সাতসতেরো

বাংলাদেশে ব্যবসায় শিক্ষার ধারা ও চাকরির বাজার

ড. মো. আব্দুল হামিদ

(গতকালের পর)

 

ম্যানেজমেন্ট: আমাদের দেশে বাণিজ্য শিক্ষার আদি বিষয়গুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ম্যানেজমেন্ট আপাতদৃষ্টিতে এটাকে ব্যবসায় শিক্ষার অন্যতম ভিত্তিও বলা যায় তবে বিশেষায়নের যুগে অনেকেই শুধু ম্যানেজমেন্ট পড়তে খুব একটা আগ্রহী হচ্ছে না এর আরেকটি কারণ হলো দেশের সরকারি কলেজগুলো থেকে বিপুলসংখ্যক গ্র্যাজুয়েট বিষয়ে পাস করে প্রতি বছর বের হয় ফলে স্বাতন্ত্র্যের দৃষ্টিকোণ থেকে একটু কম কম মনে হয়

তবে সত্যিকারের কেউ যদি ম্যানেজমেন্ট বুঝে থাকে তবে প্রতিষ্ঠানে তার উন্নতির পথ সুগম হয় কারণ একটা প্রতিষ্ঠানের মূল যে কার্যক্রম তার সব বিষয়ে ম্যানেজমেন্ট কোর্সগুলোয় পড়ানো হয় তাই তারা প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ পদ পর্যন্ত যাওয়ার জন্য যথেষ্ট যোগ্য বলে বিবেচিত হয়

অন্য সব বিবিএ গ্র্যাজুয়েটদের মতো তারা সব ধরনের চাকরিতে আবেদনের সুযোগ পায় পাশাপাশি সরকারি কলেজগুলোয় ব্যাপক পড়ানো হয় ফলে বিসিএস দিয়ে সেগুলোয় শিক্ষক হওয়ার সুযোগ রয়েছে

তবে আজকাল পিওর ম্যানেজমেন্টের বাইরেও বেশকিছু বিভাগের সৃষ্টি হয়েছে যেটা আগেই বলেছি সেগুলো নিয়ে পরবর্তী সময়ে আলোচনা করছি

ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস (এমআইএস): সব বিশ্ববিদ্যালয়ে বিষয়টি পড়ায় না তবে যুগের চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় এমআইএস অফার করছে এটা মূলত তথ্যপ্রযুক্তির সহযোগিতায় ম্যানেজমেন্ট কার্যক্রমকে গতিশীল অধিকতর কার্যকর করার লক্ষ্যে উদ্ভুত বিষয়ের একজন গ্র্যাজুয়েট প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রমকে গতিশীল, অপচয় রোধ এবং উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ভূমিকা রাখে

আমাদের দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলো এখনো গৎবাঁধা পদ্ধতিতে ব্যবস্থাপনা করে থাকে, কিন্তু বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান এবং দেশের নতুন প্রজন্মের প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপারে খুবই সচেতন ফলে তারা এমআইএস বিষয়ে পড়ালেখা করা লোকদের বিশেষ গুরুত্ব দেয় তবে এখানে একটা সমস্যা হলো প্রত্যেক প্রতিষ্ঠানে খুব বেশিসংখ্যক এমন বিশেষায়িত মানুষ দরকার হয় না

আর সত্যিই যারা বিষয়গুলো বোঝে এবং সৃজনশীল কাজ দিয়ে নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে পারে তাদের খুব চাহিদা রয়েছে অনেক বেশি টাকা দিয়েও তাদের হায়ার করার জন্য লোকে পেছনে লেগে থাকে বেতন-ভাতাও অনেক বেশি হয় তাই যাদের বিষয়ে সত্যিকারের প্যাশন রয়েছে তারা এটা পড়তে পারে তবে ওই কাজগুলো ভালো না বাসলে, দীর্ঘমেয়াদে টেনে নেয়া মুশকিল হতে পারে কারণ এখানে ফাঁকি দেয়ার সুযোগ নেই বললেই চলে

হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট: ইদানীং পিওর ম্যানেজমেন্ট না পড়ে এইচআরএম পড়ার প্রবণতা অনেকের মধ্যে লক্ষ করা যাচ্ছে তারা ভাবছে, বিষয় যেহেতু আমাদের দেশে নতুন সেহেতু বুঝি অনেক চাহিদা রয়েছে এবং কর্মক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা পাওয়া যাবে আমার কেন যেন সেটা মনে হয় না

এমনটা মনে হওয়ার কারণ হলো যারা ম্যানেজমেন্ট পড়ে তারাও বিষয়ে কিছুসংখ্যক কোর্স পড়ে থাকে ফলে তাদের কমনসেন্স থাকে পাশাপাশি তারা সামগ্রিক বিষয়গুলো ডিল করে থাকে

সবচেয়ে বড় কথা, প্রতিষ্ঠান যত বড়ই হোক না কেন তার মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনায় খুব বেশি লোক দরকার হয় না মোটামুটি ১০-১২ জনের একটা টিম হলেই যথেষ্ট তাছাড়া এখন এসব কাজে ব্যাপক আউটসোর্সিং করা হয় অর্থাৎ অভিজ্ঞ ব্যক্তি প্রতিষ্ঠানের সাহায্য নেয়া হয় ফলে বিভাগের সাইজ খুব একটা বড় হয় না অথচ সে প্রতিষ্ঠানে মার্কেটিংয়ের জন্য শতসহস্র কর্মীর প্রয়োজন হতে পারে

হসপিটালিটি অ্যান্ড ট্যুরিজম: অনেকেই ভাবে ঘোরাঘুরির মতো পর্যটন বিষয়ে পড়ালেখাও বুঝি খুব মজার! আপাতদৃষ্টিতে ঠিক আছে কারণ দেশ-বিদেশের দর্শনীয় স্থান সম্পর্কে জানা, ঘুরে দেখা, তাদের কাজ সম্পর্কে অবহিত হওয়া বেশ মজাই লাগে, কিন্তু কর্মজীবন মোটেই তেমন নয়

কারণ এর প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো প্রতিদিন নতুন ক্লায়েন্ট আসে ফ্রেশ সার্ভিস পেতে বছরের পর বছর সেটা নিশ্চিত করতে হয় আর খাতে যারা সেবা প্রদান করে তাদের যেহেতু গোটা বছরই এমন সেবা দিতে হয় সেহেতু তাদের কাছে বিষয়টা রুটিন ওয়ার্ক ফলে কর্মীদের দিয়ে প্রতিষ্ঠানের প্রত্যাশা মোতাবেক সেবা আদায় করা মোটেই সহজ নয়

অনার্স-মাস্টার্স সম্পন্ন করে একজন শিক্ষার্থী মোটামুটি এক্সিকিউটিভ লেভেল জব করবে সেখানে কাস্টমারদের চাহিদা কর্মীদের জোগান উভয়ের মধ্যে ব্যালান্স করাটা বেশ কঠিন ব্যাপার এক্সিকিউটিভদের প্রতিনিয়ত এমনসব বিষয় হ্যান্ডল করতে হয় ফলে প্রথম কথা হলো ঘুরে বেড়ানোর মতো মজার চাকরি এটা নয়

তার চেয়ে বড় কথা, আমাদের দেশে খাত এখনো সেভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং এর অধীনে কিছু কিছু শিল্প বিকাশ লাভ করছে যেমন হোটেল-রিসোর্ট, এয়ারলাইনস, লাক্সারিয়াস বাস সার্ভিস ইত্যাদি কিন্তু এর আরো গুরুত্বপূর্ণ অনেক দিকই সেভাবে বিকশিত হয়নি ফলে উদ্যোক্তারা কোনো রকমে জোড়াতালি দিয়ে কাজ সারতে চান তাছাড়া হাতেগোনা কয়েকটি স্পট ছাড়া (কক্সবাজার, সিলেট, সোনারগাঁও) দেশের অন্যান্য অঞ্চলের হোটেল বা পরিবহন ব্যবসাগুলো মৌসুমনির্ভর

তাই মালিকেরা এমন কিছু লোক চান যারা ওই সময়ে সেবা দেবে গোটা বছর খুব দক্ষ লোক দরকার আছে বলে তারা মনে করেন না আরো সুনির্দিষ্ট করে বললে, অ্যাকাডেমিক অঙ্গনে যা পড়ানো হয়, বাস্তবের ব্যবসা সেভাবে চলে না বলে ওই সব ব্যবসায়ীরা বিশ্বাস করেন ফলে তারা অভিজ্ঞদের নিয়োগ দেন শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে খুব একটা মাথা ঘামান না

ফলে বিষয়ে উচ্চশিক্ষিতদের জন্য এখনো কাজের সুযোগ সীমিত বিদেশী বিনিয়োগকারীরা না আসা পর্যন্ত শিক্ষিত লোকদের খাতে ব্যাপক কর্মসংস্থান হওয়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে

ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস: গোটা দুনিয়ার ব্যবসায় কাঠামোয় এত দ্রুত পরিবর্তন আসছে, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ধারণাটি বেশ কনফিউশন ক্রিয়েট করছে এক দেশে পণ্য তৈরি করে অন্য দেশে বিক্রি করলে (আমদানি-রফতানি) তাকে আমরা ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বলতাম, কিন্তু এখন বহু খ্যাতিমান কোম্পানি উৎপাদন প্রক্রিয়ার বিকেন্দ্রীকরণের মাধ্যমে বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে তাহলে তারা কি ইন্টারন্যাশনাল বিজনেসে আছে?

এমন প্রেক্ষাপটেগ্লোবাল বিজনেসকনসেপ্ট বেশি গ্রহণযোগ্য হয়ে উঠছে আমাদের দেশে আগে সবাই কমার্স পড়ত; এখন পড়ে বিজনেস কিন্তু কেন? কারণ কমার্সের আওতায় বহু প্রশ্নের জবাব মেলে না সেই সীমবদ্ধতা কাটাতে ব্যবসা বিষয়ে পড়ালেখা হচ্ছে

ঠিক তেমনিভাবে আমি মনে করি আগামীতে শুধু ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বহু বিষয়ের সুরাহা করতে পারবে না সেক্ষেত্রে গ্লোবাল বিজনেস স্টাডিজ দরকার হবে তাই কয়েক বছর পর এর গ্রহণযোগ্যতা আরো কমতে পারে সেটা মাথায় রেখে বিষয়টি পড়ার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত  

ব্যাংকিং অ্যান্ড ইন্স্যুরেন্স: আমাদের দেশে ব্যাংকিং খাত প্রয়োজনের চেয়ে একটু বেশিই বিকশিত হয়েছে সেটা সুষ্ঠুভাবে হয়েছে কিনা কিংবা এগুলোর ভবিষ্যৎ নিয়ে অনেক প্রশ্ন আছে তার পরও এগুলো দাঁড়িয়ে গেছে, এটা বাস্তবতা ঠিক তার বিপরীত চিত্র বীমা খাতে একটা অতিপ্রয়োজনীয় সম্ভাবনাময় খাত হওয়ার পরও ঠিক সেভাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেনি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতে বীমা সেক্টর বেশ ভালো করছে কিন্তু আমরা পারছি না

তবে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে একসময় বীমা খাতের বিকাশ অবশ্যই হতে হবে পাশাপাশি জীবন বীমা বিষয়ে ব্যক্তি পর্যায়ে এখনো কম সচেতনতা থাকলেও প্রতিষ্ঠান পর্যায়ে বেশ অগ্রগতি হয়েছে তাই আমার মতে, উভয় খাতেরই সমৃদ্ধি হবে তবে উত্থান-পতনের মধ্য দিয়ে স্থিরতা লাভ করবে সে আঙ্গিক থেকে সাবজেক্ট পড়া যেতে পারে তাছাড়া ইসলামী ব্যাংকিং ক্রমে বিকাশ লাভ করছে ফলে যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই হোক ব্যাংক বীমা খাতে আগামীতে দক্ষ শিক্ষিত লোক দরকার হবে

অর্গানাইজেশন স্টাডিজ অ্যান্ড লিডারশিপ: আমাদের সময় এমন কোনো বিভাগ ছিল না হাল আমলে চাহিদা বাস্তবতার আলোকে নতুন বিভাগ খোলা হয়েছে তবে এটাও ম্যানেজমেন্টর এক্সটেনশন বলা যায় কারণ বর্তমান বিশ্বে প্রতিযোগিতার তীব্রতা এত ব্যাপক হয়েছে, সূক্ষ্ম পার্থক্যের জায়গাগুলো খুঁজে বের করা হচ্ছে সেখানে উন্নয়নের জন্য পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে

তাছাড়া অঘোষিতভাবে মার্কিন মডেল বিশ্বব্যাপী চালু থাকায় লিডারশিপের কদর বাড়ছে তাদের ব্যবস্থাপনায় বয়স বা অভিজ্ঞতার চেয়ে লিডারশিপ স্কিলসকে বেশি ফোকাস করা হয় তারা মনে করে এটাই সফল কার্যকর মডেল বিল গেটস, স্টিভ জবস, ওয়ারেন বাফেট, মার্ক জাকারবার্গ, ইলোন মাস্ক, জেফ বেজোসসহ অসংখ্য বিজনেস আইকন তার দৃষ্টান্ত

আমাদের দেশেও এমন অনেক বিজনেস লিডার পেয়েছি যারা বিভিন্ন শিল্পে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছেন স্যামসন এইচ চৌধুরী, আকিজ উদ্দীন, জহুরুল ইসলাম, সালমান এফ রহমান, লতিফুর রহমান, ফজলে হাসান আবেদ, . মুহম্মদ ইউনূস এমন অনেকে দেখিয়েছেন লিডারশিপ যোগ্যতা দিয়ে একটা প্রতিষ্ঠানকে কোন উচ্চতায় নেয়া যায়

এটা আধুনিক যুগোপযোগী তবে আমাদের দেশের ব্যবসায়ীরা সেখানে ফোকাস করার মতো জায়গায় যেতে সময় লাগবে বহুজাতিক বিদেশী কোম্পানিগুলো জায়গা নিয়ে এরই মধ্যে কাজ করছে তাই যারা চ্যালেঞ্জ নিতে প্রস্তুত তারা বিষয়ে পড়তে পারেন

সর্বোপরি কথা হলো, মেজর করার বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আমি নিজে যেমন ফাইন্যান্স অ্যাকাউন্টিং পড়ার সুযোগ পাওয়ার পরও সেগুলো পড়িনি কারণ আমার মনে হয়েছিল, সারা দিন বসে বসে টাকার হিসাব করাএটা কোনো কথা হলো? আমি এমন কাজ সারা জীবন ধরে করতে চাইনি

ঠিক তেমনিভাবে অনেকের পারিবারিক দৃষ্টিভঙ্গি থাকে ভিন্ন রকম বিষয়গুলোও বিবেচনায় নেয়া উচিত সবচেয়ে ভালো হয় পরিচিতদের মধ্যে এমন বিষয়ে কর্মরত আছেন তেমন ব্যক্তির সঙ্গে আলাপ করা যেমন ব্যাংকিং সেক্টরে চাকুরি করেন এমন কোনো আত্মীয় বা পরিজনের সঙ্গে কথা বললে তিনি ওই ইন্ডাস্ট্রির বর্তমান হালচাল এমনকি ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভালো ধারণা দিতে পারবেন

তাছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষকদের সঙ্গে আলাপ করেও মনে জাগা প্রশ্নগুলো করা যেতে পারে এতে সিদ্ধান্ত গ্রহণ সহজ হবে পরিশেষে বলব, আমাদের দেশে শিক্ষার্থীর ভালো বা মন্দ লাগাকে খুব একটা পাত্তা দেয়া হয় না মেজর চয়েসের ক্ষেত্রে কাজটি করা উচিত নয় কারণ তাকেই সেটা পড়তে এবং সারা জীবন তার সঙ্গে চলতে হবে তাই তার পছন্দের দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা দরকার (শেষ)

 

 

. মো. আব্দুল হামিদ: শাহজালাল বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগের শিক্ষক শিক্ষা স্বপ্ন ক্যারিয়ারবইয়ের লেখক

 

 

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন