আলোকপাত

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন থামাতে পুঁজি পাচার নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে

ড. মইনুল ইসলাম

বাংলাদেশে ডলারের দামের উল্লম্ফন কোনোভাবেই থামানো যাচ্ছে না। ২০২২ সালের মার্চে কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম ছিল ৯০ টাকার মতো, গত ১৬ আগস্ট ২০২২ কার্ব মার্কেটে ডলারের দাম পাগলা ঘোড়ার মতো লাফাতে লাফাতে ১২০ টাকায় উঠে গিয়েছিল। তারপর কয়েকটি ব্যাংক এবং মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক সরকারের কঠোর অভিযানের কারণে গত ২২ আগস্ট তা আবার ১০৮ টাকায় নেমে এসেছিল। ১৪ সেপ্টেম্বর ডলারের দাম আবার ১১৯ টাকায় উঠে গিয়েছে। কার্ব মার্কেটের ধরনের বেলাগাম মূল্যবৃদ্ধি থামানোর জন্য প্রাথমিকভাবে ব্যাংকের ট্রেজারি বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশ জারি করেছিল। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে আরো কয়েকটি ব্যাংকের কাছেও তাদের অস্বাভাবিক বৈদেশিক মুদ্রা কেনাবেচা সম্পর্কে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাখ্যা চেয়েছে। উল্লেখিত ব্যাংকগুলো কয়েক মাসে ডলার বাজারে কৃত্রিম জোগান সংকট সৃষ্টি করে ৪০০ শতাংশ পর্যন্ত অবৈধ মুনাফা তুলে নিয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহলের অভিমত। কয়েকটি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানও সিলগালা করে বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে বর্তমানে ২৩৫টি মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানকে সরকার লাইসেন্স দিলেও প্রকৃতপক্ষে প্রায় ৬০০ প্রতিষ্ঠান কার্ব মার্কেটে অবৈধভাবে ডলার কেনাবেচা করছে। মানি এক্সচেঞ্জগুলোর অধিকাংশই সুযোগের অপব্যবহার করে বৈদেশিক মুদ্রা বাজারে কৃত্রিম জোগান-সংকট সৃষ্টি করে ডলারের দামকে ম্যানিপুলেট করে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাগিয়ে নিয়েছে। কিছু মানি এক্সচেঞ্জার হুন্ডির দেশীয় এজেন্ট হিসেবে ভূমিকা পালন করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। ডলার বাজারে বিভিন্ন ব্যাংক মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের পাশাপাশি দেশের বেশ কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যবসায়ী বিভিন্ন ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন পদে অধিষ্ঠিত এবং/অথবা অতীতে কর্মরত বিশিষ্ট ব্যাংকারদের কয়েকজন ডলার বাজারের বর্তমান ফটকাবাজিতে সরাসরি জড়িত হয়ে পড়েছেন বলে অভিযোগ ওঠার পরও বাংলাদেশ ব্যাংক এসব চিহ্নিত ফটকাবাজারির বিরুদ্ধে এখনো কোনো ব্যবস্থা নেয়নি।

ডলার বাজারের বর্তমান বেলাগাম অস্থিরতার পেছনে বড় ভূমিকা পালন করছে দেশ থেকে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় বিদেশে অব্যাহত পুঁজি পাচার। ১১ সেপ্টেম্বর সরকারের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্টের (সিআইডি) বরাত দিয়ে দেশের পত্রপত্রিকায় খবর বেরিয়েছে যে শুধু হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বর্তমানে বছরে ৭৫ হাজার কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। (মানে, সিআইডির দাবি ৭৫ হাজার কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা দেশেই আসছে না। অথচ পরিমাণ টাকা হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচারকারীদের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে বৈদেশিক মুদ্রায় জমা হয়ে যাচ্ছে) এর সঙ্গে আমদানির ওভার ইনভয়েসিং, রফতানির আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রফতানি আয় দেশে ফেরত না আনার মতো সমস্যাগুলো যোগ করলে দেখা যাবে প্রত্যেক বছর কমপক্ষে দেড় লাখ কোটি টাকার সমপরিমাণের বৈদেশিক মুদ্রা থেকে বাংলাদেশ বঞ্চিত হচ্ছে। এর মানে বাংলাদেশ থেকে বছরে কমপক্ষে ১৫/১৬ বিলিয়ন ডলার পুঁজি এখন বিদেশে পাচার হয়ে চলেছে, যার অর্ধেকের মতো পাচার হচ্ছে হুন্ডি প্রক্রিয়ার বেলাগাম বিস্তারের মাধ্যমে। ২০২১-২২ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিট্যান্স গত ২০২০-২১ অর্থবছরের ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলার থেকে ১৫ শতাংশ কমে ২১ দশমিক শন্য বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে, যার প্রধান কারণ ওই বছর হুন্ডি প্রক্রিয়ায় রেমিট্যান্স প্রেরণ আবার চাঙা হওয়া। ২০২০ সালে করোনা মহামারী শুরু হওয়ার পর চাহিদা এবং সরবরাহ উভয় দিক থেকে হুন্ডি ব্যবসা অনেকখানি গুটিয়ে গিয়েছিল, যার সুফল হিসেবে বাংলাদেশ ২০১৯-২০ এবং ২০২০-২১ অর্থবছরে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্সের উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি অর্জনে সমর্থ হয়েছিল। প্রবৃদ্ধির কারণেই ওই দুই অর্থবছরে বাংলাদেশের ব্যালান্স অব পেমেন্টসের কারেন্ট অ্যাকাউন্টে বড়সড় উদ্বৃত্ত হওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দ্রুত বেড়ে গিয়ে ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল।

এরপর শুরু হয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন। ২০২২ সালের ১২ জুলাই রিজার্ভ কমে বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা মোতাবেক ৩৯ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছিল। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ঘোষণা গ্রহণযোগ্য মনে করে না। কারণ, রফতানি উন্নয়ন তহবিল বা এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ড (ইডিএফ) নাম দিয়ে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে সরকারের আদেশে বাংলাদেশ ব্যাংক যে সাড়ে বিলিয়ন ডলারের রিফাইন্যান্সিং স্কিমের অধীনে বিভিন্ন ব্যাংকের মাধ্যমে দেশের প্রভাবশালী রফতানিকারকদের বৈদেশিক মুদ্রায় ঋণ দিয়েছে সেটাকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে অন্তর্ভুক্ত না করতে বলেছে আইএমএফ। তার মানে, বাংলাদেশের প্রকৃত বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তখন ছিল ৩২ দশমিক ২৭ বিলিয়ন ডলার। এলসি ব্যয় পরিশোধ আগস্ট মাসে উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়ে যাওয়ায় বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন সেপ্টেম্বরেও অব্যাহত রয়েছে। এর মানে সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) পাওনা পরিশোধের পর বাংলাদেশ ব্যাংকের ঘোষণা মোতাবেক রিজার্ভ ৩৬ বিলিয়ন ডলারে নেমে এসেছে। (আইএমএফের নির্দেশনা মানলে প্রকৃত রিজার্ভ এখন সাড়ে ২৮ বিলিয়ন ডলার)! ধরনের পতনের ধারা বিপজ্জনক।

বাংলাদেশ ব্যাংক এখন ডলারের দাম নির্ধারণে বাজার ব্যবস্থাকে মেনে নিলেও কার্ব মার্কেটের ডলারের দামের সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক স্বীকৃত হারের ব্যবধান এখনো ১২-১৩ টাকা রয়ে গেছে। তারা নির্দেশ দিয়েছে ১০৬ টাকা দরে ব্যাংকগুলো ডলার কিনবে এবং টাকা দাম বাড়িয়ে ডলার বিক্রয় করবে। কিন্তু দামে ক্রেতারা ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে পারছেন না। এই দুই দামের এত বড় পার্থক্য শুধু হুন্ডি ব্যবস্থাকেই চাঙা করছে, ফলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রবৃদ্ধি শ্লথ হতে বাধ্য। (অর্থমন্ত্রীর মতে দেশের রেমিট্যান্সের ৪৯ শতাংশ এখন হুন্ডি প্রক্রিয়ায় দেশে আসছে। আমার মতে, অধিকাংশ রেমিট্যান্স হুন্ডি ব্যবস্থায় দেশে আসছে)! আমি আবারো বলছি, বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন যে টালমাটাল অবস্থার কাছাকাছি পৌঁছে গেছে সেটার জন্য দায়ী পাঁচটি প্রধান পুঁজি পাচার প্রক্রিয়া: ) আমদানিতে ব্যাপক প্রবৃদ্ধির আড়ালে ওভার ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে বিদেশে পুঁজি পাচার, ) রফতানিতে ব্যাপক আন্ডার ইনভয়েসিং পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার, ) রফতানি আয় দেশে ফেরত না এনে বিদেশে রেখে দিয়ে ওই অর্থ দিয়ে বিদেশে ঘরবাড়ি-ব্যবসা কেনার হিড়িক, ) দেশের ব্যাংকঋণ নিয়ন্ত্রণকারী গোষ্ঠী কর্তৃক হুন্ডিওয়ালাদের ঋণের টাকা প্রদানের মাধ্যমে এর সমপরিমাণ ডলার হুন্ডি প্রক্রিয়ায় বিদেশে পাচার এবং ) সাম্প্রতিককালে চালু করা এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের সাড়ে বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার ঋণ বিদেশে পাচার। (উদাহরণ দেখুন: গত ২০২১-২২ অর্থবছরে তৈরি পোশাক খাতের রফতানিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩৫ দশমিক ৪৭ শতাংশ, অথচ একই সময়ে পোশাক খাতের কাঁচামাল আমদানি বেড়েছে ৫৮ শতাংশেরও বেশি। অতএব খাতের আমদানিতে ব্যাপক ওভারইনভয়েসিং হয়েছে ধরে নেয়াই যায়) তাই পুঁজি পাচারকে বর্তমান পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের প্রধান অগ্রাধিকারে নিয়ে আসতে হবে। সরকারকে মেনে নিতে হবে যে পুঁজি পাচার বর্তমান পর্যায়ে দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যায় পরিণত হয়েছে। বর্তমান সরকারকে অনেকে ব্যবসায়ীদের সরকার আখ্যায়িত করেন। কারণ বর্তমান সংসদের ৬২ দশমিক শতাংশ সদস্য ব্যবসায়ী। অতএব সরকারে আসীন অনেক মন্ত্রী-সংসদ সদস্য-নেতাকর্মী পুঁজি পাচারকারী হলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তাদের আত্মীয়-স্বজন অনেকে পুঁজি পাচারকারীদের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকাটাই স্বাভাবিক। সত্যিকার সমাধান চাইলে প্রথমে সরকারকে আন্তরিকভাবে সমস্যাটিকে স্বীকার করে নিতে হবে।

অর্থমন্ত্রী কি আদৌ তা করছেন? এবারের বাজেটে পাচারকৃত অর্থ দেশে ফেরত আনতে চাইলে মাত্র সাড়ে শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে তা গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার, কিন্তু খবর নিয়ে জানা যাচ্ছে গত আড়াই মাসে কেউ সুবিধা গ্রহণ করেনি। (বর্তমান বাজেটে অর্থমন্ত্রী পাচারকৃত অর্থ ফেরত আনার জন্য যে টোটকা দাওয়াই এর প্রস্তাব করেছেন সেগুলোকে আমি দেশের জনগণের সাথে মশকরা আখ্যায়িত করেছি। আমি বলেছি, তিনি পুরো ব্যাপারটাকে লঘু করার জন্য প্রহসনমূলক পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। বছরের শেষে দেখা যাবে ফলাফল শূন্য) আমদানিতে ওভার ইনভয়েসিং মনিটর করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংককে যে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটি গঠনের পরামর্শ দেয়া হয়েছিল তার কোনো হদিস মিলছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই এবং ইতালিতে আটটি তদন্ত টিম প্রেরণ কিংবা গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করে পুঁজি পাচারকারীদের নাম-ঠিকানা খুঁজে বের করার যে পরামর্শ দিয়েছিলাম সে ব্যাপারেও কোনো নড়াচড়া পরিলক্ষিত হচ্ছে না! এমনকি রফতানি আয় রফতানিকারকদের নিজের কাছে রেখে দেয়ার পরিমাণকে (অনুপাতকে) আগামী কিছুদিনের জন্য কঠোরভাবে সীমিত করা এবং একই সঙ্গে কতদিনের মধ্যে রফতানি আয় বাংলাদেশ ব্যাংকে বাধ্যতামূলকভাবে জমা দিতে হবে সে সময়সীমাকে নামিয়ে আনা সম্পর্কিত পরামর্শকেও বিবেচনায় নেয়া হচ্ছে না। অথচ, সরকার স্বীকার না করলেও ওয়াকিবহাল মহল ঠিকই বুঝতে পেরেছে গত এক বছরে বাংলাদেশের মুদ্রা টাকার বৈদেশিক মান প্রায় ২৩ শতাংশ অবচয়নের শিকার হয়েছে। এশিয়ার বর্ধনশীল অর্থনীতিগুলোর তুলনায় এই অবচয়ন সর্বোচ্চ। (ভিয়েতনামের মুদ্রার তেমন কোনো অবচয়নই হয়নি) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারাকে থামাতে না পারলে কার্ব মার্কেটে ডলারের দামের উল্লম্ফন এবং টাকার বৈদেশিক মানের দ্রুত অবচয়নকে থামানো যাবে না। আর এজন্য প্রয়োজন পুঁজিপাচারের বিরুদ্ধে সরকারের বিশ্বাসযোগ্য কার্যকর প্রতিরোধ গড়ে তোলা। সময় থাকতে কঠোরভাবে পুঁজি পাচার বন্ধ করতে হবে।

 

. মইনুল ইসলাম: সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি, একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর, অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন