পাঠক মত

খুলনা: এবার শিল্প ও পর্যটন বিকাশে নজর দিতে হবে

তিন-চার ঘণ্টায় ঢাকা থেকে খুলনায় পৌঁছানো কিছুদিন আগেও স্বপ্নের মতো ছিল। ফেরি পারাপারে দীর্ঘ সময় লাগায় ভোগান্তির যেন শেষ ছিল না পদ্মা ওপারের মানুষের। আর যদি ঈদ কিংবা কোনো পালাপার্বণের সময় হতো, ভোগান্তি পৌঁছে যেত চরম মাত্রায়। কিন্তু পদ্মা সেতু হওয়ায় এসব এখন অতীত। তবে ভাঙা থেকে খুলনা চার লেন সড়ক নির্মাণ হলে আরো দ্রুত সময়ে খুলনা পৌঁছানো সম্ভব। সেতু চালু হওয়ায় রেল বিমানের চাহিদা কমে গেছে। যশোর থেকে কয়েকটি বেসরকারি বিমান কোম্পানি তাদের ফ্লাইটের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছে। ট্রেনে খুলনা থেকে ঢাকা যেতে দীর্ঘ সময় লাগায় এখন টিকিট বিক্রি কমে গেছে। কিছুদিন আগেও যেখানে খুলনা, যশোর, চুয়াডাঙ্গা থেকে ট্রেনের টিকিট পাওয়া সোনার হরিণ ছিল, কিন্তু এখনকার বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন। ধারণা করা যায়, পদ্মা সেতু হয়ে যশোর খুলনায় রেল যোগাযোগ স্থাপন হলে পরিবহন ব্যবসাও কমে যাবে। তখন মাত্র আড়াই ঘণ্টায় দুই জেলা শহর থেকে ঢাকায় যাওয়া যাবে। যেখানে ভ্রমণ হবে নিরাপদ আরামদায়ক, সঙ্গে ভাড়া হবে পরিবহনের থেকে অনেক কম। 

এতক্ষণ স্বল্প পরিসরে পদ্মা সেতু যোগাযোগ ব্যবস্থায় কেমন প্রভাব ফেলেছে তা নিয়ে কিছু কথা বললাম, কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের সঙ্গে খুলনা অঞ্চলে শিল্প-কারখানা পর্যটন শিল্পের বিকাশে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। তাহলে অঞ্চলের মানুষের কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে, হ্রাস পাবে বেকারত্ব। নতুন নতুন কলকারখানা পর্যটন শিল্প আমাদের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে।

গত সপ্তাহে পদ্মা সেতু পার হয়ে খুলনায় যাই। রূপসা সেতু পার হয়ে শহরে প্রবেশের পথে চোখে পড়ে রাস্তার দুই পাশে নতুন নতুন আবাসন  প্রকল্পের কাজ চলছে, ছোট-বড় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে, শহরের ভেতরে সড়ক ড্রেনেজ ব্যবস্থা সংস্কার করা হচ্ছে। আমার ভাবনায় এলো, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন যেন শহরকে হারিয়ে যাওয়া শিল্পনগরীতে ফেরার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। যোগাযোগ ব্যবস্থা ভৌগোলিক অবস্থানগত বিবেচনায় খুলনা একটি সম্ভাবনাময় শহরের নাম। রূপসা ভৈরব নদের তীরঘেঁষে গড়ে ওঠা খুলনা একসময় শিল্প নগরী নামে পরিচিত ছিল। ঢাকা চট্টগ্রাম শহরের পরে খুলনার অবস্থান হলেও বিভিন্ন কারণে খুলনায় কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন হয়নি। ৫০-৭০-এর দশকের মধ্যে এখানে জুট মিলস, নিউজ প্রিন্ট মিলস, হার্ডবোর্ড কেবলস্ ফ্যাক্টরি, টেক্সটাইল মিলস, দাদা ম্যাচ ফ্যাক্টরি, জাহাজ শিল্পসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র, মাঝারি ভারী শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছিল। এসব শিল্প-কারখানার কারণে শহরের নাম হয়েছিল শিল্পনগরী। তখন এখানে হাজার হাজার মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়, কিন্তু নব্বইয়ের দশকের আগে থেকেই লোকসানের কারণে একে একে প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হতে থাকে। তবে বর্তমানে অনেক প্রতিষ্ঠান লাভের মুখ দেখায় শিল্প বিকাশে নতুন সম্ভাবনা তৈরি হচ্ছে।

অঞ্চলের চিংড়ি মৎস্য, কৃষিপণ্য, পর্যটন বড় বড় শিল্প-কারখানা গড়ে তোলার পরিকল্পনা নিতে হবে। বন্ধ হয়ে যাওয়া কলকারখানা চালু করে নতুনত্বের ছোঁয়া দিতে হবে। সব ধরনের শিল্পের বিকাশে ১০০ বছরের একটা মাস্টারপ্ল্যান সামনে রেখে এগোতে হবে। মানুষের বসবাসের জন্য পরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। আধুনিক ড্রেনেজ ব্যবস্থা, যানজটমুক্ত শহর, শপিংমল, বিনোদন কেন্দ্র, শিক্ষা সংস্কৃতি চর্চা কেন্দ্র, হাসপাতালসহ সব ধরনের নাগরিক সুযোগ-সুবিধা সেখানে থাকবে। খুলনা শহর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রশস্ত ওয়াকওয়ে, বোটানিক্যাল গার্ডেন, নদীতীরে রিভার ভিউ রোড এবং পার্ক নির্মাণ করতে হবে। কারণ সুস্থ শরীর মন কর্মক্ষমতা বৃদ্ধির সহায়ক হিসেবে কাজ করে।

শিল্প-কারখানা নির্মাণে জোনভিত্তিক পরিকল্পনা হাতে নিতে হবে। খুলনা সাতক্ষীরা জেলা চিংড়ি বিভিন্ন ধরনের মাছের জন্য বিখ্যাত। ফলে একটি এলাকা হবে চিংড়ি মত্স্য জোন। জোনে মৎস্য প্রক্রিয়াকরণ রফতানি শিল্প গড়ে তুলতে হবে। একইভাবে কৃষি, জুট মিলস টেক্সটাইল এবং জাহাজ শিল্পের জন্য থাকবে আলাদা আলাদা জোন। প্রতিটি জোনের সঙ্গে থাকবে গবেষণা কেন্দ্র যেখানে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়, খুলনা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কুয়েট গবেষণায় সহায়তা করতে পারে। কর্মরত শ্রমিকদের জন্য রাখতে হবে আবাসন ব্যবস্থা। পাশের জেলা উপজেলা শহরের সঙ্গে রেল সড়ক পথের যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করতে হবে। সাতক্ষীরা থেকে যশোর খুলনার মধ্য রেল যোগাযোগ স্থাপন, যশোর থেকে দর্শনা পর্যন্ত ডাবল রেললাইন নির্মাণ দ্রুত সময়ের মধ্যে করতে হবে। অঞ্চলে মোংলা, বেনাপোল, ভোমরা দর্শনা বন্দর রয়েছে। জীবননগর মুজিবনগর স্থলবন্দর নির্মাণাধীন। ফলে ছয়টি বন্দর কার্যকার ভূমিকা রাখবে খুলনার শিল্প পর্যটন বিকাশে। এখন অতিদ্রুত সময়ের মধ্যে খুলনা হয়ে যশোর এবং ভোমরা বন্দর থেকে যশোর হয়ে উত্তরবঙ্গের সড়ক ছয় লেনের কাজ শুরু করতে হবে। যশোর থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত সড়ক ছয় লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্প হাতে নিতে হবে।

পর্যটন শিল্পের অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে পদ্মা সেতু। এখন খুলনায় বিমানবন্দর তৈরি হলে দেশী-বিদেশী পর্যটকরা দ্রুত সময়ে আসতে পারবেন খুলনাঞ্চলে। খুলনার  সুন্দরবন বাগেরহাটের ষাটগম্বুজ মসজিদ পর্যটন শিল্প বিকাশে মূল ভূমিকা পালন করবে। ফলে দুটিকে ঘিরেই মূল পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে। এছাড়াও এখানে অনেক পুরাকীর্তি দর্শনীয় স্থান রয়েছে, যা সংরক্ষণ করে ট্যুরিস্ট স্পট হিসবে গড়ে তুলতে হবে।

দেশ-বিদেশের বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠানের আকর্ষণ বাড়াতে সব ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে, যাতে তারা এখানে কল-কারখানা নির্মাণ পর্যটন শিল্পে বিনিয়োগে আগ্রহী হয়। এজন্য  প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিকল্পনা উদ্যোগ। তবে পথের অন্তরায় হতে পারে খুলনায় গ্যাস না থাকা। খুলনার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পাইপলাইনে গ্যাস সরবরাহ, বিমানবন্দর তৈরি শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখতে এখনি কাজ শুরু করতে হবে। এত সব পরিকল্পনার মূলে রাখতে হবে খুলনাঞ্চলে মানুষ যেন ব্যবসা, কর্মসংস্থান, পড়ালেখা, চিকিৎসাসহ সবকিছুর চাহিদা খুলনাতেই মেটাতে পারে। এতে রাজধানী ঢাকা শহরের ওপর চাপ কমবে। এভাবে প্রতিটি বিভাগীয় বৃহত্তর জেলা শহর ঘিরে পরিকল্পনা করতে হবে। এর ফলে অঞ্চলভিত্তিক সুষম উন্নয়ন, জিডিপির হার বৃদ্ধি, বেকারত্ব হ্রাসসহ সার্বিকভাবে বাংলাদেশ দ্রুত সময়ে উন্নত আধুনিক দেশ হিসেবে নিজেকে তুলে ধরতে পারবে।

 

মো. শাহিন রেজা: সাবেক শিক্ষার্থী

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন