বিদ্যুতের দাম ১৫-২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তাব

উচ্চ মূল্যস্ফীতির মধ্যে এমন পদক্ষেপ অর্থনীতিতে চাপ আরো বাড়াবে

জ্বালানি তেল প্রাকৃতিক গ্যাসের দাম বাড়ানোর রেশ কাটতে না কাটতে এবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তুতি চলছে। গতকাল বণিক বার্তায় প্রকাশিত সংশ্লিষ্ট প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পাইকারি পর্যায়ে বিদ্যুতের দাম ১৫-২০ শতাংশ বাড়ানোর প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে অনুমোদন পেলে যেকোনো দিন বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির ঘোষণা দেয়া হতে পারে। বিদ্যুতের দাম বাড়ার প্রভাব শুধু বাসাবাড়িতে পড়বে তা নয়, কৃষি শিল্পপণ্যের উৎপাদন খরচও এতে বৃদ্ধি পাবে। সাধারণ মানুষের পাশাপাশি উদ্যোক্তা ব্যবসায়ীরাও বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর উদ্যোগে হতাশার কথা জানিয়েছেন। এমনিতে সামগ্রিক অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে। বেশির ভাগ সূচকই নিম্নগামী। বিশ্ব অর্থনীতিও মন্দার আশঙ্কায়। কমে যাচ্ছে সামগ্রিক চাহিদা। রকম একটা সময়ে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রস্তাব কাম্য হতে পারে না।

বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর সময় প্রশ্ন উঠেছে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো টিকিয়ে রাখার যৌক্তিকতা নিয়েও। ২০০৯-১০ সালে আপাত-সংকট কাটাতে সরকার বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো চালু করেছিল। উৎপাদন ব্যয়ের চেয়ে অনেক বেশি দাম দিয়ে সরকার তাদের কাছ থেকে বিদ্যুৎ কিনেছে। দেশের শিল্প-কারখানা বাঁচিয়ে রাখতে এবং জনজীবনে স্বস্তি ফিরিয়ে আনতে সে সময় কুইক রেন্টালের প্রয়োজনীয়তা ছিল। কিন্তু সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী যেখানে চাহিদার চেয়ে বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উৎপাদন সক্ষমতা বেশি, সেখানে কুইক রেন্টাল কেন্দ্রগুলো টিকিয়ে রাখার কোনো যুক্তি নেই।

বিগত ১২ বছরে বিদ্যুৎ উৎপাদন উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়লেও সাধারণ মানুষকে বেশি দাম দিয়েই বিদ্যুৎ কিনতে হচ্ছে। বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের দাবি, লোকসান কমাতেই বিদ্যুতের দাম বাড়ানো জরুরি হয়ে পড়েছে। সরকার যদি বেশি দামে বিদ্যুৎ কিনে কম দামে গ্রাহকের কাছে বিক্রি করে, সেক্ষেত্রে লোকসান অযৌক্তিক নয়। কিন্তু বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকার সময়ও সেসবের ভাড়া বা ক্যাপাসিটি পেমেন্ট দিতে গিয়ে সরকারের লোকসান কোনোভাবেই যৌক্তিক বলা যায় না। অথচ সরকার বরাবর গ্রাহকের কাছ থেকেই ভর্তুকির টাকা আদায়ের সহজ পথ মূল্যবৃদ্ধিকে বেছে নিচ্ছে, বিকল্প পন্থা গড়ে তোলার কথা ভাবছে না। লক্ষ করা দরকার, সরকার দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে জ্বালানির মূল্য সমন্বয় তহবিল গঠন করছে না। অন্যদিকে বিপিসি তেল বেচে গত কয়েক বছরে ৪০ হাজার কোটি টাকা লাভ করলেও সরকার আইন করে বিপিসিসহ জ্বালানি খাতের সরকারি কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা নিয়ে গেছে। একদিকে, সরকার বাজেট ঘাটতি মেটানোসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় মেটাতে গিয়ে জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, অন্যদিকে দফায় দফায় জ্বালানির দাম বৃদ্ধির চাপে জনগণের নাভিশ্বাস উঠছে। পরিস্থিতির অবসান না হলে দেশের জ্বালানি খাতেরও বিকাশ হবে না আর জনগণের মাথায় জ্বালানির বোঝাও কমবে না।

দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোয় এক ধরনের অর্থনৈতিক রাজনৈতিক অস্থিরতা বিরাজ করছে। নিত্যপণ্যের বাজার অস্থির হওয়ায় দেশেও জনমনে অসন্তোষ বাড়ছে। অবস্থায় সাধারণ মানুষের কষ্ট বাড়ে এমন কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সংশ্লিষ্ট সবার আরো চিন্তাভাবনা করা প্রয়োজন। বর্তমান প্রেক্ষাপট বিবেচনায় তাদের উচিত বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রবণতার বিপরীতে জনসাধারণের স্বস্তির বিষয়টিকে প্রাধান্য দেয়া। যেহেতু নিম্ন মধ্যম আয়ের মানুষ এরই মধ্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য সংগ্রহ করতে হিমশিম খাচ্ছে, অবস্থায় সরকারের উচিত মূল্যস্ফীতি যেন আর না বাড়ে তা নিশ্চিত করা এবং এটাকেই সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার তালিকায় রাখা উচিত। বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর পরিবর্তে সরকারের কাছে আরেকটি বিকল্প আছে। এটা নিয়ে ব্যবসায়ীরা যেমন বলছেন, বিশেষজ্ঞরাও পরামর্শ দিয়েছেন যে বিদ্যুেতর দাম বাড়ানোর পরিবর্তে সরকারের উচিত দ্রুত রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টগুলো বন্ধ করা এবং জ্বালানি বিদ্যুৎ খাতে আমূল পরিবর্তন আনা।

বিপিডিবি বলছে, কতটুকু দাম বাড়ালে জনগণের সহনীয় পর্যায়ে থাকবে সেটি বিবেচনা করা হবে। বিদ্যুতে যে ভর্তুকি দিতে হচ্ছে সেটা কমানো দরকার। বিপিডিবিও বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন বিপিসির মতো লোকসানে চলছে। ফলে সরকারের কাছ থেকে তারা আর ভর্তুকি চাইতে পারছে না। তাই তারা চাইছে দামটা যেন সমন্বয় করা হয়। এক্ষেত্রে মূল সমস্যার সমাধান না করে শুধু ভর্তুকি কমানোর জন্য দাম বাড়ানোর যুক্তি খুব বেশি শক্তিশালী নয়। বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতে কোনো ধরনের সংস্কার বা দুর্বলতা দূর না করে ভর্তুকি বৃদ্ধি বা দাম বৃদ্ধি কোনো সমাধানই বয়ে আনবে না। অর্থনীতির চাপ এতে আরো বাড়বে। বিদ্যুৎ খাতের সিস্টেম লস এবং দুর্নীতি রোধ করতে পারলে বিদ্যুতের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন হয় না বরং কমানো যায়। কিন্তু নিয়ন্ত্রক কিংবা সেবাদানকারী সংস্থা-কোম্পানিগুলো তাতে আগ্রহী না হয়ে সবসময় দাম বৃদ্ধির পথে হাঁটতেই পছন্দ করে। বারবার বিদ্যুতের দাম বাড়ানো নাগরিকদের জীবনযাত্রায় বাড়তি চাপ যোগ করবেএটাই স্বাভাবিক। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধির প্রস্তাব কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। মুহূর্তে বিদ্যুতের দাম বাড়ালে তা হবে আত্মঘাতী।

বিদ্যুতের দাম বাড়লে সব রকম দ্রব্যমূল্য সেবামূল্যের ওপর এর বিরূপ প্রভাব পড়ে। আর শেষ পর্যন্ত তা বহন করতে হয় ভোক্তা সাধারণকে। তাই সাধারণ ভোক্তাদের সামর্থ্য তথা জনস্বার্থ বিবেচনায় নিয়ে বিদ্যুতের দাম কীভাবে সহনীয় পর্যায়ে রাখা যায় তা নিয়ে সরকারকে ভাবতে হবে। একটি গণতান্ত্রিক সরকার বিদ্যুতের মতো জরুরি প্রয়োজনীয় সেবা খাতের ব্যাপারে জনবান্ধব নীতি নিয়ে এগোবেএটাই সবার প্রত্যাশা। রেন্টাল পাওয়ার প্লান্টগুলো দেশের জ্বালানি চাহিদা মেটাতে অকার্যকর এবং এটি রাষ্ট্রীয় কোষাগারের জন্য বিশাল বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর পরিবর্তে আরো দক্ষতা অর্জন করে বিদ্যুৎ উৎপাদনের খরচ কমিয়ে আনা উচিত। এছাড়া বর্তমান জ্বালানি সংকট মোকাবেলায় সরকারের উচিত অবৈধ সংযোগ বন্ধ করা এবং বিদ্যুতের সাশ্রয়ী ব্যবহারের দিকে নজর দেয়া।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন