দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে বরিশালের শ্রীমন্ত নদী

এম মিরাজ হোসাইন, বরিশাল

বাকেরগঞ্জ পৌর এলাকায় সরু খালে পরিণত হয়েছে খরস্রোতা শ্রীমন্ত নদী ছবি: নিজস্ব আলোকচিত্রী

ঢাকা-কুয়াকাটা মহাসড়কে চলাচলকারীদের বরিশাল বাকেরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড এলাকায় ছোট একটি সেতু অতিক্রম করতে হয়। সেতুর নিচ দিয়ে বয়ে চলা মজা খালটি আসলে খাল নয়, নদী। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, বাকেরগঞ্জ শহরের বুক চিরে বয়ে যাওয়া জলাধারটি একসময়ের খরস্রোতা শ্রীমন্ত নদী। নদী এখন দখল-দূষণে অস্তিত্ব সংকটে।

দেশের নদনদী সংরক্ষণকারী প্রতিষ্ঠান পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নদীর তালিকায় এখনো বাকেরগঞ্জের শ্রীমন্ত নদীর নামটি রয়েছে। দুপাশের তীর দখল দূষণে শ্রীমন্ত নদীর 'শ্রী' হারিয়েছে বহু বছর আগে। এখন সেটি বিলুপ্তির পথে ধাবিত হয়ে অস্তিত্ব সংকটে ভুগছে। পৌর শহরের মধ্যে শ্রীমন্ত নদীর তিন কিলোমিটারের পুরোটাই দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে। জনপ্রতিনিধি স্থানীয় প্রভাবশালী রয়েছেন দখলদারের তালিকায়। শহরের মধ্যে দখলের চিত্রই বলে দেয়, একটি খরস্রোতা নদী কীভাবে হত্যা করা যায়। মাত্র দুই দশক সময়ের মধ্যে শ্রীমন্ত নদীর এমন মৃত্যু হয়েছে বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা।

সরেজমিনে দেখা গিয়েছে, বাকেরগঞ্জ উপজেলা শহরের পূর্ব পাশ দিয়ে প্রবাহিত তুলাতলী নদী শ্রীমন্ত নদীর উৎসমুখ। শহরের মাঝ দিয়ে পশ্চিম দিকে চলে গিয়েছে নদীটি। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, শ্রীমন্ত নদী প্রায় ২২ কিলোমিটার দীর্ঘ। তুলাতলী নদী থেকে শুরু হয়ে পশ্চিম দিকে প্রবাহিত অংশটি মাঝ বরাবরে এসে দুই ভাগে বিভক্ত হয়েছে। মূলধারাটি কানকি নামক স্থানে শেখ হাসিনা সেনানিবাসের পাশ দিয়ে পায়রা নদীতে মিশেছে। অন্য অংশটি বাকেরগঞ্জের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ বন্দর কালিগঞ্জ, নেয়ামতি হয়ে মিশেছে বিষখালী নদীর সঙ্গে। পৌর শহরের জনগোষ্ঠীর পানির চাহিদা মেটাত শ্রীমন্ত নদী। স্থানীয় বাসিন্দা কামাল হোসেন হাওলাদার জানান, শ্রীমন্ত নদীর দুই তীরের বাসিন্দদের স্যুয়ারেজ সংযোগ দেয়া হয়েছে নদীতে। এতে নদীর পানিও ব্যবহার উপযোগিতা হারিয়েছে।

বাকেরগঞ্জ পৌর শহরের একাধিক বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলে জানা গিয়েছে, ম্যাপ অনুযায়ী শ্রীমন্ত নদীর প্রশস্ততা স্থানভেদে ১৫০-৬০০ ফুট পর্যন্ত। দুই যুগ আগেও প্রশস্ততা বহাল ছিল। তখন বাতাসে ঢেউয়ের শব্দ ভেসে বেড়াত। বাহারি পানসি, লঞ্চ, ট্রলার, নৌকা ছুটত নদীর বুক চিরে। অঞ্চলে বড় বন্দর হাট-বাজার নলছিটির মোল্লারহাট, মীর্জাগঞ্জের সুবিদখালী, চান্দুখালী এবং বেতাগী পাথরঘাটা উপজেলার পণ্যবাহী নৌযানের প্রধান রুট ছিল শ্রীমন্ত নদী। এসব এখন শুধুই স্মৃতি।

বাকেরগঞ্জ পৌর শহরের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত নদীর দুই পাশে , , নম্বর ওয়ার্ডের জনপদ। নম্বর ওয়ার্ডে তুলাতলী নদীর উৎসমুখ থেকেই দখল শুরু। ওয়ার্ডের মরহুম আবদুর রশিদ পৌর কাউন্সিলর থাকাকালীন শ্রীমন্ত নদীর উৎসমুখ দখল করে ভবন নির্মাণ করেন বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। এরপরে সামনের দিকে যতই অগ্রসর হয়েছে দখলে সরু হয়ে মৃত খালে পরিণত হয়েছে। পৌর শহরের কিলোমিটার অংশে শ্রীমন্ত নদীর চিত্র একই।

বাকেরগঞ্জ বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে দেখা গিয়েছে, নদীর দুই তীর ভরাট করে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় পাকা-আধাপাকা অসংখ্য ভবন। সেতুর পশ্চিমে আল আমিন মসজিদ থেকে শুরু হয়ে পূর্বে থানা ভবন পর্যন্ত কিলেমিটারে আফসার মার্কেট, গাজী মঞ্জিলসহ সব পাকা-আধাপাকা নির্মিত হয়েছে শ্রীমন্ত নদী দখল করে।

নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর সৈয়দ আমিরুজ্জামান রিপন বলেন, শ্রীমন্ত নদী দখলদারের দলে আছেন স্থানীয় শীর্ষ জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে প্রভাবশালী অনেকে। ভাঙন ঠেকানোর অজুহাত তুলে ব্লক ফেলে সৌন্দর্যবর্ধনসহ নানা ফন্দিতে নদী দখল করা হয়েছে।

বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের বরিশালের সমম্বয়কারী রফিকুল আলম বলেন, শ্রীমন্ত নদী জীবিত করার জন্য সবার আগে সীমানা নির্ধারণ দখলদারদের উচ্ছেদ করার উদ্যোগ নিতে হবে স্থানীয় প্রশাসনকে।

স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের বাকেরগঞ্জ উপজেলা প্রকৌশলী আবুল খায়ের বলেন, শ্রীমন্ত নদী তাদের আওতাধীন নয়। তার পরও এটির পানির প্রবাহ ফিরিয়ে আনার জন্য তাদের একটি প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৪৮ লাখ টাকা ব্যয়ে দুই মাস আগে দশমিক ৪৮ মিটার খনন করেছেন। এতে পৌর শহরের অংশে পানির প্রবাহ ফিরে এসেছে।

বরিশাল পাউবোর উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. রাকিব হোসেন বলেছেন, শ্রীমন্ত নদীর পূর্বের অবস্থা ফিরিয়ে আনা আর সম্ভব নয়। এখন যেভাবে আছে সেটাকে কীভাবে রক্ষা করা যায় তার একটি উদ্যেগ নিয়েছেন তারা। কর্মকর্তা বলেন, ৬৪ জেলায় ছোট নদী-খাল খনন সংরক্ষণ প্রকল্পের "্বিতীয় পর্যায়ের আওতায় বরিশালের অনেকগুলো নদী-খাল খননের একটি প্রকল্প মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়া হয়েছে। ওই প্রকল্পের মধ্যে শ্রীমন্ত নদীও রয়েছে। প্রকল্পটি অনুমোদন পেলে নদীটি খনন করা যাবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন