স্কুল বন্ধে প্রাথমিক জ্ঞান ও মৌলিক দক্ষতা হারিয়েছে শিশুরা

শিক্ষণ ঘাটতি পূরণে কার্যকর উদ্যোগ নিক শিক্ষা মন্ত্রণালয়

অতিমারীর সব ক্ষতি সমান মাপের নয়। অর্থ ব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছিল, তা পূরণ হওয়ার ইঙ্গিত দেখা যাচ্ছে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ক্ষতিও কাল না হোক পরশুর পরের দিন বহুলাংশে পুষিয়ে যাবে। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে যে ক্ষতি হলো, তা পূরণ হতে লেগে যাবে বহু বছর। শিক্ষা ব্যবস্থার ক্ষতির চিত্র এমনই যে, তার পূর্ণ অবয়ব খালি চোখে ধরা পড়তে চায় না। কিছু ইঙ্গিত বিলক্ষণ মিলছে বিভিন্ন গবেষণা জরিপে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) ইউনিসেফের যৌথ গবেষণা ন্যাশনাল সার্ভে অন চিলড্রেনস এডুকেশন ইন বাংলাদেশ ২০২১ শিরোনামে প্রকাশিত এক গবেষণায় শিশুদের প্রাথমিক জ্ঞান মৌলিক দক্ষতা হারানোর বিষয়টি উঠে এসেছে, যা আশঙ্কার। চিত্র শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক ক্ষতির তুলনায় যৎসামান্য। কারণ, শিক্ষার ক্ষতির ফল শিক্ষার্থীর জীবনের সম্ভাবনাকে সীমিত করে এবং তার পাশাপাশি তা প্রজন্মের গণ্ডিও অতিক্রম করে; সামগ্রিক অর্থনীতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এক্ষেত্রে শিক্ষণ ঘাটতি পূরণে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে বটে কিন্তু তার ফল খুব বেশি সুখকর নয়। তাই পরিস্থিতি বিশ্লেষণপূর্বক দ্রুত যথাযথ পদক্ষেপ নেয়াই হবে কাম্য।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যে বহুমাত্রিক ক্ষতি সাধিত হয়েছে, তা পুষিয়ে নেয়া দেশের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। শিক্ষার্থীরা দীর্ঘদিন শ্রেণী কক্ষের বাইরে থাকায় বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী পড়াশোনা ভুলে গেছে। জ্ঞানের বড় ঘাটতি নিয়ে ওপরের ক্লাসে উঠছে। পরীক্ষা নিতে না পারায় শেখার দক্ষতা যাচাই করাও সম্ভব হচ্ছে না। অনেক শিক্ষার্থী পড়াশোনা শেষ না করেই নানা শ্রম-পেশায় যুক্ত হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, বাংলাদেশের প্রায় ৩৮ মিলিয়ন শিক্ষার্থী সঠিক শিখন গ্রহণ এবং তাদের সমবয়সীদের সঙ্গে আলাপচারিতার সুযোগটি হাতছাড়া করেছে, যা তাদের শিক্ষার অভিজ্ঞতাকে প্রভাবিত করেছে। স্কুল বন্ধের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় শিক্ষার্থীদের সহায়তার জন্য বাংলাদেশ সরকার টেলিভিশন, সেলফোন, রেডিও এবং ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূরবর্তী শিক্ষার সূচনা করেছিল। তবে সব শিক্ষার্থীর প্লাটফর্মগুলোয় অ্যাকসেস না থাকায় শিক্ষার আসল উদ্দেশ্য অর্জন হয়নি। বিশ্বব্যাংকের আরেকটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, বিকল্প শিক্ষা পদ্ধতি এবং প্লাটফর্মে তাদের অ্যাকসেস কম ছিল। জরিপ করা স্কুলশিশুদের মধ্যে -১৫ বছর বয়সী যথাক্রমে ৫০ শতাংশেরও কম রেডিও, কম্পিউটার এবং টেলিভিশনে অ্যাকসেস পেয়েছে। তাদের প্রায় সবারই সেলফোন অ্যাকসেস রয়েছে, তবে অনেকেরই ইন্টারনেটে অ্যাকসেস নেই। সমীক্ষায় ধনী দরিদ্র পরিবারের মধ্যে একটি ডিজিটাল বিভাজনও পাওয়া গিয়েছে। অন্যান্য বিকল্প শেখার মাধ্যমে একই ধরনের প্রবণতা বিদ্যমান। অন্য জরিপে দেখা গিয়েছে, অনলাইন লার্নিং প্রোগ্রামগুলোয় অ্যাকসেস থাকা ২১ শতাংশ পরিবারের মধ্যে মাত্র শতাংশ পরিবার এর সঠিক ব্যবহার করতে পেরেছে।

অতিমারীর কারণে স্কুল-কলেজ বন্ধ থাকায় শিক্ষা প্রথমে প্রায় ডিজিটাল হয়েছিল; পরিস্থিতি ক্রমে নতুন স্বাভাবিক- পৌঁছার পর যে ব্যবস্থা চলছে, তাকে বলা হচ্ছে হাইব্রিড অর্থাৎ অনলাইন অফলাইনে মিলিয়েমিশিয়ে লেখাপড়া চলেছে। ডিজিটাল বিভাজিকায় যে অসাম্য বৃদ্ধি পেয়েছে, সে কথা বহুল আলোচিত। বিশেষত দরিদ্রতর এবং প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাছে ব্যবস্থা বিষম হয়েছে আর্থিক অসাম্য পরিণত হয়েছে শিক্ষার সুযোগের গভীর অসাম্যে। কোনো কল্যাণ রাষ্ট্রের কাছে অসাম্য কাম্য হওয়ার কথা নয়। বহু ছেলেমেয়ে ঝরে পড়েছে। স্কুলের শিক্ষাটুকু সম্পূর্ণ করলেও তাদের সামনে যে সুযোগগুলো থাকত, স্বভাবতই তা এই ছেলেমেয়েদের হাতছাড়া হবে। ফলে, তাদের আজীবন অর্থোপার্জনের, সামাজিক সুযোগ লাভের সম্ভাবনা কমবে। তার ফল পড়বে পরবর্তী প্রজন্মের শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যের ওপর। ফলে তাদেরও উন্নয়ন সামাজিক সম্ভাবনা সীমিত হবে। আন্তঃপ্রজন্ম ক্ষতির আর একটি পথ হলো, এই ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা ব্যবস্থায় পাঠ নিয়েই যারা ভবিষ্যতে শিক্ষক হবেন, তাদের শিক্ষকতার গুণগত মান খাটো হওয়ার আশঙ্কা থাকে এবং তা ভবিষ্যতের ছাত্রছাত্রীদের শিক্ষার গুণগত মানের ক্ষতি করবে। সার্বিকভাবে শিক্ষার ক্ষতি হলে তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে দেশের অভ্যন্তরীণ উৎপাদনের ওপরও।

সংকট মোকাবেলায় ক্ষতিগ্রস্ত পুরো শিক্ষাবর্ষের পুনরাবৃত্তি করা ক্ষতিপূরণের একটি বিকল্প উপায় হতে পারে বলে কেউ কেউ মতামত ব্যক্ত করেছেন। যেমন কেনিয়ার সরকারসহ আরো কয়েকটি দেশের সরকার ঠিক এমনটি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিশ্বাস থেকে যে, শিক্ষার্থীরা পুরো শিক্ষাবর্ষের পুনরাবৃত্তি করে তাদের সবাই একই মানে মূল্যায়িত হতে পারবে। তবে এক্ষেত্রে পড়ালেখা শেষ করতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবনের আরো দু-একটি বছর বৃদ্ধি পেতে পারে বলে এটি বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মনের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। সুতরাং এটি তেমন একটি ইফেকটিভ বিকল্প নয় বলে অনেকে অভিমত দিয়েছেন। বিশেষজ্ঞদের আরেকটি দল শিক্ষার ক্ষতি পোষাতে কারিকুলামসহ পাঠ্যক্রম হ্রাস এবং সংশ্লেষিত করার কথা বলেছেন। এমনটি হলে শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি বিষয়ে মনোনিবেশ করতে এবং সেগুলো ভালোভাবে শিখতে সক্ষম হবে। ফলে শিক্ষার গুণগত মানে কোনো সংশয় থাকবে না। যেমন: ওড়িশা, ভারত এবং কানাডার অন্টারিও এটি করেছে। বাংলাদেশ তার পুনরুদ্ধার কর্মসূচি ঘোষণা করেছে, যার মধ্যে পরের দুই বছরের জন্য একটি সংক্ষিপ্ত সিলেবাস অন্তর্ভুক্ত রয়েছে, যেখানে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের গণিত, বাংলা, ইংরেজি এবং বিজ্ঞানের মতো মূল বিষয়গুলোয় মনোনিবেশ করা হবে। এটি একটি সুন্দর পরিকল্পনা বলে অনেকেই মন্তব্য করেছেন। কভিড-পরবর্তী সময়ের ক্লাসগুলোয় রুটিনমাফিক পাঠ্যের বাইরে অফ বা গ্যাপ আওয়ারে অতিরিক্ত ক্লাস দেয়ার ব্যবস্থা করাও ক্ষতি পুষিয়ে নেয়ার একটি বিকল্প ব্যবস্থা হতে পারে। ম্যাককিনসে-ইউনেস্কোর যৌথ টুলকিট অনুসারে এটি কার্যকর করার প্রধান উপায় হলো, শিক্ষার্থীদের আরো বেশি সময় শেখার সুযোগ দেয়া। এটি বছরের দীর্ঘ ছুটিগুলো কমিয়ে, সাপ্তাহিক বন্ধ ধরে বা দিনের শেষে অতিরিক্ত সময় যোগ করার মাধ্যমে হতে পারে। উদাহরণস্বরূপ, ফিলিপাইনসহ বিশ্বের কয়েকটি দেশ হারিয়ে যাওয়া সময় পুনরুদ্ধার করতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো গ্রীষ্মকালীন ছুটির দিনগুলোয় অতিরিক্ত ক্লাস চালানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সবচেয়ে সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য ছোট ব্রেকআউট গ্রুপ বা ওয়ান-টু-ওয়ান টিউটরিংয়ের মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা যেতে পারে। এরই মধ্যে যুক্তরাজ্যে সরকার একটি জাতীয় প্রশিক্ষণ কর্মসূচির জন্য ৪৯০ মিলিয়ন ডলার বরাদ্দ দিয়েছে, যা সর্বাধিক প্রান্তিক শিক্ষার্থীদের জন্য নিবিড় তত্ত্বাবধানের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ঘানায় স্কুল ফর লাইফ প্রোগ্রাম স্কুলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের অগ্রগতি বাড়ানোর জন্য পিয়ার টিউটরিং ব্যবহার করেছে। ইতালিতে সরকার মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোয় একটি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করেছে, যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা স্বেচ্ছাসেবীর ভূমিকায় সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের এক-এক করে শিক্ষাদান করে থাকে। এখন পর্যন্ত এর প্রভাব ইতিবাচক। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের একাডেমিক পারফরম্যান্স এবং উন্নত আর্থসামাজিক দক্ষতা মনস্তাত্ত্বিক সুস্থতার বৃদ্ধি দেখছেন; বিশেষত অভিবাসী ব্যাকগ্রাউন্ডের শিক্ষার্থীদের মধ্যে।

অতিমারী বাংলাদেশের শিক্ষা ক্ষেত্রের যে ক্ষতি করেছে, শুধু সময়ের হাতে ছাড়লে তা পূরণ হওয়া কঠিন। স্কুল-কলেজ যদি পুরনো, স্বাভাবিক ছন্দে চলতেও থাকে, ব্যবস্থা থেকে ছিটকে যাওয়া ছেলেমেয়েদের তাতে ফিরে আসার রাস্তা বন্ধ। বাংলাদেশকে দেখলে ভরসা হয় না যে অবস্থায় রাষ্ট্র চিন্তিত হবে। তাই আলাদাভাবে মনে করিয়ে দেয়া দরকার, অবস্থা চলমান থাকা উচিত নয়। প্রথমে দরকার ক্ষতির প্রকৃত চিত্র লাভ করা। প্রতিটি ছাত্রের ক্ষেত্রে আলাদাভাবে দেখতে হবে তার কত ক্ষতি হয়েছে, এবং কোন পথে সে ক্ষতি পূরণ সম্ভব। ব্রিজ কোর্স, ডিজিটাল সহায়তা, বিশেষ প্রশিক্ষণ বা আর্থিক সাহায্য, যা প্রয়োজন, তা- দিতে হবে। অতিমারী-উত্তর পৃথিবীর চাহিদার কথা মাথায় রেখে শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজতে হবে, কিন্তু সবার আগে স্বীকার করতে হবে, বড় ক্ষতি হয়েছে শিক্ষায়।

আগামীতে দুর্যোগে শিক্ষা কার্যক্রমে সব শিক্ষার্থীকে অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিত। প্রস্তুতি পুনরুদ্ধারের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কার্যকর ভূমিকা থাকতে হবে। করোনার আঘাত মোকাবেলার জন্য স্বাস্থ্য, অর্থনীতিসহ বাকি সব খাত যেমন গুরুত্ব পেয়েছিল শিক্ষা তেমন গুরুত্ব পায়নি। মন্ত্রণালয় স্বল্প, মধ্যম দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিলেও তা বাস্তবায়নে উদ্যোগের ঘাটতি ছিল। দুর্যোগের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিলেও তা বাস্তব অর্থে তেমন কাজে লাগেনি। শিক্ষা খাতে করোনায় যে ক্ষতি হয়ে গিয়েছে, তা পোষাতে বেশ সময় লাগবেএটাই স্বাভাবিক। তবে ক্ষতি পোষাতে ধাপে ধাপে ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। বাজেট সামনে রেখে বিষয়ে বিশদ ভাবা যেতে পারে। প্রায় প্রতি বছরই বলা হয় শিক্ষায় সর্বোচ্চ বরাদ্দ দেয়া হবে, কিন্তু সে অর্থে শিক্ষার বরাদ্দ বাড়ে না। ইউনেস্কোর পক্ষ থেকে শিক্ষা খাতে জিডিপির শতাংশের পরামর্শ দেয়া হলেও বাংলাদেশে বরাদ্দ জিডিপির হিসাবে শতাংশ কিংবা তার আশপাশেই ঘুরপাক খায়। শিক্ষায় বরাদ্দ আরো বাড়াতে হবে।

বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সমাধানমূলক পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা না হলে পুরো প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের ভবিষ্যৎ আয়ের ক্ষেত্রে যে পরিমাণ ক্ষতি হবে তা প্রায় ১০ ট্রিলিয়ন ডলার সমপরিমাণ। খুব স্বল্প সময়ে ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা সহজ হবে না। শিক্ষা খাতে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা পর্যাপ্ত বিনিয়োগ ক্ষতি পূরণে সহায়ক হবে। গত দুই বছর কোনো রকম পড়ালেখা না করে বা অল্পবিস্তর পড়া সম্পন্ন করেই পরপর দুই শ্রেণী অতিক্রম করে বর্তমান শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হয়ে উঠে এসেছে। ফলে তাদের প্রতিটি পঠন বিষয়ে মৌলিক জ্ঞানে দুর্বলতা রয়ে গেছে। এজন্য প্রথমেই ছোট আকারে পরীক্ষা নিয়ে দুর্বল শিক্ষার্থীদের চিহ্নিত করে ফেলতে হবে। এরপর বিষয়ভিত্তিক মৌলিক শিখনের পাঠ বেছে আলাদা করে তাদের বুঝিয়ে দিতে হবে। প্রযোজ্য ক্ষেত্রে শিট তৈরি করে বিতরণ করে দিতে হবে। আর অভিভাবকের সাথে সমন্বয় করে মৌলিক পাঠগুলো শিখনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন