অভিমত

পাহাড়েও ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের অমিত সম্ভাবনা

মোহাম্মাদ রুহুল আমিন

২০২১ সালে দেশের ১৬৭টি চা বাগান এবং ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান থেকে মোট ৯৬ দশমিক ৫০৬ মিলিয়ন কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলে সমতলের চা বাগান ক্ষুদ্র চা চাষ থেকে ২০২১ সালে ১৪ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন কেজি চা জাতীয় উৎপাদনে যুক্ত হয়েছে। উত্তরাঞ্চলের ১৪ দশমিক ৫৪ মিলিয়ন কেজি চায়ের মধ্যে ১২ দশমিক ৯৯ মিলিয়ন কেজি চা এসেছে ক্ষুদ্রায়তন চা বাগান থেকে। উত্তরাঞ্চলের মোট চা চাষের জমির পরিমাণ ১১ হাজার ৪৩৪ একর, এর মধ্যে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষের আওতায় মোট ৯৭২১ দশমিক ২৭ একর জমি রয়েছে অর্থাৎ উত্তরাঞ্চলের মোট উৎপাদনের ৮৫ শতাংশই এসেছে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষাবাদ থেকে। বাংলাদেশে বৃহদায়তনের চা বাগান প্রতিষ্ঠার জন্য প্রয়োজনীয় বৃহদায়তনের জমির প্রাপ্যতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে। ফলে দেশের উপযুক্ত অঞ্চলে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষাবাদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করা অপরিহার্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ড প্রণীত উন্নয়নের পথ নকশা তথ্যানুসারে ২০ একরের কম জমিতে চা চাষাবাদ করা হলে তাকে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্যানুসারে একরের ওপরে এবং ২০ একরের নিচে চা চাষাবাদ হলে তাকে ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ এবং একরের নিচে চা আবাদ করলে তাকে ক্ষুদ্র চা উৎপাদনকারী বলা হয়েছে। ২০ একর বা তার ঊর্ধ্বে হলে তাকে চা বাগান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। প্রধান চা উৎপাদনকারী দেশগুলোয় ক্ষুদ্রায়তন চা চাষাবাদ ক্রমবর্ধমান হারে অধিকতর জনপ্রিয় টেকসই চা চাষ পদ্ধতি হিসেবে পরিগণিত হচ্ছে। চাষাবাদ প্রক্রিয়ায় শ্রমিক সমস্যা কম, উৎপাদন খরচ সীমিত, উৎপাদনশীলতা লাভ বেশি। ২০১৭ সালে চা বোর্ড প্রণীত উন্নয়নের পথ নকশায় বিশ্বের চা উৎপাদনকারী কয়েকটি দেশের ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানের তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। সেখানে দেখা যায়, দক্ষিণ ভারতে ৪৭ হাজার ৫০০ ক্ষুদ্রায়তন চা উৎপাদনকারীর আওতায় মোট ২৩ হাজার হেক্টর চা চাষের জমি রয়েছে। দক্ষিণ ভারতে উৎপাদিত মোট চায়ের ৪২ শতাংশ উৎপাদন হয় ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ থেকে। শ্রীলংকায় চা চাষের আওতায় লাখ ৮৭ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে। এর মধ্যে ক্ষুদ্রায়তন চা উৎপাদনকারীদের আওতায় ৮৪ হাজার ১৫০ হেক্টর জমি আছে যা মোট জমির ৪২ শতাংশ এবং জাতীয় উৎপাদনের ৬০ শতাংশ পদ্ধতিতে উৎপাদিত হয়। কেনিয়ায়  লাখ ১২ হাজার ৭০০ ক্ষুদ্রায়তন চা উৎপাদনকারীর আওতায় মোট ৪৭ হাজার হেক্টর জমি রয়েছে। তারা কেনিয়ার মোট চা উৎপাদনের ৫৬ শতাংশ উৎপাদন করে থাকেন।

বাংলাদেশ চা বোর্ড ২০০২ সালে একটি সমন্বিত উপযোগিতা সমীক্ষা পরিচালনা করে। চা চাষের সব উপযোগিতার পরিমাপক পরীক্ষার পর সমীক্ষায় তিনটি পার্বত্য জেলার ৪৬ হাজার ৮৭৫ হেক্টর ক্ষুদ্রায়তন চা চাষাবাদ সম্প্রসারণ করা সম্ভব মর্মে মতামত ব্যক্ত করা হয়। সমীক্ষা প্রতিবেদনে আরো উল্লেখ করা হয়, ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রারণের মাধ্যমে এসব এলাকায় উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টির যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ক্ষুদ্রায়তন চা চাষ সম্প্রসারণের সম্ভাবনার বিষয় বিবেচনা করে বাংলাদেশ চা বোর্ড বান্দরবান পার্বত্য জেলায় চা আবাদ সম্প্রসারণের উদ্যোগ গ্রহণ করে। প্রথম পর্যায়ে মোট ১০ কোটি ২৯ লাখ ৩৩ হাজার টাকা ব্যয়ে আগস্ট ২০০৩ থেকে জুলাই ২০১৫ মেয়াদে ‘Small Holding Tea Cultivation in Chittagong Hill Tracts’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় বান্দরবান পার্বত্য জেলায় ১১৮ হেক্টর জমিতে চা আবাদ সম্প্রসারণ করে। এরপর দ্বিতীয় দফায় সদর, রুমা এবং রোয়াংছড়ি উপজেলায় চা চাষ সম্প্রসারণের উদ্যোগ নেয় বাংলাদেশ চা বোর্ড। বর্ণিত উপজেলাগুলোর ২০০ হেক্টর জমিতে চা চাষ সম্প্রসারণে প্রায় ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘‘Extention of small holding tea cultivation in hill tracts” শীর্ষক একটি প্রকল্প গ্রহণ করে বাংলাদেশ চা বোর্ড যেটা এখনো চলমান। প্রকল্পটি  শুরু হয়েছিল ২০১৬ সালের জানুয়ারি এবং শেষ হবে আগামী বছরের (২০২৩) ডিসেম্বরে। এখন পর্যন্ত (জুন ২২) প্রকল্পের ভৌত অগ্রগতি ৮৬ দশমিক ২১ শতাংশ। প্রকল্পের আওতায় পর্যন্ত ১১ দশমিক ৮০ লাখ চা চারা উৎপাদন করা হয়েছে। যার মধ্যে দশমিক ৩৬ লাখ চারা এরই মধ্যে বিতরণ এবং ১৪০ হেক্টর জমিতে চা আবাদ সম্প্রসারিত হয়েছে। 

প্রকল্পের আওতায় গৃহীত নানা কার্যক্রমের ফলে বান্দরবান জেলায় চা চাষের নতুন সম্ভাবনা হাতছানি দিচ্ছে। ২০১৮ সালে বান্দরবান জেলায় মোট উৎপাদিত সবুজ চা পাতার পরিমাণ ছিল ৯২১১ কেজি, সেই পরিমাণ বেড়ে ২০২১ সালে দাঁড়িয়েছে ৩২ হাজার ১৫৭ কেজি। একসময় উৎপাদিত সবুজ পাতা চাষীরা বান্দরবান থেকে চট্টগ্রামের চা বাগানে বিক্রি করতেন। চা চাষীদের অসুবিধা দূরীকরণে এবং চা চাষীদের উৎসাহিত করতে চা বোর্ড নিজস্ব অর্থায়নে বান্দরবানে প্রায় পৌনে কোটি টাকা ব্যয়ে একটি চা কারখানা স্থাপন করেছে। এছাড়া ক্ষুদ্রায়তন চা উৎপাদনকারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে Common Fund for Commodities প্রকল্পের অর্থায়নে পার্বত্য বান্দরবান চা চাষী কল্যাণ সমবায় সমিতি লিঃকে একটি লাইট ট্রাক প্রদান করা হয়েছে। ফলে বান্দরবানের ক্ষুদ্রায়তন চা বাগানে উৎপাদিত পাতা বান্দরবানের কারখানাই প্রক্রিয়াজাত হয়ে চা উৎপাদিত হচ্ছে। ফলে চা চাষীরা আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছেন। বিভিন্ন ক্ষুদ্রায়তন বাগানের চাষীরা কাঁচা পাতা সংগ্রহ করে কারখানায় নিয়ে আসেন। বান্দরবান চা চাষী কল্যাণ সমবায়  সমিতি লিঃ প্রতি কেজি সবুজ পাতা ২৮ টাকা দরে  কিনে নেয়। পরে ওই পাতা কারখানায় প্রক্রিয়া শেষে উৎপাদিত চা  বিক্রি করা হয়। কারখানা স্থাপনের পর ২০১৯, ২০ এবং ২১ সালে যথাক্রমে ৬৪০, হাজার ৮৪৫ এবং হাজার ৭৮০ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। ২০২২ সালে বান্দরবানে চায়ের উৎপাদন বিগত বছরের উৎপাদনকে ছাড়িয়ে যাবে, সে সম্ভাবনাও দেখা যাচ্ছে।

তিন পার্বত্য জেলায় চা চাষের সম্ভাবনা ক্রমে বাড়ছে, দেখাচ্ছে আশার আলো। দীর্ঘ সময় পাহাড়ের শুধু রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার কাপ্তাই উপজেলায় চা চাষ হয়ে আসছিল। কাপ্তাই উপজেলার ওয়াজ্ঞাছড়া নামের চা বাগানটিই ছিল পাহাড়ের একমাত্র চা বাগান। ১৮৬৫ সালে ব্রিটিশরা বাগানের গোড়াপত্তন করেন। এরপর চারবার হাতবদলের পর বাগানটি বর্তমান মালিকানায় পরিচালিত হচ্ছে। তারা ১৯৮২ সাল থেকে বাগানটি পরিচালনা করে আসছে। ৭৬০ দশমিক ৯৯ একর আয়তনের চা বাগানের প্রায় ৪০৩ দশমিক ৯৭ একর জমিতে বর্তমানে চা চাষ রয়েছে, ২০২১ সালে বাগানটিতে হাজার ৩০৯ কেজি চা উৎপাদিত হয়েছে। সুদীর্ঘ দিন পর ওয়াজ্ঞাছড়ার পর রাঙ্গামাটি জেলার বাঘাইছড়িতেও চা চাষ কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ২০১৮ সালে বাংলাদেশ চা বোর্ডের নিবন্ধন নিয়ে ৩৩ দশমিক ৯৫ একর জমিতে খেদারমারা চা বাগান নামে আরেকটি বাগান চা আবাদ কার্যক্রম শুরু করছে। চা বোর্ডের তথ্য মতে, ২০২০-২১ সালে বাগানটি যথাক্রমে হাজার ৮৫৯ এবং হাজার ৮৬৪ কেজি চা উৎপাদন করেছে। বাগানটি তাদের চা আবাদ সম্প্রসারণ কার্যক্রম চলমান রেখেছে।

১৮৭০ সালে রাঙ্গামাটির কাপ্তাই উপজেলা আর চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সীমানায় আগুনিয়া চা বাগান সৃজন করেছে ব্রিটিশরা। দুই উপজেলার সীমানায় কোদালা চা বাগান নামে আরো একটা বাগান রয়েছে। এছাড়া চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার অনেক বাগানের সঙ্গেই রয়েছে খাগড়াছড়ি পার্বত্য জেলার সীমানা। খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলায়ও চা আবাদ শুরু হয়েছে। তিনটহরী টি এস্টেট নামের একটি চা বাগানও আছে মানিকছড়ি উপজেলায়। তিনটহরী চা বাগানটি ২০১৬ সাল চা আবাদ শুরু করে। বর্তমানে ওই বাগানের ৪১ একর জমি চা চাষের আওতায় এসেছে। দেশের সর্ব উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের সমতল ভূমিতে চা চাষ দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। চট্টগ্রাম সিলেট অঞ্চলের পর তৃতীয় বৃহত্তম চা অঞ্চল হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে পঞ্চগড়। পঞ্চগড়কে অনুসরণ করে চা চাষে এগিয়ে যাচ্ছে পাশের ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, নীলফামারী লালমনিরহাট জেলা। চা বোর্ড পরিচালিত সমীক্ষা অনুযায়ী উত্তরাঞ্চলের মতো পার্বত্য চট্টগ্রামের তিন জেলা রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি এবং বান্দরবানেও রয়েছে চা চাষের অমিত সম্ভাবনা। সম্ভাবনা কাজে লাগাতে পারলে আরো এগিয়ে যাবে দেশের চা শিল্প।

 

মোহাম্মাদ রুহুল আমিন: সচিব, বাংলাদেশ, চা বোর্ড

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন