দখল ও দূষণের শিকার নদী

সাংবিধানিক দায়িত্ব রক্ষায় সরকার বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিক

নদীমাতৃক দেশের ইতিহাস ক্রমেই ম্লান হতে যাচ্ছে। দেশের নদীগুলোর অবস্থা যে শোচনীয় তা নদীর সার্বিক চিত্র পর্যবেক্ষণ করলেই বোঝা যায়। এর পেছনে দখলদারিত্ব থেকে শুরু করে নানা অনিয়ম জড়িত। বিশেষ করে ঢাকার চারপাশের শীতলক্ষ্যা, বুড়িগঙ্গা, তুরাগ বালু্ল- চার নদীর দিকে তাকালে স্পষ্ট হয়ে ওঠে দখল দূষণের মহোৎসব। দখল আর দূষণের কর্মকাণ্ড ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে ব্যাপক আকারে। সম্প্রতি এক আলোচনা সভায় বক্তারা নদী রক্ষা করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব বলে পুনরায় অভিমত ব্যক্ত করেছেন। নদী দখলের প্রতিযোগিতা শুধু বড় শহর-নগর-বন্দর-গঞ্জেই সীমাবদ্ধ নয়, দেশের সব শহরাঞ্চলেই তা ঘটছে। কেবল নদী নয়, শহরের ভেতরের বা পাশের খালগুলোও অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে দ্রুত। নদী থেকে ভূমি সৃষ্টির জন্য নেয়া হচ্ছে বিচিত্র সব কলাকৌশল। সৃষ্টি করা হচ্ছে কৃত্রিম চর। পাশাপাশি শিল্পবর্জ্য থেকে শুরু করে মানুষের কার্যক্রম এমনকি কৃষিকাজের ফলে নদী আজ দূষণের শিকার। এমন প্রবণতা অব্যাহত থাকলে নদীগ্রাস আগামী দিনে পরিবেশসহ সার্বিক পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটাবে। তাই নদী রক্ষায় আর সময়ক্ষেপণ নয়। দখলকৃত নদী উদ্ধারে অভিযান জোরদার করতে হবে।

বিশ্বে নদীকে প্রথম একটি স্বাধীন সত্তা হিসেবে ঘোষণা করেন ২০১৬ সালে কলম্বিয়ার সাংবিধানিক আদালত। কলম্বিয়ার চোকো রাজ্যের কৃষি সাংস্কৃতিক সক্রিয়তা রক্ষায় আত্রাতো নদীর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা বিবেচনা করে নদী রক্ষায় কলম্বিয়ার সাংবিধানিক আদালত আত্রাতো নদীকে স্বাধীন সত্তা ঘোষণা করে। পৃথিবীর ইতিহাসে নদীকে আইনগত ব্যক্তি ঘোষণাকারী দ্বিতীয় আদালত হলো ভারতের উত্তরখণ্ড রাজ্যের হাইকোর্ট। নদীকে আইনগত ব্যক্তি হিসেবে পৃথিবীর তৃতীয় ঘোষণা আসে তুরাগ নদীকে আইনি ব্যক্তি ঘোষণাকারী বাংলাদেশের হাইকোর্টের রায়ে। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ১৮()- বলা হয়েছেরাষ্ট্র বর্তমান ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন বন্যপ্রাণীর সংরক্ষণ নিরাপত্তা বিধান করিবেন। অর্থাৎ অন্যদিকে অনুচ্ছেদ ২১ মোতাবেকজাতীয় সম্পত্তি রক্ষা করা প্রত্যেক নাগরিকের কর্তব্য। অর্থাৎ বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক জাতীয় সম্পদ রক্ষা করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ।জাতীয় সম্পত্তি-এর সমার্থকপাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি যা জাতীয় সম্পত্তি তা- পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি, আবার যা পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি তা-জাতীয় সম্পত্তিজাতীয় সম্পত্তি তথা পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি সংশ্লিষ্টতায় সরকার রক্ষক বা ট্রাস্টি, মালিক নয়।জাতীয় সম্পত্তি তথা পাবলিক ট্রাস্ট সম্পত্তি হলো পরিবেশ, জলবায়ু, জলাভূমি তথা সমুদ্র, সমুদ্রসৈকত, নদ-নদী, নদীর পাড়, খাল-বিল, খাল-বিলের পাড়, হাওর-বাঁওড়, ঝিল, নালা, ঝিরি, সব উন্মুক্ত জলাশয়, পাহাড়-পর্বত, বন, বন্যপ্রাণী, বাতাস ইত্যাদিসহ এমন সব সম্পদ যা প্রকৃতির দান। এসব সম্পত্তি সবার এবং এসবের ওপর প্রত্যেক নাগরিকের সমান অধিকার। অধিকার সমুন্নত রাখার সাংবিধানিক দায়িত্ব বর্তায় সরকারের ওপর।

সরকার নদ-নদী রক্ষার জন্য জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন, ২০১৩ পাস করে। আগস্ট ২০১৪ সালে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন গঠিত হয়। আইনের ১২ ধারায় কমিশনের কার্যাবলি দায়িত্বাবলি নির্ধারিত হয়েছে। আইনের অধীনে নদীর অবৈধ দখল পুনর্দখল রোধ, নদী নদীর তীরে স্থাপিত অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ, নদীর পানি পরিবেশ দূষণমুক্ত রাখা, শিল্প-কারখানা কর্তৃক সৃষ্ট দূষণ, অবৈধ কাঠামো নির্মাণ নানা অনিয়ম রোধ এবং নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ পুনরুদ্ধার, নদীর যথাযথ রক্ষণাবেক্ষণ, নৌ-পরিবহনযোগ্য হিসেবে নৌপথকে গড়ে তোলা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নে নদীর বহুমাত্রিক ব্যবহার নিশ্চিত করার স্বার্থে জাতীয় নদী কমিশন সক্রিয়ভাবে কাজ করবে। জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনকে স্বাধীন শক্তিশালী কর্তৃপক্ষ হিসেবে গড়ে তুলতে হলে অবশ্যই তাকে একটি সমন্বিত কার্যক্রমের আধেয় হয়ে উঠতে হবে। প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে সরকারের প্রণীত বন্যা, নদীভাঙন, নদী ব্যবস্থাপনা, নগর গ্রামে পানি সরবরাহ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা এবং বন্যা নিয়ন্ত্রণ নিষ্কাশন ব্যবস্থাপনার দীর্ঘমেয়াদি কৌশল হিসেবে বহু আলোচিতবদ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০-এর কথা। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের দীর্ঘমেয়াদি কর্মপরিকল্পনার সঙ্গে বদ্বীপ পরিকল্পনার সামঞ্জস্য বিধানের বিষয়টি অবশ্যই সরকারকে আমলে নিতে হবে।

দেশের উচ্চ আদালতে নদীর সীমানা নিয়ে বিরোধ, নদীদূষণ, নদী দখল, নদী ভরাটসহ নানা বিষয়ে প্রায় পাঁচ লাখ মামলা ঝুলে আছে। সাম্প্রতিক এক রায়ের পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালতের এক বিচারক বলেছেন, জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন এসব বিরোধ নিষ্পত্তিতে ভূমিকা রাখলে বিপুলসংখ্যক মামলা হয়তো আদালতেই আসত না। অন্যদিকে নানা সময়ে দেশের আদালতগুলোয় নদীর সুরক্ষা নিয়ে অনেক রায় ঘোষণা সত্ত্বেও সেসবের বাস্তবায়ন ঝুলে গিয়েছে সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মধ্যকার আমলাতান্ত্রিক জটিলতায়। সাম্প্রতিক সময়ে নদী দখল রোধ দখলকৃত নদী উদ্ধারে বেশকিছু অভিযান পরিচালনা করেছে সরকার। নদী রক্ষা কমিশনও উদ্যোগী হয়ে কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। কিন্তু তার পরও নদী দখল দূষণ থেমে নেই। এখান থেকে পরিত্রাণে রাষ্ট্রকে সক্রিয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। নদী রক্ষায় শুধু প্রকল্প গ্রহণ করলেই হবে না, বাস্তবায়নও করতে হবে। নদীর তীরে মিল-কলকারখানা নির্মাণ বন্ধ করতে হবে। এর আগে যেসব মিল-কলকারখানার বর্জ্য শোধনাগার নেই, সেগুলোর শোধনাগার তৈরি বাধ্যতামূলক করতে হবে। দেশের বড় বড় শহর, সিটি শহর, জেলা শহর, পৌর এলাকা দূষিত বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে নদীর সঙ্গে সংযুক্ত না করে শোধনাগারের মাধ্যমে শোধন করতে হবে। সমুদ্রের পাড়ে জাহাজ ভাঙা শিল্প নদীদূষণ পরিবেশ দূষণের কারণে বন্ধ করতে হবে অথবা নদীদূষণ ঠেকাতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের নদীগুলোর হারানো প্রবাহ ফিরিয়ে আনা এবং যেগুলোর প্রবাহ আছে সেগুলোর প্রবাহ বজায় রাখার ক্ষেত্রে খুবই আন্তরিক। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন যদি শক্তিশালী হতো তাহলে কমিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগের সঙ্গে কার্যকর সম্পর্ক স্থাপন হতো। যে সম্পর্ক নদী রক্ষায়, নদী উদ্ধারে, আন্তঃসীমান্তীয় নদীর প্রসঙ্গে বাংলাদেশ অনেকখানি এগিয়ে যেতে পারত। প্রধানমন্ত্রীর নদী রক্ষার কাজটি সহজ হতো। আমাদের দেশের নদীগুলোর সঙ্গে অনেকগুলো মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট। মন্ত্রণালয়গুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনপূর্বক জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে কাজ করতে হলে এর কাজের কলেবর এবং ক্ষমতা দুই- বৃদ্ধি করা প্রয়োজন। ২০১৯ সালে হাইকোর্ট আমাদের নদীগুলোকে রক্ষার জন্য ১৭ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন। নদী দখল দূষণকে ফৌজদারি অপরাধ ঘোষণা করেছেন এবং দখলকারী দূষণকারীদের জন্য কঠোর শাস্তির পরামর্শ দিয়েছেন।

সেই সময়ে আদালত জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে ক্ষমতায়ন করতে এবং নদীসংক্রান্ত অপরাধে কারাদণ্ড মোটা অংকের জরিমানার কঠোর বিধান অন্তর্ভুক্তির জন্য সরকারকে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন সংশোধনের নির্দেশ দেন। আদালতের আদেশের পর জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশন আইন ২০২০-এর খসড়া প্রস্তুত করা হয়েছে, যেখানে নদী দখল এবং দূষণ মোকাবেলা করার বিধান রাখা হয়। কিন্তু সেটি এখনো ঝুলে রয়েছে। খসড়া আইনটি জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশন আইন ২০১৩-এর স্থলে প্রণীত হওয়ার কথা। জাতীয় নদী সংরক্ষণ কমিশন আইন ২০১৩ নদী দখল দূষণে জড়িত অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষমতা দেয় না, কেবল সুপারিশ করতে পারে। কারণেই আমাদের নতুন আইন প্রয়োজন। সরকার যদি আমাদের নদীগুলোকে বাঁচানোর ব্যাপারে সত্যিই আন্তরিক হয়, তাহলে নতুন জাতীয় নদী রক্ষা আইন প্রণয়নের জন্য দ্রুত উদ্যোগ নেয়া উচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

আরও পড়ুন