয়ার পর রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবস্থাপনা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনার ঝুঁকি নিরসনে ডিপো রাসায়নিক কারখানার ব্যবস্থাপনা নিয়ে মহাপরিকল্পনা প্রণয়নের প্রস্তাব দিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর। বলা হচ্ছে, প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে ডিপোর পরিবেশগত ব্যবস্থাপনা গাইডলাইন এবং কারখানাগুলোর ব্যবস্থাপনা নিয়ে নির্দেশনা দিতে পারবে পরিবেশ অধিদপ্তর। ইতিবাচক উদ্যোগ বটে, কিন্তু শুধু পরিকল্পনা বা নীতিমালা প্রণয়ন করলেই হবে না সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে। অভিজ্ঞতা বলছে অনেক ভালো ভালো আইন নীতিমালাও প্রয়োগের দুর্বলতার কারণে সুফল দিতে পারছে না। রাসায়নিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, সে জন্য তদারকি জোরদার প্রয়োজন। এক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা হয়রানির শিকার না হন, তাও নিশ্চিত করতে হবে।

সবার জন্য প্রযোজ্য হবেএমন কোনো বিধিবিধান বা গাইডলাইন রাসায়নিক দ্রব্যের ক্ষেত্রে নেই। বরং বিভিন্ন জায়গা নিয়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। ফলে রাসায়নিক ব্যবস্থাপনায় সমন্বয়হীনতাও রয়েছে। প্রতিটি কেমিক্যালের সঙ্গেই একটি গাইডলাইন সাঁটানো থাকা দরকার যে, এটিকে কীভাবে হ্যান্ডেল করতে হবে, কোথায়, কীভাবে রাখতে হবে, কিন্তু এগুলো নিশ্চিত করার কোনো প্রক্রিয়া বা নির্দিষ্ট কোনো নিয়ম-কানুন নেই। অর্থাৎ এগুলো বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে ঠিক করে। অপর্যাপ্ত লোকবল নিয়ে সেগুলো মাঝেমধ্যে যাচাই করে থাকে বিস্ফোরক অধিদপ্তর, পরিবেশ অধিদপ্তর কিংবা ধরনের আরো কিছু প্রতিষ্ঠান। বাংলাদেশের শিল্প খাতে যেসব কেমিক্যাল ব্যবহূত হয় সেগুলোর ব্যবস্থাপনার মূল দায়িত্ব বিস্ফোরক অধিদপ্তরের। সরকার ৫৪টি কেমিক্যালকে শিল্প খাতের জন্য প্রয়োজনীয় হিসেবে আমদানির অনুমতি এবং এগুলো আমদানির জন্য লাইসেন্স দিয়ে থাকে বিস্ফোরক অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানগুলো কেমিক্যাল আমদানি করে নিজেদের গুদামে রাখে। তারাও মাঝেমধ্যে ধরনের গুদাম পরিদর্শন করেন। সুনির্দিষ্ট নিয়ম-কানুন না থাকলেও লাইসেন্স দেয়ার সময় পণ্য আমদানির সময় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিস্ফোরক অধিদপ্তর গাইডলাইন দিয়ে থাকি কোথায়, কীভাবে সেগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। তবে বেসরকারি কনটেইনার ডিপোগুলো নিজেদের মতো করেই এসবের ব্যবস্থাপনা করে থাকে। একেক ধরনের কেমিক্যাল একেকভাবে হ্যান্ডেল করতে হয় কিন্তু অনেক ক্ষেত্রেই সেটি ঠিকমতো অনুসরণ করা হয় না। অর্থাৎ কোন কেমিক্যাল কোথায় রাখতে হবে, কোনটির কাছে কোনটি রাখা যাবে না কিংবা গুদামগুলোর প্রকৃতি কেমন হবে বা ভেন্টিলেশন সিস্টেম কেমন হবে সে সম্পর্কিত কোনো নিয়মকানুন নির্দিষ্ট করা নেই। বাংলাদেশে প্রায় সব ধরনের শিল্প খাতেই বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার করা হয়। এর মধ্যে গার্মেন্ট, ওষুধ, অটোমোবাইলস, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, ইলেকট্রনিকসসহ কয়েকটি খাতে রাসায়নিক দ্রব্য বেশি দরকার হয়। বাংলাদেশে বেসরকারি কনটেইনার ডিপো ছাড়াও শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে রাসায়নিক গুদাম আছে। এছাড়া চট্টগ্রাম, মোংলা বন্দর বেনাপোল স্থলবন্দরে রাসায়নিক গুদাম আছে। এর বাইরে নিমতলীসহ কিছু জায়গায় নানা ধরনের শিল্পভিত্তিক রাসায়নিক দ্রব্য বেচাকেনা হয় বলে সেসব এলাকাতেও অনেকে নিজস্ব গুদামে এগুলো সংরক্ষণ করেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সুস্পষ্ট আইন নীতিমালা থাকলেও বাংলাদেশের কনটেইনার ডিপোগুলোয় রাসায়নিক রাখার ব্যাপারে কোনো আইন বা নীতিমালা তৈরি করা হয়নি। শুধু বন্দর কর্তৃপক্ষ মৌখিকভাবে এসব রাসায়নিক ভর্তি কনটেইনার রক্ষণাবেক্ষণের বিষয়ে ডিপো মালিকদের সতর্ক করেছে। যে কারণে ডিপোয় অন্যান্য সাধারণ পণ্যের সঙ্গে রাসায়নিক ভর্তি কনটেইনার একসঙ্গে রাখা হচ্ছে। উন্নত দেশে রাসায়নিক পরিবহন করা গাড়িগুলোয় বিশেষ চিহ্ন বা সতর্কতামূলক বার্তা লেখা থাকে। এমনকি রাসায়নিক বহন করা কনটেইনার বা গাড়ির চালকরা বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হন। বাংলাদেশে এমন কোনো নীতিমালা নেই। বৈধ বা অবৈধ যে পথেই রাসায়নিক আসুক না কেন, কোথায় মজুদ করা হচ্ছে, কারা আনছে, কীভাবে পরিবহন করা হচ্ছে, কী কাজে ব্যবহার করছে, সেটা সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে অবগত হতে হবে। তবে চট্টগ্রাম বন্দর থেকে কেমিক্যাল খালাসের পর এর পরিবহন ব্যবস্থা নিয়ে সরকার বা সংশ্লিষ্ট শিল্প মন্ত্রণালয়কে সতর্ক হওয়া জরুরি। কারণ রাসায়নিকগুলো অনেকটা অনিরাপদ অবস্থায় পরিবহন করা হয়। পরিবহনের একটি নীতিমালা থাকা উচিত। রাসায়নিকগুলো কীভাবে মজুদ করা হচ্ছে, সে বিষয়েও নজরদারি থাকা জরুরি। ঠিক একইভাবে রাসায়নিক কারখানাগুলো নিয়মিত তদারকির আওতায় নিয়ে আসতে হবে।

রাসায়নিক মজুদ কিংবা পরিবহনের ক্ষেত্রে একটি বৈশ্বিক চর্চা হলো এমএসডিএ। সব দেশে এটি অনুসরণ হলেও বাংলাদেশে এটি যথাযথভাবে অনুসরণ করা হয় না। নিরাপত্তা নিশ্চিতের জন্য রাসায়নিক বোঝাই ড্রামগুলোয় সঠিকভাবে ট্যাগিং মার্কিং করা, দাহ্য ক্ষয়কারক হলে সে বিষয়ক সাংকেতিক চিহ্ন দেয়ার পাশাপাশি রাসায়নিক ভর্তি ড্রামগুলো ডিপোয় স্থানান্তরের সময় প্রতিটি রাসায়নিকের এমএসডিএস ডিপোগুলোকে বাধ্যতামূলকভাবে হস্তান্তর করতে হবে। কেননা এমএসডিএসে প্রতিটি রাসায়নিকের বিস্তারিত তথ্য থাকে। যে ডিপো রকম ঝুঁকিপূর্ণ, দাহ্য, দুর্ঘটনাপ্রবণ ক্ষয়কারক রাসায়নিক এবং অন্যান্য দ্রব্য সংরক্ষণ বা কনটেইনার বোঝাই করে, তাদের উচিত সেগুলোর জন্য পৃথক হ্যাজকম জোন (ঝুঁকিপূর্ণ রাসায়নিকের আলাদা এলাকা) তৈরি করা। সেখানে সর্বোচ্চ অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে।

ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক অধিদপ্তর পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংস্থাগুলো নিজেদের মতো কাজ করছে কিন্তু একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া থাকা দরকার যাতে করে প্রতিটি কেমিক্যাল যথাযথভাবে সংরক্ষণ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। বাংলাদেশের শ্রম আইনে শ্রমমন্ত্রীর নেতৃত্বে জাতীয় শিল্প, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা কাউন্সিল গঠনের বিধান আছে যার মূল উদ্দেশ্য শিল্প খাতে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা। তাদের নীতিমালা অনুসরণ করে বেশকিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান নিজেদের মতো করে জাতীয় আন্তর্জাতিক নীতির সঙ্গে মিলিয়ে রাসায়নিক দ্রব্যের বিষয়ে কেমিক্যাল ব্যবস্থাপনাসংক্রান্ত নীতিমালা তৈরি করে। এছাড়া বাংলাদেশ কেমিক্যাল করপোরেশনের একটি রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা আছে। যদিও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এসব ক্ষেত্রে মূলত তাদের বিদেশী ক্রেতাদের চাহিদাকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে ওই অনুযায়ী ব্যবস্থাপনাবিধি তৈরির চেষ্টা করে। তবে কারখানার অভ্যন্তরে অনেক ক্ষেত্রেই এসব নিয়ম-কানুন যথাযথভাবে পালন করা হয় না বলে অভিযোগ আছে। একাধিক প্রতিষ্ঠান রাসায়নিক দ্রব্য ক্রয় ব্যবহারের ক্ষেত্রে কিছু প্রক্রিয়া অনুসরণ করে। এতে কারখানার মধ্যে কেমিক্যাল সরবরাহকারী, ব্যবহারকারী ব্যবহারের সঙ্গে জড়িতদের মধ্যে সমন্বয়ের পাশাপাশি কেমিক্যালের সঠিক ব্যবহারের কথা বলা হয়েছে। কারখানায় কেমিক্যালের ধরন চরিত্র অনুযায়ী সঠিক তাপমাত্রায় আলাদা সংরক্ষণ এবং ক্রেতাদের নিষেধাজ্ঞা আছেএমন কোনো রাসায়নিক দ্রব্য না কেনার কথা বলা হয়েছে। গাইডলাইনে বলা হয়, কেমিক্যালের কনটেইনার বা জারের গায়ে সন্নিবেশিত গাইডলাইন অনুযায়ী সব কেমিক্যাল সংরক্ষণ করতে হবে। সব কেমিক্যাল কম্প্যাটিবিলিটি পৃথক চেম্বারে সংরক্ষণ করতে হবে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিয়মগুলো মানা হয় না।

সীতাকুণ্ড ট্র্যাজেডি আমাদের জন্য ওয়েক আপ কল। কারখানা হোক, ডিপো হোক, বিপজ্জনক রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে যারা কাজ করে, তাদের উচিত সেগুলোর ব্যাপারে ব্যাপকভাবে জনসংযোগ করা। ফায়ার সার্ভিস, বিস্ফোরক পরিদপ্তরসহ তদারকি সংস্থাগুলোকে অংশীদারত্ব সহযোগিতা বাড়াতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকেও আরো সক্রিয় হতে হবে। যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে টক্সিক সাবস্ট্যান্স কন্ট্রোল অ্যাক্ট আছে। এমএসডিএস কোড অনুসরণপূর্বক আমাদেরও ধরনের আইন করতে হবে। একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া থাকা দরকার, যাতে প্রতিটি কেমিক্যাল যথাযথভাবে সংরক্ষণ ব্যবহার নিশ্চিত করা যায়। প্রতিটি রাসায়নিক পরিবহন, মজুদ ব্যবহারের জন্য সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান থাকতে হবে এবং কঠোরভাবে সেগুলোর পরিপালন নিশ্চিত করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন