বিশ্ব অর্থনীতি

মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভ ও চীনের বিপদ একই

স্টিফেন এস রোচ

মূল্যস্ফীতি মোকাবেলায় মার্কিন ফেডারেল রিজার্ভের সাম্প্রতিক পদক্ষেপ আপাতদৃষ্টিতে প্রশংসার দাবিদার। একইভাবে চীনের উন্নয়ন চীনকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংও কৃতিত্বের

দাবিদার। কিন্তু কৃতিত্ব বা প্রশংসা প্রকৃতপক্ষে তাদের নয়। না হওয়ার কারণও উভয় ক্ষেত্রে এক।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফেডারেল রিজার্ভের নেয়া সাম্প্রতিক পদক্ষেপও প্রশংসার দাবিদার। যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরপর তৃতীয়বারের মতো ফেডারেল ফান্ডস রেট (এফএফআর) ৭৫ বেসিস পয়েন্ট বাড়িয়েছে। ১৯৮২ সালের পর থেকে চার মাস সময়কালের মধ্যে নীতি সুদহারের বৃদ্ধি রীতিমতো একটা বেঞ্চমার্ক। এরই মধ্যে বহু রাজনীতিবিদ বিশেষজ্ঞ নীতি সুদের হারের অতিবৃদ্ধির সমালোচনাপূর্বক এক ঝুঁকিপূর্ণ বলে সতর্ক করছেন। আমি তাদের সঙ্গে একমত নই।

আমিশুরুর শব্দটির ওপর জোর দিতে চাই। বর্তমানে নমিনাল এফএফআর কার্যত দশমিক শতাংশ, যা তিন-মাস সময়কালের গড় ভোক্তা মূল্যস্ফীতির ( শতাংশ) চেয়ে শতাংশীয় পয়েন্ট কম। কিন্তু প্রকৃত এফএফআরের হার শতাংশ নেতিবাচক হওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি ঠেকাতে ফেডারেল রিজার্ভের নেয়া পদক্ষেপের সফল হওয়া প্রায় অসম্ভব।

পর্যায়ে এসে তর্কটা জটিল হয়ে ওঠে। পাওয়েল ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে আকে সংবাদ সম্মেলনে বলেছিলেন বর্তমানে ফেডারেল রিজার্ভের নীতিনিয়ন্ত্রণমূলক এলাকার তলানিতে। তিনি মূলত কথিতকোর পারসোনাল কনজাম্পশন ডিফ্লেটরকে ভিত্তি ধরে মূল্যস্ফীতিকে হিসাব করেছিলেন। এতে খাদ্য জ্বালানি পণ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল না। বিবেচনায় বার্ষিক হিসেবে জুলাই পর্যন্ত মূল্যস্ফীতির হার ছিল দশমিক শতাংশ।

আলোচ্য পর্যবেক্ষণটি দুটি কারণে হতাশাজনক। এক. নমিনাল এফএফআর এখনো পাওয়েলের মূল্যস্ফীতি হিসাবের তুলনায় অনেক নিচে। অন্যদিকে ফেডারেলের হিসাব অনুসারে কোর ইনফ্লেশন নির্দিষ্ট করার বিষয়টি বিপজ্জনক। দ্বিতীয় বিষয়টি গত শতকের সত্তরের দশকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। আমি ফেডারেল রিজার্ভের সদস্য থাকার সময় নীতি তৈরি করা হয়েছিল এবং বিষয়টি এখনো সত্য।

এক্ষেত্রে মূল বিষয় হলো গুরুত্বপূর্ণ পণ্যে মূল্যবৃদ্ধিকে রোধ করা। পাওয়েল এটিই করেছিলেন শুরুতে। আমি এখনো আমার প্রথম অধিকর্তা, ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারম্যান আর্থার বার্নসেরঅরিজিনাল সিন নিয়ে ভয়ে থাকি। তিনি এখন থেকে ঠিক ৫০ বছর আগে একের পর এক ক্ষণস্থায়ী অভিঘাত এড়িয়ে গিয়েছিলেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে দেরি করেছিলেন। এখান থেকে শিক্ষণীয় বিষয় হলো, ‘কোর সূত্র মেনে ফেডারেল যেমন টিকে থাকতে পারে, তেমনি কোরের কারণ তার ক্ষতিও হতে পারে।

চীনের ক্ষেত্রে ‌‌‌‌‌‌‌‌কোর মূলত মূল্যস্ফীতির চেয়ে শি জিনপিংয়ের ব্যক্তিগত নেতৃত্বের প্রভাবের ওপর বেশি নির্ভর করে। শি জিনপিংয়ের নেতৃত্বে চীনের শাসন ব্যবস্থায় ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। চার দশক আগে শুরু হওয়া দেং-ঝাওপিংয়েরসংস্কার উন্মক্তকরণ প্রক্রিয়াকে সরিয়ে এখন সর্বক্ষেত্রে শি-কেন্দ্রিক কমিউনিস্ট পার্টির দাপট। ইন্টারনেট প্লাটফর্মভিত্তিক কোম্পানি নিয়ন্ত্রণে এটি বেশি দৃশ্যমান। এছাড়া শিকমন প্রসপারিটি প্রকল্পের অধীনে আয় সম্পদ পুনর্বণ্টনে জোর দেয়ার মধ্যেও এর পরিচয় পাওয়া যায়।

ধরনের উন্নয়নের সমন্বিত প্রভাবেব বিষয়ে আমার মতে স্থির থাকতে চাই। ধরনের পদক্ষেপ চীনের উদ্যোক্তাদের বিশেষত নতুন স্টার্টআপ, দেশীয় উদ্যোক্তা উৎপাদনের ওপর প্রভাব ফেলে। পরিণত একটি দেশ হিসেবে চীনে বর্তমানে জনমিতির পরিবর্তন পর্যবেক্ষণপূর্বক আমিসহ অন্য পর্যবেক্ষকরা যে বিষয়টি নিয়ে ভীত তা হলো উৎপাদন ব্যবস্থায় মন্দা আসার কারণে চীনের অর্থনৈতিক বিকাশও বাধাগ্রস্ত হতে পারে। চীনের ভোক্তারা বহুদিন নিজেদের দমন করে রেখেছেন সেখান থেকে অর্থনৈতিক মন্দার বিষয়টি কেবল একটি অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকেই ইঙ্গিত করতে পারে।

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ফেডারেল রিজার্ভের পদক্ষেপ এবং চীনের নেতার পদক্ষেপের মধ্যে একটি সাধারণ বৈশিষ্ট্য রয়েছে, আর তা হলো নীতির সংকট তৈরি হওয়ার শঙ্কা। মুদ্রানীতিপ্রণেতারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে যে মাত্রা পর্যন্ত ভুল পথে চলমান তা প্রমাণ করে যে মূল্যস্ফীতির হার শতাংশে নামিয়ে আনার ক্ষেত্রে তাদের দৃষ্টি মূল বিষয়ের প্রতি আর নিবদ্ধ থাকছে না।

আমার মতে, লক্ষ্য পূরণ করতে নমিনাল এফএফআরের হার

- শতাংশ পর্যন্ত বাড়াতে হবে। এতে প্রমাণ হয় ফেডারেল রিজার্ভ আসলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্য অর্জনের মধ্যপথে রয়েছে। আমার আশঙ্কা এর মধ্য দিয়ে ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি না আবার মন্দার কবলে পড়ে, যা ইউরোপ চীন এরই মধ্যে মোকাবেলা করছে। চীনের অর্থনীতি এরই মধ্যে মন্দার মধ্যম পর্যায়ে চলে গেছে। আগামী বছর বিশ্বব্যাপী একটি অর্থনৈতিক মন্দা অনিবার্য।

চীনের নেতার জন্য অর্থনৈতিক সংকটের বিষয়টি কেবল শুরু। কেননা তিনি নিয়ন্ত্রণমূলক নীতির প্রতি মনোযোগী নন এবং কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতা মোকাবেলায় কোনো প্রস্তুতি গ্রহণ করেননি। ২০তম পার্টি কংগ্রেসের মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাকি থাকতে এমন অবস্থা তৈরি হওয়া তার জন্য নেতিবাচক। কেননা কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে চীনের সর্বোচ্চ নেতা হিসেবে শি তার তৃতীয় মেয়াদ শুরু করবেন।  

মূল্যস্ফীতির হার নির্দিষ্ট করার মধ্য দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ভুল বার্তা পেতে পারে। একজন নেতার ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রেই তাকে ভুল পথে পরিচালনা করতে পারে, যার ফলে তিনি ভুল নীতি গ্রহণ করতে পারেন। মূলের ধারণাটি জটিল কঠিন সমস্যার নির্ভুল সমাধানের দিকে ভুল পথনির্দেশ প্রদান করে। এটি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং সরকার পরিচালনাউভয় ক্ষেত্রেই সত্য।মূল বা কোর নির্দিষ্ট করে দেয়ার ধারণাটি আমেরিকা চীন উভয়ের জন্যই বিপজ্জনক। এমন প্রবণতা দুর্বল সংকটজনক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিজেদের মধ্যেও দ্বন্দ্ব তৈরি করছে।

[স্বত্ব:প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

 

স্টিফেন এস রোচ: মর্গ্যান স্ট্যানলি এশিয়ার সাবেক চেয়ারম্যান ইয়েল ইউনিভার্সিটির ফ্যাকাল্টি মেম্বার এবং ইয়েল ইউনিভার্সিটি প্রেস থেকে প্রকাশিতব্য অ্যাকসিডেন্টাল কনফ্লিক্ট: আমেরিকা, চীন অ্যান্ড দ্য ক্র্যাশ অব ফলস ন্যারেটিভস বইয়ের লেখক

ভাষান্তর: মাহমুদুর রহমান

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন