আলোকপাত

শেখ হাসিনার গণমুখী নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের রোল মডেল

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া

পালিত হলো বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জন্মদিন। তার প্রথম পরিচয় তিনি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জ্যেষ্ঠ সন্তান। জন্মের পর থেকে তিনি বাবার সংগ্রামী জীবন, বাংলার জনগণের মুক্তি স্বাধিকারের জন্য কারাবরণ, পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে বাঙালির ন্যায্য দাবি আদায়ের জন্য রাজনীতিকের কঠিন জীবন বেছে নেয়ার দৃঢ় প্রত্যয় দেখেছেন। একটা সময়ে বঙ্গবন্ধু সূচিত আন্দোলন-সংগ্রামেও শেখ হাসিনা স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুক্ত হয়েছেন। ১৯৬৬ সালের ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ঊনসত্তরের গণআন্দোলনে তার ভূমিকা আমাদের সে কথাই মনে করিয়ে দেয়।

সত্তর সালের নির্বাচনে জয়লাভ করেও বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর চক্রান্তে সরকার গঠন করতে পারেননি। সে কারণে তার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি চূড়ান্ত সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। একাত্তরের মার্চ রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দমাতে পারবে না।মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেবো, দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। বঙ্গবন্ধু যা ভাবতেন, তা বাস্তবায়ন করে দেখাতেন। বাঙালি জাতিকে তিনি একটি স্বতন্ত্র দেশ উপহার দিয়েছেন।

স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত বিজয়ের পর স্বদেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন করে বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ গড়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। নানা প্রতিকূলতা, বাধা-বিপত্তি, একশ্রেণীর রাজনীতিবিদের অসহযোগিতা বিরোধিতা, অসৎ ব্যবসায়ী নিজ দলীয় কিছু লোকের দুর্নীতি, কালোবাজারি, মজুদদারি প্রভৃতি মোকাবেলা দমন করে বঙ্গবন্ধু যখন দেশকে অগ্রগতি সুশাসনের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন, তখন ষড়যন্ত্রকারী ঘাতকদের হাতে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সপরিবারে কতিপয় আত্মীয়-পরিজনসহ নিহত হন। বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় আল্লাহর কৃপায় প্রাণে বেঁচে যান।

১৯৬৮ সালে পরমাণু বিজ্ঞানী . ওয়াজেদ মিয়ার সঙ্গে শেখ হাসিনার বিবাহের পর তাকে রাজনীতিতে সক্রিয় হতে দেখা যায়নি। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর দুঃখজনক শাহাদত বরণ না করলে শেখ হাসিনা হয়তো রাজনীতিতে আসতেন না। ১৯৭৫ সালের ৩০ জুলাই শেখ হাসিনা তার দুই সন্তান বোন শেখ রেহানাকে নিয়ে স্বামীর কর্মস্থল জার্মানির কার্লস্রূয়েতে বেড়াতে যান। . ওয়াজেদ মিয়া ওই সময় কার্লস্রূয়ে ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পোস্টডক্টরাল রিসার্চে নিয়োজিত ছিলেন। ১৫ আগস্ট প্রত্যুষে তিনি ব্রাসেলসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতের বাসায় থাকা অবস্থায় বাংলাদেশের ঘটে যাওয়া দুঃখজনক ঘটনা জানতে পারেন। রাষ্ট্রদূত কবি সানাউল হক আগের রাতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দুই কন্যার সম্মানেক্যান্ডেল লাইট ডিনারের ব্যবস্থা করেন। পরদিন দেশের ক্ষমতা বদলের পর রাষ্ট্রদূতের অবস্থান সম্পূর্ণ পরিবর্তন হয়ে যায়। টেলিফোনে জার্মানিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীকে বললেন, ‘এসব ঝামেলা আপনি আমার উপর চাপিয়ে দিয়েছেন, তাড়াতাড়ি ওদেরকে নিয়ে যান। একটি মৃত্যুর শোক যেখানে সহ্য করা কঠিন, সেখানে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা মা-বাবা-ভাইসহ পরিবারের নিকট আত্মীয়দের হারিয়ে শোকে, দুঃখে আতঙ্কে দিশেহারা হয়ে পড়েন। রাষ্ট্রদূত হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সহযোগিতায় তারা ভারতে রাজনৈতিক আশ্রয় পেয়ে ২৫ আগস্ট জার্মানি থেকে নয়াদিল্লি গমন করেন।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুর কন্যাদ্বয় শেখ হাসিনার স্বামী-সন্তানকে থাকার জন্য একটি ফ্ল্যাট বরাদ্দ করেন। পরবর্তী সময়ে . ওয়াজেদ মিয়াকে ভারতীয় পরমাণু কেন্দ্রে একটি চাকরি দেয়া হয়। পরিচয় গোপন করে অতিকষ্টে শেখ হাসিনা দিল্লিতে সাধারণ জীবনযাপন করতেন। রান্নাবান্না, ঘরের কাজ, সন্তান লালন-পালন, বাজার করা ইত্যাদি করে জীবন বাঁচানোর চেষ্টা করেন। অবশ্য কয়েক বছর পর শেখ রেহানা লন্ডনে এক আত্মীয়ের বাড়িতে চলে আসেন। তবে জেদি, আত্মপ্রত্যয়ী দুই কন্যা পিতা-মাতা-ভাইসহ আত্মীয়দের হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ নেয়া বিচারের দাবির কথা ভোলেননি। ঘাতকদের বিচারের দাবিতে সত্তরের দশকের শেষদিক থেকেই লন্ডনসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে জনমত গড়তে শুরু করেন।

বঙ্গবন্ধুর শাহাদত বরণের পর তার দল আওয়ামী লীগ নানা ঘাত-প্রতিঘাত, অনৈক্য বিভক্তির মধ্যে ধুঁকে ধুঁকে টিকে থাকে। ১৯৭৯ সালের পর থেকেই আওয়ামী লীগের নেতারা দিল্লিতে শেখ হাসিনার সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন। মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এবং বাংলাদেশের বৃহত্তম দল আওয়ামী লীগের তখন বড় দুর্দিন। দলের পুনর্গঠন ঐক্য ফিরিয়ে আনার জন্য সর্বজনগ্রহণযোগ্য একজন নেতার প্রয়োজন। তাই তৎকালীন নেতারা ফেব্রুয়ারি ১৯৮১-এর কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ হাসিনাকে দলীয় সভাপতি পদে মনোনীত করে। অবশেষে ১৭ মে, ১৯৮১ শেখ হাসিনা দীর্ঘ ছয় বছর নির্বাসিত পলাতক জীবন থেকে নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন করেন।

১৯৭২ সালে ১০ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে দেশে প্রত্যাবর্তন করলে প্রায় ১০ লাখ লোক তার সংবর্ধনায় রেসকোর্স ময়দানে সমবেত হন। একইভাবে বাবা-মা স্বজনহারা শেখ হাসিনা ১৭ মে, ১৯৮১ সালে ঢাকায় অবতরণ করলে মানিক মিয়া এভিনিউতে লাখ লাখ লোক সমবেত হয়ে তাকে সাদরে গ্রহণ করেন। মঞ্চে উঠে শেখ হাসিনা কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, ‘আমি সর্বহারা, আমার কেউ নাই। আপনাদের মাঝে আমি আমার হারানো পিতা-মাতা, আমার ভাই, আত্মীয়-স্বজন সবাইকে খুঁজে পেতে চাই। আপনাদের কথা দিলাম দেশের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য আমি জীবন উৎসর্গ করব। তিনি আরো বলেন, ‘আমি আওয়ামী লীগের নেতা হওয়ার জন্য আসিনি। আপনাদের বোন হিসেবে, মেয়ে হিসেবে, বঙ্গবন্ধুর আদর্শে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবে আমি আপনাদের পাশে থাকতে চাই।

ওই বছরের ৩০ মে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে কতিপয় সেনা কর্মকর্তার হাতে নিহত হলে ১৯৮২ সালে জেনারেল হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন। শেখ হাসিনা আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করার পাশাপাশি রাষ্ট্রপতি এরশাদের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াতে ইসলামীসহ সম্মিলিত বিরোধী দলের নেতৃত্বে গণআন্দোলনের মুখে নব্বইয়ের ডিসেম্বরে স্বৈরাচারী এরশাদের পতন ঘটে।

এর আগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ এরশাদের অধীন ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু স্বৈরাচারী এরশাদ নিশ্চিত পরাজয় ঠেকানোর জন্য ভোট ডাকাতির আশ্রয় নিয়ে আওয়ামী লীগের বিজয় ছিনিয়ে নেয়। ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনেও সব জরিপে আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকলেও ফলাফলে বিএনপি জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। শেখ হাসিনা এরশাদ বিএনপি উভয় সরকারের আমলে সারা দেশের গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে ঘুরে বেড়িয়ে মানুষের সুখ-দুঃখ, অভিযোগ শোনেন এবংশেখের বেটি হিসেবে দুঃখী মানুষের মন জয় করেন। অবশেষে দীর্ঘ ২১ বছর পর শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করলে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হন।

১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে শেখ হাসিনার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময় গঙ্গা নদীর পানির হিস্যা পাওয়ার ব্যাপারে ভারতের সঙ্গে ৩০ বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। শান্তি বাহিনীর সঙ্গে আলাপ-আলোচনা সমঝোতা করে পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ফলে পার্বত্য জেলাগুলোয় শান্তিবাহিনীর সঙ্গে দীর্ঘকালের যুদ্ধ বিরোধের নিষ্পত্তি হয়। জাতীয় সংসদ ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করার ফলে বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা জাতীয় চার নেতা হত্যার বিচারের পথ সুগম হয়। যমুনা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ করে শেখ হাসিনা ১৯৯৮ সালে সেতু উদ্বোধন করেন।

২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে বিএনপি পুনরায় সরকার গঠন করলে বেগম খালেদা জিয়া পুনরায় প্রধানমন্ত্রী হন এবং শেখ হাসিনা বিরোধী দলের নেতার ভূমিকায় ফিরে আসেন। ২০০৪ সালে শেখ হাসিনার জনসভায় গ্রেনেড হামলা হলে আওয়ামী লীগের বহু নেতাকর্মী হতাহত পঙ্গুত্ব বরণ করেন। আওয়ামী লীগ নেত্রী আইভি রহমান (প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী) ওই হামলায় নিহত হন। শেখ হাসিনার প্রতি পিস্তলের গুলি বর্ষিত হলে তার দেহরক্ষী মহিউদ্দিন নিজ জীবনের বিনিময়ে তাকে রক্ষা করেন। অবশেষে সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনা ২০০৯ সালের জানুয়ারিতে পুনরায় প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তার দ্বিতীয়বারের শাসনামলে সরকারের সচিব হিসেবে আমার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণের সুযোগ হয়। দ্বিতীয়বার প্রধানমন্ত্রী হলে তাকে আগের চেয়ে আরো পরিপক্ব, সরকারি কাজে দক্ষতাসম্পন্ন এবং লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়চেতা নেত্রী হিসেবে দেখা যায়। তিনি সরকারি কর্মকর্তাদের সঙ্গে সু-আচরণ এবং সততা দক্ষতার মূল্যায়ন করেন। পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পটিকে প্রধানমন্ত্রী সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে চিহ্নিত করেন এবং সরকারের মেয়াদকাল অর্থাৎ ২০১৩-এর ডিসেম্বরের মধ্যে সমাপ্ত করার নির্দেশ দেন। কিন্তু কথিত দুর্নীতির ষড়যন্ত্রের অভিযোগে বিশ্বব্যাংকের নেতৃত্বে উন্নয়ন সহযোগী সংস্থাগুলো পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পের কাজ স্থগিত করলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন এবং পরবর্তী সময়ে তা বাস্তবায়ন করে বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেন। শেখ হাসিনার একটি মাত্র দৃঢ়চেতা সাহসী সিদ্ধান্ত বাংলাদেশের আর্থিক অগ্রগতিতেও তাকে একজন সাহসী আপসহীন রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে বিশ্বে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

২০০৮ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের প্রাক্কালে শেখ হাসিনার নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিলরূপকল্প-২০২১ অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে দেশকে স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে উন্নয়নশীল মধ্যম আয়ের দেশে রূপান্তরিত করা। নির্ধারিত সময়ের আগেই জাতিসংঘের সব ক্রাইটেরিয়া পূরণ করে বাংলাদেশ উন্নয়নশীল দেশে পৌঁছে যায়। আগামী ২০২৬ সালে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে বিবেচিত হবে। এরই মধ্যে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ২০১৪ ২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করলে শেখ হাসিনা চতুর্থ মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। টানা তিন মেয়াদে সরকারের ধারাবাহিকতা থাকায় দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বিগত ১২ বছর গড়ে শতাংশের ওপর এবং করোনা মহামারীপূর্ব বছর (২০১৮-১৯ অর্থবছরে) সর্বোচ্চ দশমিক ১৫ শতাংশে পৌঁছে। ২০২২ সালে মোট জিডিপির আকার ৪৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারেরও অধিক পৌঁছে যায়। মাথাপিছু আয় দাঁড়ায় হাজার ৮২৪ ডলার। ২০০৫ সালে দেশের দারিদ্র্য হার যেখানে ৪০ শতাংশ, সেখানে ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার কমে ২০ দশমিক শতাংশে পৌঁছে। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সর্বোচ্চ ৪৮ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে। ২০২২ সমাপ্ত অর্থবছরে দেশের রফতানি আয় রেকর্ড ৫২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছে। অবশ্য বিশ্বব্যাপী মূল্যস্ফীতির কারণে আমদানি ব্যয় হয় ৮৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। ফলে বাণিজ্য ঘাটতি দঁাড়ায় ৩০ দশমিক ৮২ বিলিয়ন ডলার।

২০২০ সালের প্রথমার্ধ থেকে করোনা মহামারীর প্রকোপ শুরু হলে সারা বিশ্বে স্থবিরতা নেমে আসে। কঠিন সময়েও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে বাংলাদেশের কৃষি শিল্পোৎপাদন এবং দেশের অর্থনীতির চাকা সচল ছিল। যেখানে বিশ্বের অধিকাংশ দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ঋণাত্মক ছিল, সেখানে করোনার প্রথম বছর বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হয় দশমিক শতাংশ এবং দ্বিতীয় বছর তা বেড়ে দঁাড়ায় দশমিক শতাংশ। করোনা মোকাবেলায় এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে ভালো অবস্থানে রয়েছে। করোনা মহামারীসৃষ্ট মন্দাবস্থা থেকে পরিত্রাণের উপায় উদ্ভাবনে জাতিসংঘ ছয়জন সরকারপ্রধানের সমন্বয়ে গ্লোবাল ক্রাইসিস রেসপন্স গ্রুপ (জিসিআরজি) গঠন করে যাদের একজন হলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক বৈশ্বিক সম্মেলনগুলো শেখ হাসিনার গঠনমূলক ভূমিকার জন্য এবং বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের একটি ভুক্তভোগী দেশ হওয়ার কারণে জাতিসংঘ কর্তৃক বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে বিশ্বের ৫৫টি দেশের প্রায় দশমিক বিলিয়ন লোকের সংস্থা ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হয়। তিনি ২০২২ সালের আগস্ট পর্যন্ত সংস্থার নেতৃত্ব দেন।

দেশ পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দক্ষতা, সততা, দেশপ্রেম, সর্বোপরি বলিষ্ঠ নেতৃত্ব সর্বজনবিদিত। বর্তমানে দেশে ১০-১২টি মেগা প্রকল্প চলমান। পদ্মা সেতুর নির্মাণকাজ শেষ হলে সেতু ২৫ জুন ২০২২ যান চলাচলের জন্য খুলে দেয়া হয়। সেতু নির্মাণের ফলে দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি দশমিক ২৩ শতাংশ বাড়বে বলে আশা করা যায়। মেট্রোরেল, কর্ণফুলী টানেল এবং ঢাকা বিমানবন্দর থেকে যাত্রাবাড়ীর অদূরে কুতুবখালী পর্যন্ত নির্মীয়মাণ এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বছরের শেষ নাগাদ চালু হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট- উৎক্ষেপণসহ ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে বাংলাদেশ আশাতীত সাফল্য অর্জন করেছে। আইসিটি সেবা রফতানি করে বাংলাদেশ বছরে বিলিয়ন ডলার আয় করে। দেশে চলমান নির্মীয়মাণ অনেক অর্থনৈতিক অঞ্চল আইসিটি পার্কে প্রচুর দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ আকৃষ্ট হচ্ছে। কৃষি শিল্পোৎপাদনে দেশ এগিয়ে চলার কারণে সাম্প্রতিক রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পৃথিবীর অনেক দেশে মন্দাভাব দেখা দিলেও বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা তুলনামূলক ভালো। মূল্যস্ফীতি, টাকার অবমূল্যায়ন, জ্বালানি সংকট ইত্যাদি সত্ত্বেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকারের সময়োচিত পদক্ষেপ প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) বাস্তবায়নে দেশ সঠিক পথেই রয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগেরূপকল্প-২০৪১ জারি করে ২০৪১ সালের মধ্যে উন্নত দেশের কাতারে শামিল হওয়ার লক্ষ্য স্থির করা হয়েছে। ২১০০ সাল পর্যন্ত-দ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। গত বছর এক জনসভায় প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন, ‘এখন আমার বয়স ৭৫ বছর, ২০৪১ আমার বয়স হবে ৯৫। তখন আমি নিশ্চয়ই ক্ষমতায় থাকব না, হয়তো বেঁচে থাকব না। কিন্তু আগামী ২০ বছরের মধ্যে বাংলাদেশ যাতে উন্নত দেশে পরিণত হতে পারে তার জন্য বিস্তারিত পরিকল্পনা কর্মসূচি রেখে যাচ্ছি।

বঙ্গবন্ধু প্রবর্তিত বৈশ্বিক নীতিসবার সঙ্গে বন্ধুত্ব, কারো সঙ্গে বৈরিতা নয়, মূলমন্ত্র প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও অনুসরণ করেন। সেজন্য বাংলাদেশ কোনো জোটে অন্তর্ভুক্ত নয়, বরং সব দুর্বল-শক্তিশালী দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের সুসম্পর্ক বিদ্যমান। শেখ হাসিনার বৈশ্বিক নীতি এবং জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে জলবায়ু পরিবর্তন, মাইগ্রেশন, সংকট মোকাবেলায় সম্পদ বণ্টন, নারীর ক্ষমতায়ন, যুদ্ধ বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ, জ্বালানি নিরাপত্তা প্রভৃতি বিষয়ে প্রস্তাব প্রণয়ন বিশ্বসভায় উত্থাপন বিশ্ব নেতাদের কাছে প্রশংসিত হচ্ছে।

মিয়ানমার থেকে বিতাড়িত বাস্তুচ্যুত ১২ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিয়ে বাংলাদেশ বিশ্বের প্রশংসা কুড়িয়েছে এবং শেখ হাসিনামাদার হিউম্যানিটি উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন। জাতিসংঘে প্রদত্ত ভাষণে তিনি রোহিঙ্গাদের শান্তিপূর্ণভাবে নিজ দেশে ফেরত পাঠানোর ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিশ্ব নেতাদের প্রতি আহ্বান জানান।

বরাবরের মতো এবারও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদান করেন। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধে উন্নত দেশগুলো যেখানে পক্ষ-বিপক্ষভুক্ত সেখানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যুদ্ধ বন্ধে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সব পক্ষকে আহ্বান জানিয়েছেন। তাছাড়া যুদ্ধের কারণে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে বিশ্বের দেশগুলোর অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়ও তুলে ধরেন। পরিস্থিতিতে খাদ্য উৎপাদন সরবরাহের ব্যবস্থা সচল রাখা, জ্বালানি নিরাপত্তা ব্যবসা বাণিজ্য পুনরুজ্জীবিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন। এবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ কর্তৃক বিশ্বের দ্বিতীয় সেরা সরকারপ্রধান হিসেবে বিবেচিত হয়েছেন। দেশ শাসনে তার বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, দেশপ্রেম জনকল্যাণে অবদানের জন্য তিনি যেমন জননেত্রী হিসেবে পরিচিত, তেমনি সারা বিশ্বের সমস্যা মঙ্গলের জন্য কথা বলার কারণে তিনি এখন বিশ্বনেত্রী।

বঙ্গবন্ধু যেমন ছিলেন একজন দূরদর্শী, দেশপ্রেমিক, গণমানুষের নেতাতারই আদর্শে উজ্জীবিত হয়ে শেখ হাসিনাও গণমুখী নীতি পরিকল্পনা গ্রহণ করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করে চলেছেন। দেশের সমস্যা সম্ভাবনা তার নখদর্পণে। সামাজিক সুরক্ষার মাধ্যমে দেশের বয়স্ক, দুস্থ, স্বামী পরিত্যক্তা নারী, চা-শ্রমিক, অসচ্ছল প্রতিবন্ধী, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী প্রভৃতি শ্রেণীর লোককে ভাতা দিয়ে সহায়তা করে যাচ্ছেন, ভূমিহীন আশ্রয়নহীনদের বাড়ি নির্মাণ করে দিচ্ছেন। ফলে সংকটকালেও দরিদ্র্ মানুষ উপকৃত হয়েছেন। আশা করা যাচ্ছে বৈশ্বিক মন্দার হাতছানিতে দেশে যে সাময়িক অর্থনৈতিক অস্থিরতা দেখা দিয়েছে, শেখ হাসিনার গণমুখী নেতৃত্ব সময়োচিত পদক্ষেপে তা কাটিয়ে উঠে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আবার ধাবিত হবে বাংলাদেশ।

২৮ সেপ্টেম্বর, ২০২২ শেখ হাসিনার ৭৬তম জন্মদিন। জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে যোগদান উপলক্ষে সদর দপ্তর নিউইয়র্কে তার জন্মদিন পালিত হচ্ছে। তার প্রাণপ্রিয় দেশবাসীর পক্ষ থেকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা অসীম শ্রদ্ধা।

 

মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া: সাবেক সিনিয়র সচিব এনবিআরের সাবেক চেয়ারম্যান, বর্তমানে জার্মানিতে নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন