প্রাপ্তবয়স্ক সবার রক্তের কোলেস্টেরল মেপে দেখা জরুরি

অধ্যাপক ডা. সোহেল রেজা চৌধুরী ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল রিসার্চ ইনস্টিটিউটের রোগতত্ত্ব এবং গবেষণা বিভাগের প্রধান। দীর্ঘদিন ধরে উচ্চরক্তচাপ হূদরোগের গবেষণা এবং অধ্যাপনার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। রক্তে উচ্চ কোলেস্টেরল এর প্রতিরোধ ব্যবস্থা নিয়ে বণিক বার্তার সঙ্গে কথা বলেছেন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মুহাম্মাদ শফিউল্লাহ

উচ্চ কোলেস্টেরল কী?

কোলেস্টেরল মানবদেহের জন্য অত্যাবশকীয় একটি উপাদান। দেহের কোষের গঠন বিভিন্ন হরমোন তৈরিতে কোলেস্টেরল প্রয়োজন হয়। মানবদেহে লিভারে কোলেস্টেরল তৈরি হয়। এছাড়া খাবারের মাধ্যমে আমরা কোলেস্টেরল গ্রহণ করে থাকি। তেলজাতীয় বা চর্বিজাতীয় খাবার বিশেষ করে চর্বিজাতীয় খাবারে স্যাচুরেটেড ফ্যাট যদি বেশি খাওয়া হয় তাহলে আমাদের শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। কোলেস্টেরল মাত্রাতিরিক্ত হয়ে গেলে হূদরোগের ঝুঁকি তৈরি হয়। মানবদেহের রক্তনালিতে চর্বি জমার পেছনে কোলেস্টেরলের ভূমিকা আছে।

কোন কোন রোগ উচ্চ কোলেস্টেরলের সঙ্গে যুক্ত রয়েছে?

রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি হলে ধমনির গায়ে চর্বি জমা হয়। ফলে রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় হূিপণ্ড, মস্তিষ্ক কিডনি। শরীরের এক জায়গার ধমনিতে রক্তপ্রবাহ বন্ধ হলেও অন্য জায়গা থেকে রক্ত আসতে পারে। কিন্তু হূিপণ্ড বা মস্তিষ্কে রকম রক্ত সরবরাহ করার ব্যবস্থা থাকে না। সে কারণে কোনো একটা ধমনি কোলেস্টেরলের কারণে বন্ধ হয়ে গেলে বা রক্ত সরবরাহ বাধাপ্রাপ্ত হলে তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে যায়। ঘটনা হূিপণ্ডে হলে হূদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হবে আর মস্তিষ্কে হলে স্ট্রোক হবে, কিডনিতে হলে কিডনি অকেজো হবে।

উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রার সঙ্গে প্রযুক্তির উত্কর্ষ, নগরায়ণ আমাদের জীবনাচার কতটুকু জড়িত?

শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা নির্ভর করে বেশকিছু চর্বি বা স্নেহ পদার্থের ওপর। আমরা কী পরিমাণ তেল তা স্নেহজাতীয় খাবার খাচ্ছি তার ওপর। হাই ক্যালরি বা চর্বিজাতীয় খাবার খেলে শরীরে চর্বির পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। পরবর্তী সময়ে তা শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে দিতে সহায়তা করে। যারা ধূমপান করেন তাদের মধ্যেও কোলেস্টেরলের মাত্রা বেশি থাকে। আবার শারীরিক কার্যকলাপ কম হলে ভালো কোলেস্টেরলের (এইচডিএলহাই ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন) কমে যায়। আরেকটা হলো এলডিএল (লো ডেনসিটি লাইপোপ্রোটিন) কোলেস্টেরল। এটা সরাসরি হূদরোগের সঙ্গে জড়িত। যা আমাদের দেহের জন্য ক্ষতিকর। এইচডিএল যত ভালো থাকে তত আমাদের হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কম।

উচ্চ কোলেস্টেরলের প্রাদুর্ভাব বৃদ্ধি গত দুই দশকে কেমন পরিলক্ষিত হচ্ছে?

প্রথমত আমাদের জীবনাচারণ পরিবর্তন হয়েছে। খাবারে পরিবর্তন এসেছে। অনেকেই এখন বেশি ক্যালরি গ্রহণ করছে। অনেক ক্ষেত্রে এটি অতিরিক্তও হয়ে হচ্ছে। ক্যালরিটা আসছে চর্বি বা চিনিজাতীয় খাবার থেকে। জাতীয় খাবার খেলে দেহে ওজন বেড়ে যায়। ফলে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ মোটা হয়ে যায়। রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রাও বেড়ে যায়। যারা ধূমপান করে তাদের এইচডিএল কোলেস্টেরল কমে যায়। আবার ওজন বেড়ে গেলেও বা ডায়াবেটিস থাকলেও কোলেস্টেরল বেড়ে যেতে পারে। এসব কারণে আমাদের দেশে দিন দিন উচ্চ কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে। অসংক্রামক রোগ নিয়ে ২০১৮ সালের জরিপে মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল দেখা গিয়েছে। টোটাল কোলেস্টেরল দুইশর ওপরে থাকলে সেটাকে বলা হয় উচ্চ কোলেস্টেরল। সব বয়সের মিলিয়ে প্রায় ২০ শতাংশ মানুষ উচ্চ কোলেস্টেরলে আক্রান্ত। ফলে হূদরোগের ঝুঁকি বাড়ছে।

উচ্চ কোলেস্টেরলের ক্ষেত্রে প্রতিরোধ নাকি চিকিৎসাকে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। কতটুকু প্রতিরোধযোগ্য?

প্রথমত সবাই যেন কোলেস্টেরল কম রাখতে পারি সে জন্য চেষ্টা করতে হবে। এর জন্য ধূমপান বন্ধ রাখতে হবে, অতিরিক্ত ক্যালরিযুক্ত খাবার যেমন চর্বিজাতীয় খাবার কম খাওয়া। আর শারীরিক ক্রিয়াকলাপের মাধ্যমে দেহের ওজনকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে অতিরিক্ত চর্বি যেন শরীরে না জমে। বংশগতির কারণে (জেনেটিক) কোলেস্টেরল জমতে পারে। প্রত্যেক বয়স্ক ব্যক্তিরই কোলেস্টেরল লেভেল কেমন আছে সেটা জানা দরকার।

উচ্চ কোলেস্টেরলের বিষয়ে আমরা বিস্তারিত জানছি না কেন?

দেশের মানুষের মধ্যে খাবারের পরিবর্তন, জীবনাচারের পরিবর্তন হয়েছে গত ২০ বছরে। আগে হূদরোগের কারণ হিসেবে আমরা শুধু উচ্চ রক্তচাপকেই বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকতাম। তখন উচ্চ কোলেস্টেরল বেশি ছিল না। কোলেস্টেরল বেশি থাকলে হূদরোগ হয় তা নিয়ে মানুষের মধ্যে জানাশোনা কম ছিল। সে কারণে কোলেস্টেরল নিয়ে বেশি প্রচারণা প্রয়োজন। জীবনাচারের মধ্যে কোন কাজটা বেশি করলে মানুষ তা কমাতে পারবে সেটা জানানো দরকার। আর মানুষকে স্বাস্থ্যকর খাবার খেতে উৎসাহিত করা দরকার। যেমন ফলমূল, শাকসবজি বেশি। চিনি কম খাওয়া। কিন্তু আমরা যা যা খাচ্ছি তার সবকিছুই উচ্চ ক্যালরি জাতীয় খাবার। ওজন বেড়ে যাওয়ার মতো আমাদের অবস্থা হয়েছে। ফলে কোলেস্টেরলের পরিমাণও বেড়ে যাচ্ছে। সবার স্বাস্থ্যসম্মত জীবনযাপন করা উচিত।

তৃণমূল পর্যায়ে উচ্চ কোলেস্টেরল প্রতিরোধ ব্যবস্থার জন্য আপনার পরামর্শ কী?

কোলেস্টেরল পরীক্ষার জন্য কিছুটা খরচ রয়েছে। সরকারি পর্যায়ে  কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন উপস্বাস্থ্যকেন্দ্র ইউনিয়ন পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে তার সুযোগ কম। সরকারি পর্যায়ে বলা আছে, চল্লিশোর্ধ্ব হলে সে ব্যক্তি সরকারিভাবে কোলেস্টেরল পরীক্ষা করতে পারবে। এখন সব উপজেলায় সুবিধা দেয়া যায়নি। কিছু উপজেলায় করা হয়েছে। আমরা চাচ্ছি যে কারো বয়স চল্লিশের ঊর্ধ্বে হলে সে যেন নিজ উদ্যোগে কোলেস্টেরল পরিমাপ করে নেয়।

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন