এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব রিসার্চের গবেষণা

দক্ষতায় পিছিয়ে বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সাররা

শেখ তৌফিকুর রহমান

বাংলাদেশে কী পরিমাণ মানুষ ফ্রিল্যান্সিংয়ের সঙ্গে জড়িত তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। সরকারি হিসাবে দেশে ফ্রিল্যান্সারের সংখ্যা প্রায় সাড়ে ছয় লাখ বলে দাবি করা হয়। বলা হয়ে থাকে, খাতে আয়ের পরিমাণ প্রায় বিলিয়ন ডলার। আয়ের দিক থেকে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। খাতসংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের ফ্রিল্যান্সিং খাতে দক্ষ জনবলের সংকট রয়েছে। ফলে তারা অধিক দক্ষতাসম্পন্ন কাজে যুক্ত হতে পারছেন না। আর কারণেই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সাররা তুলনামূলক অনেক কম উপার্জন করছেন।

দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সারদের একটা বড় অংশই প্রাথমিক প্রশিক্ষণের ওপর নির্ভরশীল। প্রশিক্ষণ দিয়ে যেটুকু কাজ করা যায়, তাতেই তারা অভ্যস্ত। নতুন ক্ষেত্রে কাজ করতে বা কাজের দক্ষতা বাড়াতে যেসব প্রশিক্ষণ প্রয়োজন সেগুলোতে তারা আগ্রহ দেখান না। ফলে খাতে দক্ষ জনসম্পদ তৈরি হচ্ছে না।

মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্ট খাতে ফ্রিল্যান্সিং করেন সুমন সাহা। খাতে তার ১০ বছর কাজের অভিজ্ঞতা রয়েছে। নিজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে তিনি বলেন, অনেকে হুট করেই ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত হচ্ছেন। কেউ কেউ চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে, ঘরে বসে বিপুল অর্থ উপার্জনের প্রত্যাশা নিয়ে স্বল্প প্রশিক্ষণেই কাজে নামছেন। এতে প্রাথমিক ধাপের যেসব কাজ রয়েছে তারা কেবল সেগুলোই করতে পারছেন। তবে উচ্চ পারিশ্রমিকের কাজ যেমন ওয়েব ডেভেলপমেন্ট বা অ্যাপ্লিকেশন ডেভেলপমেন্টে কাজের লোকের যথেষ্ট অভাব রয়েছে। এসব কাজে যুক্ত হতে হলে ধৈর্যের পাশাপাশি সঠিক প্রশিক্ষণ পরিশ্রম প্রয়োজন, যা অনেকেই করতে চান না।

দেশের ফ্রিল্যান্স খাত নিয়ে সম্প্রতিআইটি ফ্রিল্যান্সিং ইন বাংলাদেশ: অ্যাসেসমেন্ট অব প্রেজেন্ট অ্যান্ড ফিউচার নিডসশীর্ষক এক গবেষণা প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণাটি প্রকাশ করেছেদি এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব রিসার্চ এতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, পাবনা বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন শিক্ষক অংশ নেন। গবেষণাটিতে বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সারদের দক্ষতা সংকটের পাশাপাশি বৈশ্বিক মানদণ্ডে দেশীয়দের আয়বৈষম্য উঠে এসেছে।

গবেষণায় সাতটি সুনির্দিষ্ট খাতে বৈশ্বিক মানদণ্ড অনুযায়ী বাংলাদেশে কর্মরত ফ্রিল্যান্সারদের আয়ের তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা হয়। যে খাতগুলোর চিত্র তুলে ধরা হয়েছে, সেগুলো ফ্রিল্যান্সিংয়ের একেবারে প্রাথমিক ধাপের। গবেষণায় দেখানো হয়েছে, অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ খাতে বৈশ্বিক মানদণ্ডে একজন পুরুষ নারীর ঘণ্টাপ্রতি গড় পারিশ্রমিক যথাক্রমে ৩৯ দশমিক ৩০ মার্কিন ডলার। বিপরীতে খাতে বাংলাদেশী পুরুষ নারী গড়ে পান ১৪ ১০ ডলার। ডিজাইন খাতে একজন পুরুষ নারীর গড় পারিশ্রমিক যথাক্রমে ৩৮ দশমিক ৬১ দশমিক ডলার; বিপরীতে বাংলাদেশী পুরুষ নারী গড়ে পান ২০ ডলার। বিজনেস সার্ভিস খাতে পুরুষ নারীর গড় পারিশ্রমিক ৩৮ ৬২ দশমিক ডলার; বিপরীতে বাংলাদেশী পুরুষ নারীর গড় পারিশ্রমিক ২৩ ১৯ ডলার।

এছাড়া নেটওয়ার্কিং অ্যান্ড ইনফ্রাস্ট্রাকচার ম্যানেজমেন্ট খাতে পুরুষ নারীর গড় পারিশ্রমিক ৫৪ দশমিক ৩০ ডলার; বিপরীতে বাংলাদেশী পুরুষ নারী পান গড়ে ২৪ ১৩ ডলার। সেলস অ্যান্ড মার্কেটিং খাতে পুরুষ নারীর গড় পারিশ্রমিক ৩৩ দশমিক এবং ৮৬ দশমিক ডলার; বিপরীতে বাংলাদেশী পুরুষ নারী গড়ে পান ১০ ডলার। রাইটিং অ্যান্ড ট্রান্সলেশন খাতে পুরুষ নারীর গড় পারিশ্রমিক ৪৪ দশমিক ৩৯ দশমিক ; বিপরীতে বাংলাদেশী পুরুষ নারীর গড় পারিশ্রমিক ১৩ ১২ ডলার। সফটওয়্যার ডেভেলপমেন্ট খাতে পুরুষ নারীর গড় পারিশ্রমিক ৯৭ এবং ৫৯ ডলার; বিপরীতে বাংলাদেশী পুরুষ নারী পান গড়ে ২৩ ১৭ ডলার।

বৈশ্বিক মার্কেট প্লেস সম্পর্কে বাংলাদেশী ফ্রিল্যান্সারদের ধারণার অভাব রয়েছে বলে মনে করেন গবেষণায় নিয়োজিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমের শিক্ষক আহমেদ রিজভান হাসান। তিনি বলেন, আমাদের ফ্রিল্যান্সারদের মার্কেট প্লেস সম্পর্কে ধারণার অভাব রয়েছে। এখানে কী ধরনের কাজ রয়েছে, কোন কাজের জন্য কী ধরনের দক্ষতা উন্নয়ন করতে হবে বা কোন টুলস শিখতে হবে সম্পর্কে সামগ্রিক ধারণাতেও ঘাটতি রয়েছে। ফলে তারা দক্ষ হয়ে গড়ে উঠছেন না। এছাড়া ভাষাগত দক্ষতার অভাবে ফ্রিল্যান্সারদের একটা বড় অংশ ক্লায়েন্টদের সঙ্গে ঠিকমতো যোগাযোগও রক্ষা করতে পারেন না।

একই গবেষণায় নিয়োজিত গোপালগঞ্জের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিজ্ঞান প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইন্যান্স অ্যান্ড ব্যাংকিং বিভাগের শিক্ষক তন্ময় বর্মণ বলেন, আমাদের ফ্রিল্যান্সারদের প্রাথমিক খাতে কাজ করার প্রবণতা অনেক বেশি। বৈশ্বিক বাজারে উচ্চ পারিশ্রমিকের যেসব কাজ রয়েছে, সেগুলো করার মতো পর্যাপ্ত দক্ষ ফ্রিল্যান্সার এখনো গড়ে ওঠেনি। তবে এখন কিছু পরিবর্তন হচ্ছে।

বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সার ডেভেলপমেন্ট সোসাইটির (বিএফডিএস) সভাপতি তানজিবা রহমান মনে করেন, দেশের অধিকাংশ ফ্রিল্যান্সারের আন্তর্জাতিক মার্কেট প্লেসে কাজ করার আগ্রহ খুবই কম। এজন্যই তারা নিজেদের দক্ষভাবে গড়ে তুলতে পারছেন না। সে কারণেই উচ্চ পারিশ্রমিক কাজে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে পারছেন না তারা।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে সাধারণ নিম্ন পারিশ্রমিকদের কাজ বেশি হয়। গেম ডেভেলপিং, বায়োমেডিকেল কনটেন্ট রাইটিং, ভার্চুয়াল অ্যাসিস্ট্যান্টশিপের মতো উচ্চ পারিশ্রমিকের কাজ খুব কম হয়। একটা সময় ছিল, এসব বিষয়ে লক্ষ্য করার মতো কোনো গ্রুপ ছিল না। এখন সে কাজটা বিএফডিএস করছে।

বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কল সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিংয়ের (বাক্য) সাধারণ সম্পাদক তৌহিদ হোসেন বলেন, আমাদের দেশের ফ্রিল্যান্সারদের বড় একটা অংশের সমস্যা হচ্ছে তারা কাজের পরিধির বিস্তৃতি ঘটাতে চান না। কেউ গ্রাফিক্স বা সফটওয়্যারের কিছু কাজ শিখলে তিনি মনে করেন এটি দিয়েই সারা জীবন কাজ করতে পারবেন। কিন্তু বিষয়টা এত সহজ নয়। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অবশ্যই তাকে দক্ষ হতে হবে, নিজেকে উন্নত করতে হবে। এমন অনেকে আছেন যারা সরকার থেকে পাওয়া বিনামূল্যের প্রশিক্ষণের বাইরে দক্ষতা উন্নয়নে আর কোনো প্রশিক্ষণ নেন না। এতে তার কাজের মানের উন্নয়ন ঘটে না।

বিষয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব সফটওয়্যার অ্যান্ড ইনফরমেশন সার্ভিসেসের (বেসিস) সভাপতি রাসেল টি আহমেদ বলেন, দেশে একটা ধারণা তৈরি হয়েছে যে ফ্রিল্যান্সিংয়ে যুক্ত হলে সহজেই ডলার উপার্জন করা যায়। কিন্তু উপার্জনের জন্য কাজের ক্ষেত্রে নিজেকে দক্ষভাবে গড়ে তুলতে হবে, সেই জায়গায় আর কেউ মনোযোগ দেয় না। এছাড়া দক্ষতা অর্জনে পিছিয়ে যাওয়ার আরেকটি কারণ হচ্ছে যোগাযোগ ঠিকঠাকমতো করতে না পারা। এসব সংকট কাটিয়ে উঠলে বাংলাদেশের ফিল্যান্সাররাও ভালো করতে পারবেন।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন