শুরুর অপেক্ষায় আরো দুই মেট্রোর কাজ

যানজটের ব্যাপকতা বাড়বে রাজধানীতে

শামীম রাহমান

ঢাকার প্রথম মেট্রোরেলের (এমআরটি-) নির্মাণকাজ শুরু হয় ২০১৬ সালে। মাটির নিচে থাকা বিভিন্ন সংস্থার পরিষেবা স্থানান্তরের মধ্য দিয়ে শুরু হয় কর্মযজ্ঞ। সে সময়ই শুরু হয় মেট্রোর গতিপথে থাকা সড়ক ব্যবহারকারীদের দুর্ভোগ। শুরুতে দুর্ভোগে পড়ে মিরপুর থেকে আগারগাঁও এলাকার মানুষ। ২০১৯ সাল থেকে দুর্ভোগ বিস্তৃত হয় ফার্মগেট-মতিঝিল পর্যন্ত। সড়কের একটা বড় অংশ দখল করে চলা নির্মাণকাজ আর দুর্বল ট্রাফিক ব্যবস্থাপনায় মেট্রো প্রকল্পটি বাড়িয়ে দেয় ঢাকার যানজট, যা এখনো চলমান। প্রথম মেট্রোর দুর্ভোগের রেশ কাটতে না কাটতে রাজধানীতে শুরু হতে যাচ্ছে আরো দুটি মেট্রোর কাজ। এর একটি হবে বিমানবন্দর-বাড্ডা-কমলাপুর সড়কে। অন্যটি হেমায়েতপুর-মিরপুর-বনানী সড়কে। মেট্রো দুটির কাজ শুরু হলে ঢাকায় যানজটের ব্যাপকতা আরো বাড়বে বলে আশঙ্কা বিশেষজ্ঞদের। এমন প্রেক্ষাপটে যানজট সহনীয় পর্যায়ে রাখতে প্রকল্প এলাকায় সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দেয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন তারা।

ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণ পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) কর্মকর্তারা বলছেন, চলতি বছরের শেষ নাগাদ শুরু হবে বিমানবন্দর-কমলাপুর মেট্রোর (এমআরটি-) কাজ। আর হেমায়েতপুর-ভাটারা মেট্রোর (এমআরটি-, নর্দার্ন রুট) কাজ শুরু হবে আগামী বছর। ২০২৬ ২০২৮ সালে শেষ হবে মেট্রো দুটির নির্মাণকাজ। শুরুতে করা হবে ডিপোর ভূমি উন্নয়ন অবকাঠামো তৈরির কাজ। এরপর গতিপথে থাকা বিভিন্ন সংস্থার পরিষেবা স্থানান্তর করে শুরু হবে মূল অবকাঠামোর নির্মাণকাজ।

বিমানবন্দর-কমলাপুর মেট্রোর গতিপথ পড়েছে ঢাকার অন্যতম প্রবেশদ্বার বিমানবন্দরে। সিলেট, ময়মনসিংহসহ উত্তরাঞ্চল থেকে আসা পরিবহনগুলোর একটা বড় অংশ ঢাকায় প্রবেশ করে বিমানবন্দর দিয়ে। শহরের ভেতরে বিমানবন্দর থেকে খিলক্ষেত, বাড্ডা, রামপুরা, মালিবাগ হয়ে কমলাপুর পর্যন্ত পড়েছে মেট্রোর গতিপথ। পুরো গতিপথটি পড়েছে বিমানবন্দর-বাড্ডা-কমলাপুর সড়কের নিচে। অতিরিক্ত যানবাহন আর পথচারীর চাপ এবং অনিয়ম-বিশৃঙ্খলায় দিনভর যানজট লেগে থাকে সড়কে। রাতে সাধারণ যানবাহনের সঙ্গে যোগ হয় ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, ট্রেইলারের মতো ভারী যানবাহন।

অন্যদিকে হেমায়েতপুর-ভাটারা মেট্রোর গতিপথ পড়েছে ঢাকার আরেক প্রবেশদ্বার হেমায়েতপুরে। দেশের উত্তর উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের পরিবহনগুলোর একটা বড় অংশ ঢাকায় প্রবেশ করে হেমায়েতপুর দিয়ে। শহরের ভেতরে  মেট্রো তৈরি করা হবে গাবতলী, মিরপুর-১০, কচুক্ষেত, বনানী, নতুনবাজার সড়কের নিচ দিয়ে। আর হেমায়েতপুর থেকে আমিনবাজার নতুনবাজার থেকে ভাটারা অংশ তৈরি করা হবে বিদ্যমান সড়কের ওপর দিয়ে। এটি ঢাকার অন্যতম ব্যস্ত সড়ক।

পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রথম মেট্রোর নির্মাণকাজে শুধু রাজধানীর ভেতরে যানবাহন চলাচল বিঘ্নিত হচ্ছে। কিন্তু বিমানবন্দর-কমলাপুর হেমায়েতপুর-ভাটারার মধ্যে থাকা মেট্রো দুটির কাজ শুরু হলে ঢাকার প্রবেশমুখে থাকা যানবাহনগুলোও যানজটে পড়বে। সঠিক ব্যবস্থাপনা করা না হলে যানজট ঢাকা-আরিচা ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কেও ছড়িয়ে পড়তে পারে।

ঢাকার ব্যস্ততম অংশে দুটি মেট্রোই তৈরি করা হচ্ছে পাতালপথে। ডিএমটিসিএলের কর্মকর্তারা বলছেন, মাটির নিচে কাজ করার কারণে তা সড়কের যানজটে খুব একটা প্রভাব ফেলবে না। তবে স্টেশন এলাকাগুলোর অবকাঠামো তৈরির জন্য সড়কের একটা বড় অংশ ব্যবহার করতে হবে। কারণে যেসব স্থানে পাতাল মেট্রোর স্টেশন রয়েছে, সেসব জায়গায় সড়কের ওপর যানবাহন চলাচলে কিছুটা বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। তবে তা ছয় মাসের বেশি দীর্ঘস্থায়ী হবে না।

ডিএমটিসিএলের তথ্য বলছে, বিমানবন্দর-কমলাপুর মেট্রোর পাতাল অংশে তৈরি করা হবে ১২টি স্টেশন। স্টেশনগুলো হবে বিমানবন্দর, বিমানবন্দর টার্মিনাল-, খিলক্ষেত, যমুনা ফিউচার পার্ক, নতুনবাজার, উত্তর বাড্ডা, বাড্ডা, হাতিরঝিল পূর্ব, রামপুরা, মালিবাগ, রাজারবাগ কমলাপুরে। অন্যদিকে হেমায়েতপুর-ভাটারা মেট্রোর নয়টি স্টেশন হবে মাটির নিচে। এগুলো হলো গাবতলী, দারুস সালাম, মিরপুর-, মিরপুর-১০, মিরপুর-১৪, কচুক্ষেত, বনানী, গুলশান- নতুনবাজার। দুটি মেট্রোর স্টেশনের সব পয়েন্টই ঢাকার যানজটের অন্যতম কেন্দ্র।

ঢাকায় যোগাযোগ অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের সময়ভিত্তিক পরিকল্পনা করা হয়েছিল, বাস্তবে তা না হওয়ায় উন্নয়নকাজ চলাকালে যানজট ব্যাপক আকার ধারণ করছে বলে মনে করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক . সামছুল হক। প্রসঙ্গে তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, মেট্রোরেলের সঙ্গে অন্য প্রকল্পের সমন্বয়ের অভাবের কারণেই যানজট পরিস্থিতি অনেক প্রকট হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। সরকার ২০১০ সালে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু করেছিল। এটা চালু হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালে। উদ্দেশ্য ছিল, ঢাকার ব্যস্ত সড়কগুলোয় যখন মেট্রোরেল, বিআরটির মতো কাজ শুরু হবে তখন মানুষ যেন বিকল্প হিসেবে সেটি ব্যবহার করতে পারে। আমরা এখনো এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শেষ করতে পারিনি। এর মধ্যে একটির কাজ শেষ পর্যায়ে এনে আরো দুটি মেট্রোর কাজ শুরু হচ্ছে। এক্সপ্রেসওয়ের কাজ আগে শুরু করার যে উদ্দেশ্য ছিল, তা কাজে লাগেনি।

ব্যস্ততম সড়কে মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্প বাস্তবায়নকালে যানজট নিরসনে কী ধরনের উদ্যোগ নেয়া উচিত, এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি আরো বলেন, যানজট সহনীয় মাত্রায় রাখার সবচেয়ে ভালো উপায় গণপরিবহন ব্যবস্থায় জোর দেয়া। করিডোরে প্রাইভেট কার, সিএনজি অটোরিকশার মতো ছোট ছোট যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। শুধু একতলা, দোতলা বাস চলবে। এটা করতে পারলেই নির্মাণকাজ চলাকালে জনভোগান্তি অনেকাংশে কমে যাবে।

অন্যদিকে বিমানবন্দর-কমলাপুর হেমায়েতপুর-ভাটারা মেট্রোর নির্মাণকাজের প্রভাব ঢাকার যানজটে খুব একটা পড়বে না বলে মনে করছেন ডিএমটিসিএলের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, মেট্রো দুটির সিংহভাগ অংশই হচ্ছে মাটির নিচে। মাটির ৩০ মিটার নিচে টানেল বোরিং মেশিন দিয়ে কাজ করা হবে। স্টেশনে অবকাঠামো তৈরি করা হবে ওপেন কাট পদ্ধতিতে। কাজ শুরুর ছয় মাসের মধ্যে স্টেশনের ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচল অনেকটা স্বাভাবিক করে দেয়া হবে। আমরা কাজ করব মাটির নিচে। সড়কের ওপর দিয়ে যানবাহন চলাচলে কোনো সমস্যা হবে না।

ডিএমটিসিএলের তথ্য বলছে, এমআরটি--এর জন্য প্রয়োজনীয় সমীক্ষা, ধারণাগত নকশা বিশদ নকশা এরই মধ্যে তৈরি করা হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হবে ১২টি প্যাকেজে। এর মধ্যে প্রথম প্যাকেজের (সিপি-) মাধ্যমে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে গড়ে তোলা হবে ডিপো। দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন করে ঠিকাদার নিয়োগ প্রায় চূড়ান্ত করে এনেছে ডিএমটিসিএল। আরো চারটি প্যাকেজের দরপত্র প্রক্রিয়ার কাজ শুরু হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, মেট্রোটির নির্মাণকাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২৬ সালে। অন্যদিকে এমআরটি--এর নর্দার্ন রুটের ডিপো উন্নয়নের জন্য এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে ডিএমটিসিএল। বর্তমানে বিশদ নকশা তৈরির কাজ চলমান রয়েছে। ২০২৮ সালের মধ্যে মেট্রোর কাজ শেষ হবে।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন